হোম » Uncategorized » মজিদ মাহমুদ : এক অনন্য সাহিত্য-স্রষ্টা

মজিদ মাহমুদ : এক অনন্য সাহিত্য-স্রষ্টা

আওয়াজ অনলাইন : “মজিদ মাহমুদ : এক অনন্য সাহিত্য স্রষ্টা” এমন কথাই বললেন সিরাজগন্ঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার শাহজাদপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ আব্দুর রউফ। সাহিত্য মননে এক অনবদ্য ব্যক্তিত্ব মজিদ মাহমুদ। কবি মাজিদ মাহমুদকে নিয়ে ড. মোহাম্মাদ আব্দুর রউফের লেখা …..

এক
কবিগুরু কবিকে তার জীবনচরিতে খুঁজতে নিষেধ করেছিলেন। তাই বলে কি আমরা কবির ব্যক্তি জীবনের দিকে তাকাবো না? তাহলে চরিত সাহিত্য কী করে তৈরি হবে? আমার তো মনে হয় সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্বের সৃষ্টিকর্ম ঠিকঠাক বুঝতে চাইলে তার ব্যক্তিজীবনটাও জানা জরুরি অন্তত খানিকটা। এবং সৃষ্টিকর্মের সাথে সাথে তার ব্যক্তিজীবনও আমাদেরকে কিন্তু কম আকর্ষণ করে না।

যে সব লেখা আমাদেরকে আনন্দ দেয়, আমাদেরকে পথ দেখিয়ে দেয়, তার স্রষ্টা কি আমাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ? মোটেই না। আজকের এই ছোট্ট লেখা মূলত কবি মজিদ মাহমুদকে নিয়ে। মজিদ মাহমুদকে দেখছি কমবেশি একযুগ ধরে। কিছুটা বিষ্ময়ই জাগে।

প্রায় সময়ই তাকে গল্প করতে দেখি, আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে দেখি। অথচ ফি বছরই দুই-তিনটা করে বই প্রকাশ হতে দেখি। তাহলে তিনি কখন পড়েন? কখন লেখেন? আর কখনইবা সম্পাদনা করেন? তার বই যেমন গুরুত্বপূর্ণ তার আড্ডাও কিন্তু কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমনকি কখনো কখনো একটি ছোট্ট আড্ডা সহস্র পৃষ্ঠার পাঠকে অতিক্রম করে যায়। সেই আড্ডা যে সব সময় বৈঠকী আড্ডা তাও কিন্তু নয়। কোথাও দাঁড়িয়ে কিংবা হাঁটতে হাঁটতেও হয়ে যায়।

দুই
কবি বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) নাকি আড্ডা থেকে অনেক কিছু শিখেছিলেন। অন্তত ‘আড্ডা’ নামক নিবন্ধে তিনি এমনটিই জানিয়েছিলেন। মজিদ মাহমুদের আড্ডা কিন্তু এমনই। অন্তত আমাদের মতো ঊনজনদের জন্য। সর্বশেষ পাবনায় (চরগড়গড়ি) মহিয়সী সাহিত্য উৎসবের (২০২৪) কথাই বলি।

ভেতরে একটি সেমিনার চলছে। কবি-সাহিত্যিকরা কথা বলছে। আমরা বেশ কয়েকজন বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। সাহিত্যসহ সমসাময়িক সময়, সমাজ, রাজনীতি নিয়ে বৈঠকী মেজাজে টুকটাক আলাপ হচ্ছে। সেই আলাপের মধ্যমণি মজিদ মাহমুদ। আমরা কিছুটা প্রশ্নের সুরে আলাপ উত্থাপন করছি। আর মজিদ মাহমুদ সেই আলাপকে আরও গভীর করে তুলছেন।

কেউ একজন বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গে কথা তুলতেই মজিদ মাহমুদ মুহূর্তেই সেই আলাপে যুক্ত হলেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে। মজিদ মাহমুদ এভাবেই সেদিন শুরু করেছিলেনÑরাম এসে গেছে আমরা রাবণকে কোথায় রাখব? মধুসূদনকে কোথায় রাখব? সাথে সাথে মধুসূদনের জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, আধুনিকতা, তার মানবিকতার নানা ব্যাখ্যা, নানা বিশ্লেষণ উত্থাপন করলেন।

