হোম » Uncategorized » “তালুকদারের ইন্টারভিউ” (অনু গল্প)

“তালুকদারের ইন্টারভিউ” (অনু গল্প)

শেখ হান্নান: ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ শেষে বীরেরবেশে ফিরে এসেছে মুক্তিযোদ্ধাগণ। সিরাজগঞ্জ সদরের ছোনগাছা ইউনিয়নের যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রাম ইটালি। পাকিস্তানি মিলিটারি আর দেশীয় আল-বদর রাজাকার ইটালি গ্রামটিকে পুড়ে ছারখার করে দিয়েছে। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এ গ্রামের মানুষের মুখে হাসি নেই। যার সাথে দেখা হয় তারই অশ্রুসিক্ত নয়ন, বিধ্বস্ত চেহারা। পোড়া ভিটেবাড়ি আর স্বজন হারানো বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে গ্রামের প্রতিটি মানুষ। মনে হয় এ গ্রামের মানুষ হাসতে ভুলেগেছে। প্রতিটি বাড়ির ঘরপোড়া ছাইয়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে অর্ধপোড়া খুটির অংশ।এটি তালুকদার বাড়ি।

রাজাকাররা এই বাড়ি এমন ভাব পুড়িয়েছে যে এখানে ঘরদোর ছিলো তা বুঝবার উপায় নেই। পশ্চিম দিকে ফলদার আমকাঁঠালের পোড়া হাড্ডিসার কাঠফাটা কয়লার আস্তরে মোড়া ক্ষতচিহ্ন নিয়ে গাছগুলো বোবা হয়ে কাতরতার বিলাপ ছড়াচ্ছে। হায় তালুকদার বাড়ি! হায় মুক্তিযুদ্ধ! এই বাড়ির গর্বিত সন্তান আকবর তালুকদার।

আকবর তালুকদারের পিতার জমিজমা কম ছিলো না। কিন্তু বন‍্যায় ওয়াপদা বাঁধ ভেঙ্গে যমুনার পানির সাথে বালি পড়ে ফসলিজমিগুলো অফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে। তাই তালুকদারের সেই তালুকদারী আর নেই। অভাব এখন নিত‍্য সঙ্গী।

দেশ স্বাধীন হলো। মনে হলো এখন আর যাই হোক মানুষের অন্ন কষ্ট থাকবে না। কিন্তু হঠাৎ করে দেশের খাদ‍্যের দূর্ভিক্ষে ধনী গরীব কে এক কাতারে নিয়ে এলো। দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, সামাজিক দাপট এমন এক শ্রেণির মানুষের হাতে গেলো যে মুক্তিযোদ্ধা আর তালুকদার সব হিসেবের বাইরে পড়েগেলো। মুক্তিযোদ্ধা হওয়া সত্বেও কিছু অসাধু মানুষের অপচেষ্টা যুদ্ধবিজয়ী গাজী আকবর তালুকদার ছিটকে পড়েগেলো বৃত্তের বাইরে।

আকবর তালুকদার ছয়ফুট দীর্ঘাঙ্গী চৌকস যুবক। তালুকদার বংশীয় ছেলে।তার আচার ব‍্যবহার কথায় কর্মে তালুকদারী স্বভাব স্পষ্টত। তার মতো সাদা মনের যুবক ছোনগাছাতে বিরল। বাবা মা ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে বড় অনিশ্চয়তার মধ‍্যে পড়ে হাবুডুবু খেতে লাগলো আকবর। কর্মসংস্থানের ব‍্যবস্থা না করতে পারলে পুরো পরিবারকে অনাহার মরতে হবে। আকবরের বাবা মার ইচ্ছা আকবরকে লেখাপড়া শিখাবে। কিন্তু দেশের যে অবস্থা, তাতে কিসের লেখাপড়া আগে জীবন বাঁচাও।

অভাব আর আকাল এক সাথে হাতধরা ধরি করে এসেছে। দেশের জন‍্য যুদ্ধ করেছে ঠিক আছে। তাতে কি? পরিবারের এমন দূর্দিনে কিছু না করতে পারাটা ব‍্যর্থতার সামিল। বিছানায় শুইয়ে, মাঠের কোণে বসে, নদীর ধারে বসে আকবর কতকিছু ভেবেছে। সেই ভাবনার কুলকিনারা পায়নি। ৭৩ গেলো ৭৪ গেলো। ১৯৭৫ সাল। না! বসে থেকে লাভ নেই। একটা কিছু করতেই হবে। এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে বাবা মাকে না জানিয়ে আকবর তালুকদার কত জায়গায়, কত অফিসে ইন্টারভিউ দিয়েছে চাকরি হয়নি।

