হোম » Uncategorized » মানব কল্যানে মানুষের নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিক মূল্যবোধ জরুরী

মানব কল্যানে মানুষের নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও মানবিক মূল্যবোধ জরুরী

ড. এমদাদুল হক: পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই কোন না কোন ধর্মে বিশ্বাসী ।মানব জীবনের অনেক নৈতিকতা বোধই ধর্ম থেকে উৎসারিত। এই নৈতিকতার মূল লক্ষ্য হলো সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা আনয়ন।পৃথিবীর তাবৎ ধর্মগ্রন্থই নীতিকথায় ভরপুর। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে ধর্মীয় অনুশাসন মানব মনে নৈতিকতাবোধ উজ্জীবনে কতোটুকু ভূমিকা রাখতে পারছে? পাশ্চাত্য সমাজে ধর্মীয় অনুশাসন কার্য্যত অনুপস্থিত এবং গড়পড়তা ব্যক্তি মানসে ধর্মীয় চেতনাও ম্রিয়মান। সেখানকার সমাজ জীবন আবর্তিত হচ্ছে ইহজাগতিকতাকে কেন্দ্র করে। তবে, তাদের সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নিষ্ঠা, পরমত সহিষ্ণুতা, মানবিকতা, মানব কল্যানধর্মী কর্মকান্ড সত্যিকার আধুনিক শান্তিময় সমাজ গঠনে অনন্য ভূমিকা রাখছে ।

বিশ্বের নানা প্রান্তে নির্যাতিত নানা ধর্মের ও বর্ণের মানুষের পাশে ধর্মীয় লেবাসধারী মানুষের চেয়ে ধর্মীয় লেবাসবিহীন মানুষের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি । প্রাচ্যে, যেখানে ধর্ম দৃশ্যমানভাবে এখনো সমাজের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে আসছে, সেখানে কি মানুষের মাঝে সার্বজনীন নৈতিকতাবোধ প্রবলভাবে বিদ্ধমান? মুসলমান প্রধান দেশগুলোতে আলোকপাত করলে এ বিষয়ে আশান্বিত হওয়ার কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলো ধর্মীয় রীতিনীতির চর্চা প্রবল কিন্তু সেসব দেশগুলোতে নারীদের প্রতি বিশেষ করে নারী গৃহপরিচারিকাদের প্রতি যে অমানবিক ও নিবর্তনমূলক আচরণের ভয়াবহ চিত্র প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায় তা দেখে-পড়ে মনে হয় না সেসব দেশের মানুষের ধর্মীয় চর্চা নৈতিকতা ও মানবিকতা গঠনে ভূমিকা রাখে ।

শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয় পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যেও নৈতিক অবক্ষয় প্রবলভাবে প্রতীয়মান । প্রায়ই পত্রিকায় দেখা যায় ধর্মীয় শিক্ষালয়ে সংঘটিত নানা ধরনের অনৈতিক কর্মকান্ডের খবর। যা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্খিত । সেখানে কি ধর্মের মূলবাণী নৈতিকতার শিক্ষা দেয়া হয় না ? মুসলিম প্রধান দেশগুলোতে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কমতি নেই এমনকি নামাজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত তথা ইসলাম নির্দেশিত অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও ব্যাপকহারে বাড়ছে । কিন্তু ধর্মে বর্ণিত নীতিকথার আবেদন মানুষের মধ্যে ক্রমেই যেন কেতাবের মধ্যেই বন্দি হয়ে পড়ছে ।

মানুষের জীবনে ধর্মীয় নীতি নৈতিকতার প্রভাব ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে । গত কয়েক দশকে মানুষের মধ্যে প্রবলভাবে বেড়েছে ধর্মাচার । মানুষ এখন ব্যাপকহারে লোক দেখানো ধর্ম কর্মে লিপ্ত । বাংলাদেশের পাড়া মহল্লায় এবং শহর বা নগরের অলিতে -গলিতে মাদ্রাসা, মসজিদ গড়ে উঠেছে । শিশুরা ব্যাপকহারে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করছে । অসংখ্য মসজিদ গড়ে উঠার পরও জুম্মার দিন মসজিদে জায়গা পাওয়া যায় না । দুই তিন দশক আগের চেয়ে এখন দেশের মানুষ অনেক বেশি চর্চায় ও বেশভূষায় ধার্মিক । বাংলাদেশে নামাজি এবং রোযাদারের সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। দেশের ব্যাপক সংখ্যক মানুষ হাজি বা আলহাজ্ব টাইটেলধারী । দেশের অধিকাংশ মুসলমান ব্যবসায়ী হজ্জ্বব্রত পালন করে মাথায় সার্বক্ষণিক টুপি পড়ে জেনে-শুনে-বুঝে ভেজাল পণ্য বা লোক ঠকানোর অসৎ ব্যবসায় নিজেদের নিয়োজিত রাখছে ।