সেই সঙ্গে রাম-রাবণের যুদ্ধের একটি অন্যতম কারণ যে নারীর দিকে হাত বাড়ানো-সেটিও দেখিয়ে দিলেন। এরপর সীতা থেকে শুরু করে মজিদ মাহমুদ মুহূর্তের মধ্যে দ্রোপদী, হেলেনসহ বেশকিছু নারী প্রসঙ্গ উল্লেখপূর্বক রামায়ণ-মহাভারত, ইলিয়াড-ওডেসিসহ প্রাচ্য ও প্রাশ্চাত্ত্য জগতের ক্লাসিক সাহিত্যের নানা গলিঘুঁজি আমাদের কাছে বেশ স্পষ্ট করে তুললেন। তখন আমার বুদ্ধদেব বসুর কথাটি মনে পড়ে গেল। এই কবি যে আড্ডা থেকে অনেক কিছু শেখার কথা বলেছিলেন সেটি একেবারে মিথ্যে নয়। তবে সেই আড্ডা হতে হবে মজিদ মাহমুদের মতো সাহিত্যের অফিসারের সঙ্গে।

তিন
অনেক সময় বাছুর কবিদের বেশ গুতোগুতি করতে দেখা যায়। দুএকটি কবিতার বই লিখে এদের কেউকেউ প্রবীণকে অস্বীকার করতে চায়। আবার প্রবীণরাও মৌখিকভাবে নবীনদের টুকটাক প্রশংসা করলেও এদের লেখালেখি নিয়ে লিখিতভাবে কিছু বলতে চান না।

এক্ষেত্রে মজিদ মাহমুদ কিন্তু অনেকটাই ব্যতিক্রম বলা যায়। প্রবল ব্যক্তিত্বের বদান্যতায় উত্তমের মতো তিনি প্রায় সবার সঙ্গে নিশ্চিন্তে মিশতে পারেন। কাউকে দূরে ঠেলে দেন না। রবীন্দ্র-নজরুল কিংবা জীবনানন্দ দাসের মতো প্রবীণ কবিদের কাব্যকর্মের আলোচনা যেমন মজিদ মাহমুদের প্রবন্ধসাহিত্য শোভা বর্ধন করে, তেমনই আজকের নব্বই দশকের নবীন কবিদের কবিতাকর্মও তার আলোচনায় ঠাঁই পায়। অর্থাৎ যাপিত জীবনে সমন্বয়ের কাজটি কিন্তু বলা যায় তার প্রায় স্বভাবজাত। কাউকে তিনি ছোট মনে করেন না।

আবার কাউকে বড়ও মনে করেন না। ছোট ছোট পুরস্কারের প্রতি তার অবহেলা নেই। বড় বড় পুরস্কারের প্রতি তার বাসনা নেই। অন্তত ‘ক্ষণচিন্তা’ প্রবন্ধগ্রন্থের ‘পুরস্কার’ নিবন্ধটি তো তা-ই বলে। নিবন্ধ হলেও এটিকে আবার কবিতা হিশেবেও পাঠ করা যায়। যা হোক, সমসাময়িক সাহিত্য ও স্বদেশ-বাস্তবতা কবিকে যে একেবারে স্পর্শ করে না-এমনটিও কিন্তু নয়। বলা যায় ‘নিদারুণ মাস ফেব্রæয়ারি’ কবিতাটি তারই নিদারুণ দৃষ্টান্ত।

চার
ব্যক্তির পাশাপাশি মজিদ মাহমুদের সাহিত্যকর্মও কি কম বিষ্ময়ের? মাত্র বাইশ-তেইশ বছর বয়সে ‘মাহফুজামঙ্গল’ (১৯৮৯) হাতে নিয়ে তিনি পাঠকের সামনে হাজির হয়েছিলেন। এই সময়ে, এই বয়সে, এই একবিংশ শতাব্দীর ঊষালগ্নে যখন উত্তরাধুনিক সাহিত্য নিয়ে বিপুল মাতামাতি, তখন এমন একটি কাব্যশৈলী কিংবা এমন একটি নামকরণ কি কম সাহসের কথা? ‘মাহফুজামঙ্গল’ এর মধ্য দিয়ে কাব্যপাড়ায় তিনি একটি নতুন আলো ও আলোড়ন তুলতে পেরেছিলেন, কাব্যপাঠককে তিনি চমকে দিতে পেরেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, মোর্নিং শোজ দ্যা ডে। মজিদ মাহমুদও কিন্তু ঠিক তেমনই।

শুরুতেই তার সাহিত্যিক শক্তি ও সামর্থ্যরে পরিচয় সেদিন তিনি তুলে ধরতে পেরেছিলেন। কবিতা দিয়ে শুরু হলেও গল্প, গদ্যপদ্য, প্রবন্ধনিবন্ধ, উপন্যাসসহ সাহিত্যের নানা দিকে, নানা শাখায় ইকারুসের ন্যায় তার উড়ে চলা। সেই উড়ে চলায় একদিকে যেমন আছে নিজস্ব ছন্দ-আনন্দ; তেমনই আছে প্রবল বোধ ও ব্যক্তিত্ব।

