ফারিহা আহাম্মেদঃ আমার ২২ বছরের দীর্ঘ জীবনে অনেক মানুষ দেখসি, কিন্তু আমার আম্মুর মত সাহসী মানুষ আমি একজনও পাইনাই। জীবনে নানা জিনিস নিয়ে আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। সেটা জানাতেই এই লেখা। আমার আম্মু নানা বিচিত্র দক্ষতার অধিকারী।
উনি একইসাথে স্কুলে পড়ান, আবৃত্তি করেন, কবিতা লেখেন, নতুন ভাষা শেখেন, অসম্ভব সুন্দর সব জামা বানাতে পারেন এবং ১০০০ টাকার জিনিস অনায়াসে ২০০ টাকায় কিনতে পারেন। সেই ২০১৩ সালে এই মহীয়সী নারী তার ২ ছেলে মেয়ে নিয়ে রুমা-কেওক্রাডং এর কর্দমাক্ত রাস্তা পুরোটা ট্রেক করেছেন এবং লাস্টে গিয়ে মন্তব্য করেছেন ‘এই জিনিস দেখার জন্য ৪ ঘন্টা পাহাড়ে উঠলাম?’ এইরকমই ভাবলেশহীন আবেগশূন্য মানুষ তিনি।
তাকে মুগ্ধ করা খুবই পরিশ্রমের কাজ যেইটা করতে আমাকে প্রতিনিয়ত নানান ঝামেলা দিয়ে যেতে হয়। উপরের অংশ তার ব্যক্তিত্ব নিয়ে। এইরকম একজন মানুষ কিভাবে আমার জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ভূমিকা রেখেছে সেইটা নিয়ে আমার লেখার পরের অংশ। তার মত ভাবলেশহীন এখনও হইতে পারিনাই (চেষ্টায় আছি), তাই তার জন্মদিনে বিশাল রচনা লিখে কৃতজ্ঞতার ভার কমাইতে চাই। জীবনের বিভিন্ন মুহুর্তে অনেক কিছুর জন্য আম্মুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এর মধ্যে প্রথমেই আসে যখন যেটা চাইসি সেটা করতে দেয়া।
ছোটবেলায় প্রচুর বই পড়তে চাইতাম, ৫-৬ বছর বয়সে যখন বাসায় আব্বু, আম্মু, ভাইয়ার সব বই প্রায় পড়ে ফেলসি, তখন আম্মু নিজ উদ্যোগে কাছের এক লাইব্রেরিতে গিয়ে মেম্বার বানাই দিল। শুধু প্রথম কয়েক দিন নিজে নিয়ে গেসিল, এরপর থেকে একা একা যাইতাম, একটা ছোট বাচ্চা অনেক ঝামেলা করে রাস্তা পার হইতেসে এবং প্রতিদিন লাইব্রেরি থেকে মোটা মোটা কিছু বই নিয়ে বের হইতেসে, এই দৃশ্য খুবই অদ্ভুত।
লাইব্রেরির মত এত সুন্দর একটা জিনিসের অস্তিত্ব পৃথিবীতে থাকতে পারে এইটার সাথে প্রথম পরিচয় করাই দিল আম্মু। এরপর সেইকালে কোটি কোটি বই পড়লাম, অনেক বই পড়লে অনেক লিখতে ইচ্ছা করে, এই বিষয়েও আম্মুকে বলতে হয়নাই, নিয়মিত যাতে লিখতে পারি, সেজন্য আম্মু একেবারে ছোটকাল থেকে বলত যাতে ডায়রি লিখি।
স্কুলজীবনের প্রথম ৫ বছরে আমার লেখা ডায়রির সংখ্যা ১০ টা, এর মধ্যে ক্লাস ফোরে আমি ৩০০ পৃষ্ঠার এক বিশাল স্পিরিচুয়াল উপন্যাস লিখলাম, যেইটা পড়ে আম্মু কিছু বুঝল না, কিন্তু বলল খুবই ভাল হইসে, আরো লেখ।
এই যে আমার দুনিয়ার হাবিজাবি কাজের প্রতি এই ভদ্রমহিলার একনিষ্ঠ সমর্থন ছিল, এইটার জন্য আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আম্মুর দ্বিতীয় যে জিনিসটা বিশাল পরিধিতে আমার জীবন সহজ করে দিসে সেটা হল, সম্পূর্ণ একা চলতে শিখানো। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি কোথাও কখনো বাপ মা নিয়ে যায়নাই, কখনো তাদের মনে হয়নাই আমি একটা মেয়ে দেখে আমার জন্য আলাদা চিন্তা করতে হবে, আম্মুর ভাষায় সে সারাজীবন একা চলাফেরা করে একা চাকরি বাকরি করসে, আমি কেন পারবোনা। রাস্তায় এত এত অদ্ভুত মানুষের মধ্যে চলতে ফিরতে আমার যে বিন্দুমাত্র ভয় কিংবা ইন্সিকিউরিটি কাজ করেনা, এইটা আমার আম্মুর অবদান।