মনের দুঃখ আর সংসারের দায়িত্বকে বড় বোঝা মনে হলো আকবরের। পিতা মাতা ভাইবোনদের কষ্ট সহ‍্য করতে না পেরে কাউকে কিছু না বলে একদিন দুপুর বেলা সিরাজগঞ্জ বাহিরগোলা স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পরলো আকবর। ট্রেন থেকে নেমে ইস্টীমার। ইস্টীমার থেকে আবার ট্রেনে। টিটিইর চোখ ফাঁকি দিয়ে বিনা টিকিটে সরাসরি ঢাকায়। দুর সম্পর্কীয় এক আত্মীয়র কাছ থেকে জানতে পারলো বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সে সিকিউরিটি এ‍্যাসিসট‍্যান পদে লোক নিয়োগ হবে।

আকবর তালুকদার এখন মতিঝিল বিমান বাংলাদেশ এয়ার লাইন্সের বোর্ডের সামনে বসা। ইন্টারভিউ বোর্ডের একজন জিজ্ঞেস করলো-
-আপনি আকবর?
-জ্বীনা স‍্যার! আমি আকবর হোসেন
তালুকদার। বোর্ডের আরেক সদস‍্য জিজ্ঞেস করলো-
-আপনার বাড়ি কোথায়?
-বাড়ি স‍্যার ইটালি। মানে সিরাজগঞ্জ
জেলার ইটালি গ্রামে।

আকবর স্বভাবসিদ্ধ ভাবে, সিরাজগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় প্রশ্নের উত্তর দেয়াতে বোর্ডের সদস‍্যগণ একে অপরে প্রার্থী সম্পর্কে ইংরেজিতে কথা বলছেন। মুখটিপে মিষ্টি মিষ্টি হাসছেন। আরেকজন জিজ্ঞেস করলেন-
-আচ্ছা বলুনতো ইতালির রাজধানীর
নাম কী? এমন সহজ প্রশ্ন করার সাথে সাথে প্রাণবন্ত হ্নদয়কারা হাসি দিয়ে আকবর উত্তর দিলো-স‍্যার ইটালির রাজধানীর নাম সিরাজগঞ্জ। আকবরের এমন গোজামিলের উত্তর শুনে ইন্টারভিউ বোর্ডের সবাই হো-হো করে হাসতে লাগলো। সদস‍্যদের অট্টহাসিতে আকবর আরো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলতে লাগলো-
-স‍্যার হাসিয়েন না স‍্যার হাসিয়েন না।
যা কৈতিয়াছি সত‍্য কৈতিয়াছি স‍্যার।
স‍্যার ঢাকা যদি সিরাজগঞ্জের রাজ
ধানী হয়, তাইলে আমার গ্রাম
ইটালির রাজধানী সিরাজগঞ্জ
হইবো না ক‍্যান স‍্যার। ইটালির
রাজধানী সিরাজগঞ্জই স‍্যার। আমি
জানি স‍্যার ইতালির রাজধানীর নাম
রোম। কিন্তু আমার গ্রামের নাম
ই -টা -লি। এই ইটালি আর আপনের
ইতালি এক না স‍্যার। উচ্চারণ এক
হইলেও বানানে পার্থক্য আছে।

আকবরের এমন কথায় বোর্ডে সবাই আবারও উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে এক সদস‍্য আরেক সদস‍্যের গায়ের উপর ঢলে পড়ছিলো। বোর্ডের একজন সদস‍্য ছিলেন বিমানের ডিএমডি এম এ রউফ। তিনি মুচকি হাসিতে নির্লুপ্ত ছিলেন। হাসি থামিয়ে তাকে অন‍্য দুই সদস‍্য বললেন-
-স‍্যার প্রার্থী আপনার জেলার। ওকে
আপনি চাকরি না দিলেও আমার
তাকে সিলেক্ট করলাম। আপনি
আপত্তি করতে পারবেন না।
আমাদের এরকম প্রাণমন খোলা
সাদা মনের প্রার্থীই চাই। এমন রস
বোধের মানুষ পাওয়া ভার। তাছাড়া
সেতো একজন সৌভাগ্যবান মুক্তি
যোদ্ধা। মৃত্যুর ভয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধে
যাইনি। আমাদের বাবা মা আমাদের
মুক্তিযুদ্ধে যেতে দেয়নি। আকবর তালুকদারের দিকে স্মিতহাস‍্যে একজন সদস‍্য
উঠে গিয়ে আলিঙ্গন করে বললো-
-স‍্যেলুট আপনাকে। আপনি আপনার
গ্রামকে ভুলে জাননি, ভুলে জাননি
ভাষার মহত্ব আঞ্চলিক ভাষা।
আপনি জাতির শ্রেষ্ট সন্তান, আপনি
সিলেক্টটেড।

শেখ হান্নান
নাট‍্যকার লেখক।
আজিমপুর, লালবাগ,
ঢাকা-১২০৫.
২১ মে, রবিবার, ২০২২খ্রিঃ।

error: Content is protected !!