পাঁচ
মজিদ মাহমুদ এক অনন্য সাহিত্য-স্্রষ্টা বিশেষ করে প্রবন্ধসাহিত্যে। প্রবন্ধসাহিত্যে এ দেশের সৃষ্টিশীল কবিরা কিন্তু খুব একটা সময় দেননি কিংবা দিতে পারেননি। আল মাহমুদ (১৯৩৬-২০১৯) কিংবা শামসুর রাহমানের (১৯২৩-২০০৬) মতো বড় বড় কবিদের বড়ত্ব তাদের কবিতায় এবং কথাসাহিত্যে। কিন্তু প্রবন্ধসাহিত্যে তাদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান আছে কি? আল মাহমুদের রচনাবলি (ঐতিহ্য) তন্ন তন্ন করে খুঁজলে প্রবন্ধসাহিত্য খুব সামান্যই মেলে। এই কবির কবিতা ও কথাসাহিত্য চম্বুকের মতো আকর্ষণ করলেও প্রবন্ধসাহিত্য কিন্তু অনেকটাই উল্টো বলা যায়। অন্তত আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা তো তা-ই বলে। শামসুর রাহমানের ক্ষেত্রেও অনেকটা তা-ই। সত্যি বলতে কি, এই কবির ‘একান্ত ভাবনা’ বইটির পাঠ ধরে রাখতে পারিনি। অন্যদিকে মজিদ মাহমুদের প্রবন্ধ-সাহিত্য কিন্তু বাস্তবিকই খানিকটা বিষ্ময় জাগায়। কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ-সাহিত্যের বিপুল ভাÐার গড়ে তুলছেন তিনি। বিষয়বৈচিত্র্য, তার গতি ও গভীরতা নানা দিক থেকে এক বিপুল প্রবন্ধ সাহিত্যের স্্রষ্টা তিনি। ব্যাপ্তি ও ব্যাপকতার দিক থেকে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪) কিংবা শঙ্খঘোষ (১৯৩২-২০২১) পরবর্তী আর কোনো কবির হাতে কি এতো প্রবন্ধসাহিত্য রচিত হয়েছে? আর উপন্যাস? সেখানেও কি মজিদ মাহমুদ কম যান? ‘মেমোরিয়াল ক্লাব’ (২০২০) সাম্প্রতিক সময়ের প্রকাশনা হলেও এটি রচনাকালের ব্যাপ্তি দুদশকেরও বেশি। ‘দুদশকের বেশি’ বলতে এটি বোঝায় না যে তিনি এতো লম্বা সময় ধরে এটি লিখেছেন। বরং ভাবনার কালটিকেই ইঙ্গিত করে। আনন্দের খবর, গ্রন্থটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিতও হচ্ছে এবং এটি প্রকাশের জন্য অ্যামাজানের পথে রয়েছে। নজরুল-জীবনভিত্তিক উপন্যাস ‘তুমি শুনিতে চেয়ো না’ (২০২৪) কি কম সাড়া ফেলেছে? এরপর এবারের ঈদ সংখ্যায় (ভোরের কাগজ) ‘উনুন’ (২০২৪) এসছে। আচ্ছা, এই যে কবিতা, এই যে কথাসাহিত্য কিংবা প্রবন্ধ সাহিত্যÑ সাহিত্যের কোনো একটি শাখায় কি তাকে অস্বীকার করা যায়? সাহিত্য ছাড়া সংগঠক হিশেবেও মজিদ মাহমুদের তুল্য ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সাহিত্য কি খুব একটা আছে?

ছয়
নদী যেমন বন্ধুর গিরিপথ অতিক্রম করে সাগরে মিলতে চায়, বটবৃক্ষ যেমন ক্রংক্রিটের মধ্য দিয়ে সযতেœ তার শিকড় সম্প্রসারিত করে দেয়, একজন কবিও তা-ই করেন। একজন মজিদ মাহমুদও তা-ই করেন। তিনিও সাহিত্যের মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জনজীবনের সঙ্গে মিলতে চান; তার সময়, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ধরে রাখতে চান। ১৬ এপ্রিল এই কবি পাবনা জেলায় পদ্মার পাড় ঘেষে গড়ে ওঠা চরগড়গড়ি গ্রামে এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারে জন্মেছিলেন। স্বকাল, স্বসমাজ ও অভিজ্ঞতার ছোঁয়ায় তার সাহিত্যসাধনা সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুকÑজন্মদিনে এই কামনা।

ড. মোহাম্মদ আব্দুর রউফ
সহকারী অধ্যাপক
বাংলা বিভাগ
শাহজাদপুর সরকারি কলেজ
শাহজাদপুর, সিরাজগঞ্জ।

error: Content is protected !!