হোম » অন্যান্য বিভাগ » বাঘায় কৃষকের ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব পালিত

বাঘায় কৃষকের ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব পালিত

আবুল হাশেম, রাজশাহী বিভাগীয় প্রতিনিধি : বৃহস্পতিবার অগ্রহায়ণের প্রথম দিবস। কার্তিকের পোয়াতি ধান পেকে উঠতে শুরু করেছে এর আগেই। কাঁচা সবুজ ধানের দানায় দানায় জমে থাকা সাদা ‍দুধ এখন শুভ্র চালে রূপ পেয়েছে। কুয়াশাভেজা মাঠ থেকে সবুজ থেকে সোনালি হয়ে ওঠা সেই পাকা ধান কেটে আনার তোড়জোড় চলছে গ্রামে গ্রামে। গৃহস্থ বাড়ির উঠানে এই ধান মাড়াই-মলন শেষে নতুন চালের ভাত আর পিঠা-পুলি-পায়েসে জনপদ থেকে জনপদে হবে নবান্ন।
রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় বৃহস্পতিবার (১৬  নভেম্বর) হাবাসপুর মাঠে কৃষকের সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তাদের ধান কাটা ও নানা রকম পিঠা খাওয়ার মধ্য দিয়ে পালিত হয়েছে নবান্ন উৎসব।
 সকাল ১১টায় বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে উপজেলার মনিগ্রাম ইউনিয়নের হাবাসপুর মাঠে এই নবান্ন উৎসব পালিত হয়। সেখানে এলাকার কৃষকদের সঙ্গে ধান কাটায় অংশ নেন বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আখতার, বাঘা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লা সুলতান, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) জুয়েল আহাম্মেদসহ অনেকে। ধান কাটা শেষে হরেক রকম পিঠা খাওয়াসহ এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
নবান্নের শব্দগত অর্থ ‘নতুন অন্ন’, অর্থাৎ নতুন খাবার। গ্রামবাংলার উৎসবের বর্ষপঞ্জির শুরুটা হয় এই নবান্ন দিয়েই। আর সমাপ্তি ঘটে চৈত্রসংক্রান্তির চড়কে। নবান্নকে মূলত কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন এবং আগামী বছরের জন্য সুফসল প্রাপ্তির কামনায় নিবেদিত উৎসব হিসেবে অভিহিত করে থাকেন লোক সংস্কৃতি গবেষকরা।
 উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আখতার বলেন ,হেমন্ত ঋতু আমাদের চতুর্থ ঋতু। কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে এ ঋতু। অর্থাৎ এর আগে গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শরৎ গেছে। আর সামনে আছে শীত ও বসন্ত। বলা যায় হেমন্ত আসে শীত আসার খবর নিয়ে। আর যারা গ্রামে থাকেন তারা নিশ্চই এরই মধ্যে শীতের আমেজ পাচ্ছেন? অবশ্য নগরে যারা থাকেন তারা হয়তো শীতের আমেজটা এখনো টের পাননি। শীতের আমেজের পাশাপাশি গ্রামে হেমন্ত ঋতুতে আরও অনেক দৃশ্য চোখে পড়ে। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসে। আর সেটি হলো মাঠজুড়ে হলুদ রঙা পাকা ধান, ধান কাটায় ব্যস্ত কৃষক, গোলায় ধান তোলা, বাড়ির উঠানে ধান সিদ্ধ করা-ইত্যাদি।
হেমন্ত ঋতুর পহেলা মাস কার্তিক। আর কার্তিকের শুরু থেকে ধান পাকতে শুরু করে। হলুদ রঙা এ পাকা ধান দেখে খুশি হন কৃষক। এরপর কৃষক সে ধান কেটে গোলায় তোলেন। রেখে দেন বারো মাস খাওয়ার জন্য। নতুন এ ধান গোলায় তোলা উপলক্ষ্যে কৃষকের পরিবারে উৎসবের সৃষ্টি হয়। খাওয়া হয় নতুন ধানের ভাত। তৈরি হয় পিঠা-পায়েস। খাওয়ার পাশাপাশি কৃষকরা সবাই মিলে আনন্দও করেন। নতুন ধান তোলার এ আনন্দের নামই নবান্ন উৎসব। অগ্রহায়ণ মাসে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এ উৎসব হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকেই।
বাঘা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিউল্লাহ সুলতান বলেন, হেমন্ত ঋতু শীতের পূর্বাভাস হলেও আমাদের কৃষকের কাছে এ ঋতুর বেশি গুরুত্ব ফসল ঘরে তোলার মৌসুম হিসাবে। সে জন্য অগ্রহায়ণ ধান কাটার পুরোপুরি মৌসুম হলেও কার্তিকের শুরু থেকেই গ্রামের মাঠে মাঠে ধান কাটার দৃশ্য চোখে পড়ে। অন্যদিকে কার্তিক কৃষকের কাছে মঙ্গার মাস হিসাবেও পরিচিত। কারণ দীর্ঘ ৪-৫ মাস অপেক্ষার পর কৃষক অগ্রহায়ণে তার গোলায় তোলেন দীর্ঘ পরিশ্রমের সোনালি ফসল। তাই কৃষকের কাছে কার্তিকের মঙ্গা দূর হয় অগ্রহায়ণের আগমনে। শুধু মঙ্গা দূর নয়, অগ্রহায়ণ মানেই কৃষকের আনন্দ। কৃষকের শস্যোৎসব। কৃষকের এ শস্যোৎসবই আমাদের কাছে নবান্ন উৎসব নামে পরিচিত। আসলে নবান্ন শব্দের অর্থ-নতুন অন্ন বা নতুন খাবার। অথবা বলা যায়-নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে তৈরি চালের প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে আয়োজিত উৎসবই নবান্ন। গ্রামবাংলায় সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। কিছু এলাকায় মাঘ মাসেও নবান্ন উৎসব হয়ে থাকে। আবার নবান্ন নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদেরও রয়েছে আলাদা আচার।আমন ধানের ভাত সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। এ চালের পিঠা-পায়েসও তাই স্বাদের হয়ে থাকে। সে জন্য গ্রামবাংলায় পিঠা-পায়েস মানেই আমন ধান।
যেহেতু এক সময় ধান মানেই আমন। আর আমন ধান ঘরে তোলা হয় হেমন্তে। তাই কৃষকের শস্যোৎসবটাও হেমন্তে হয়ে আসছে। বিশেষ করে অগ্রহায়ণ মাসে। যদিও এখন দেশের ৭০ শতাংশ জমিতে চাষ হয় বোরো। আর বোরো ঘরে তোলা হয় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তবুও বাংলার অনেক কৃষক আজও অগ্রহায়ণে নবান্ন উৎসব উদযাপন করেন। অবশ্য আগের মতো কৃষকের ঘরে ঘরে হেমন্তের সেই নবান্ন উৎসবের আমেজ আর চোখে পড়ে না। এর অন্যতম কারণই হলো-অধিকাংশ কৃষকই তো এখন বোরো চাষ করছেন। যার ফসল ঘরে আসে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে। তাই বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তো আর হেমন্তের নবান্ন উৎসব করা যায় না। এমন একটি উৎসবের আয়োজন করতে পেরে ভালো লাগছে।
error: Content is protected !!