ছোটবেলা থেকেই যা শিখতে চাইসি সেটাই করতে পারসি। ক্লাস সেভেন-এইটে জাপানী ভাষা শিখতে চাইলাম, আম্মু অনেক খোঁজ খবর করল কোথায় শিখব কিভাবে শিখব। কোথাও স্কুলের বাচ্চাদের শেখায় না। এক জাপানীজ টিচার স্ট্যাম্ফোড ইউনিভার্সিটির লেকচারার, উনার সাথে কথা বলে আম্মু তাকে বুঝাল, আমি কতটা আগ্রহী এটা নিয়ে। উনি আম্মুকে বলল আপনি ভর্তি হয়ে যান, সাথে ওকে নিয়ে আসেন। আম্মু তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এম.এড করে, এত ঝামেলার মধ্যে সে আবার এখানে ভর্তি হল। আম্মুর সাথে আমি প্রচুর আনন্দ নিয়ে নতুন ভাষা শেখা শুরু করলাম, প্রত্যেকটা সেমিস্টার ফাইনালে আমি সেখান থেকে রেকর্ড মারক্স পেয়ে কোর্স শেষ করলাম।
এত ভাল রেজাল্ট করেও এখান থেকে আমার কোনো সাটিফিকেট নাই, এইটা এখনও আম্মুকে দুঃখ দেয়। প্রতিবার পরীক্ষার রেজাল্ট দিত, আমি আম্মুকে বলতাম, দেখো কিভাবে এত ভাল করলাম। আর প্রতিবার আম্মু বলত ‘এটা তো আমি জানতামই ভাল করবা’- এইরকম নানা কাজে আমার শুধু আগ্রহ ছিল, কোনো প্রকার আত্মবিশ্বাস ছিলনা। এত ছোট বয়সে বিভিন্ন কাজে আমাকে বুঝানো যে আমি পারব, এই আত্মবিশ্বাস এখন আমাকে অনেক বেশি সাহায্য করে। আম্মুর মত স্ট্রং একজন মানুষ এখনো হতে পারিনাই। সারাজীবন নানা ঝামেলার মধ্যে থেকেও জীবনে হাতে গোনা দুই একবার তাকে কাঁদতে দেখসি, এই লেভেলে এখনো পৌঁছাতে পারিনাই। মাঝে মাঝে আমি অনেক গভীর কষ্টে থাকি, কান্নাকাটি করি, আম্মু এইসব ‘আবেগশুন্য’ দৃষ্টিতে দেখে, শুনে এবং সবসময়ই সমাধানের চেষ্টা করে, কখনোই বলেনা যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
এই ধরনের ফ্যালাসি কথা বার্তা না বলে সোজা সাপ্টা মুখের উপর কথা বলার জন্য আম্মুর প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। এরকম সাহসী মানুষের মেয়ে হিসেবে আমি কিভাবে এত ভেজিটেবল হলাম, এই তত্ত্ব আমি আজও বুঝিনা। এবং কোন ভাগ্যে এত অসাধারন একজন আমার মা হন, আমি তাও বুঝিনা। শুভ জন্মদিন আম্মু। তুমি আরো যুগ যুগ বেঁচে থাকো। কোনো একদিন আমি আমার সব হাবিজাবি লেখা নিয়ে একটা বই বের করব, এবং তুমি সেটার প্রুফরিড করবা, ছোট বেলার মত লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে দিবা কোথায় বানান ভুল হইসে, কোথায় লেখা বুঝা যায়না।
লেখকঃ-
ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন
গোবিন্দগঞ্জে নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের সংবর্ধনা
বোরহানউদ্দিনে সামাজিক জবাবদিহিতা চর্চা বিষয়ক প্রশিক্ষণ
হতদরিদ্র পরিবারের পাশে “অনামিকা আজম ফাউন্ডেশন”