এটা শুধু মুসলমানরা করছে তা নয় । অন্যান্য ধর্ম বিশ্বাসী ব্যবসায়ীরাও একই কাজ করছে । এখন, বাংলাদেশের সরকারী বেসরকারী অফিস আদালতেও রেকর্ড সংখ্যক বেশভূষার ধার্মিকের আনাগোনা । কিন্তু কোথাও ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার উপস্থিতি তেমন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না । রাজনীতিতেও বইছে একই হাওয়া । দেশের রাজনীতিবিদ এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের চেয়ারম্যান-মেম্বাররাও নিজেদেরকে সমাজের কাছে বিশেষভাবে উপস্থাপন করার জন্য হাজী বা আলহাজ হওয়ার চেষ্টায় ব্রত । লোক দেখানো ধর্মাচার বাড়লেও ক্রমেই সমাজ থেকে উদাও হয়ে যাচ্ছে সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধ নামক বিষয়গুলো । এছাড়া,গোঁড়া ধর্মবিশ্বাস ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানুষে মানুষে হানাহানি, হত্যা, বিদ্বেষ,ঘৃণা,বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা,অমানবিকতার জন্ম দিচ্ছে ।

ক্রমেই ধর্মীয় আচার আচরণের বিষয়গুলো সমাজে নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে  তবে, ধর্ম কি এখন মানুষকে নৈতিকতার শিক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে ? ধর্মে বর্ণিত ইহকালের ভাল বা মন্দ কাজের ফলাফল মৃত্যুর পরের জীবনে শাস্তি বা পুরস্কারের কথা কি মানুষ আমলে নিচ্ছে না?

পরকালের শাস্তি বা স্রষ্টার ভয় দেখিয়েও মানুষজনকে অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে বিরত রাখা যাচ্ছে না । নৈতিকতা বিরোধী কার্য্যক্রম, যেগুলো ধর্মে নিষিদ্ধ তা তো ধর্মবিশ্বাসীরা করতে পারে না। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ উল্টো। ঘুষ, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অনাচারে আজ আমাদের সমাজ রন্ধ্রে রন্ধ্রে জর্জরিত। হাতে গোনা দুচারজন বাদে খোদ রাষ্ট্রযন্ত্রের ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে সমাজের অপরাপর ক্ষমতাবান ব্যক্তিবর্গ নিজ নিজ বৈষয়িক অবস্থা উত্তরণে নৈতিকতা বিরোধী কাজ করছে অবলীলাক্রমে। অথচ, সকলেই চলনে-বলনে ধর্মীয় বাণী কবচাচ্ছে অবিরত ।

মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সর্বত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালনকারীদের সংখ্যা বাড়লেও ধর্ম তার মূল উদ্দেশ্য, মানব মনে নৈতিকতাবোধ স্থাপনে যেন ব্যর্থ। বর্তমান সময়ে সংখ্যাগুরু মুসলমান সচেতন মনে বিশ্বাসী হলেও এদের অবচেতন মনে ধর্মবিশ্বাস ততোটা প্রবল নয়। বিশেষ করে, ধর্মবিশ্বাসের মূল চালিকা শক্তি পরলোকে শাস্তির ভীতি কিংবা পুরস্কারের প্রলোভন মানুষের অবচেতন মনে আগের মতোন ক্রিয়াশীল নয়। সচেতন মনের প্রভাবে মানুষ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে উৎসাহী হলেও ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে মানব মনে নৈতিকতা বোধ জাগ্রত হচ্ছে না। সত্যিকার অর্থেই ধর্ম হয়ে পড়ছে আচার সর্বস্ব ।

শুধুমাত্র পারলৌকিক শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা বলে সমাজ নিয়ন্ত্রণ আজকের যুগে প্রায় অসম্ভব । ইহজাগতিক শাস্তি বা পুরস্কারের বিধানই সমাজ নিয়ন্ত্রনের মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে ।

ধর্ম এখন বিশ্বের দেশে দেশে শাসন-শোষণ ও দুবৃত্তায়নের রাজনীতি অব্যর্থ হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে । ধর্মের যাঁতাকলে উদারতা, মানবতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও ন্যায়বিচার নিষ্পেষিত । চীন, ভারত, বার্মা, লেবাননসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে অন্য ধর্মের বিশ্বাসীদের দ্বারা মুসলমানরা নির্যাতিত হচ্ছে । আবার, উগ্র ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানদের দ্বারা অন্য সম্প্রদায়ের মুসলমানরা (শিয়া-সুন্নী-অন্যান্য) আক্রান্ত হচ্ছে । আবার খ্রীস্টান, ইহুদী, হিন্দু, বৌদ্ধরাও আক্রান্ত হচ্ছে অন্য ধর্মালম্বীদের দ্বারা । এসবই চলছে সুচতুর রাজনৈতিক খেলার অংশ হিসেবে ।

ধর্ম লৌকিকতা বা আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে মানব কল্যানে মানুষের নৈতিকতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, পরমত সহিষ্ণুতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিকাশে ভূমিকা রাখবে সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করছি ।

error: Content is protected !!