হোম » মতামত » রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়

রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়

মুহাম্মদ নাজমুল হক: যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। যুদ্ধ মানেই মৃত্যু। যুদ্ধ মানেই দুর্ভিক্ষ। যুদ্ধ মানেই বিপন্ন মানবতা। তবে এই যুদ্ধ মানবজাতির জন্য হুমকিস্বরূপ হলেও কখনো কখনো অধিকার আদায়ের একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে। শোষকের হাত থেকে মুক্তির জন্য অনেক সময় শোষিতের হাতে যুদ্ধ ভিন্ন আর কোনো উপায় থাকে না। সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই যুদ্ধ-বিগ্রহ এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। অনেক সভ্যতা যুদ্ধের কারণে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। আর যুদ্ধের কারণে যে শুধু মানুষ বা সম্পদের ক্ষতি হয় তা নয়, বরং যুদ্ধ পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্যও মারাত্মক ক্ষতিকর। যুদ্ধ জয়ের জন্য পরিবেশ বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। প্রাচীন রোমান ও অ্যাসিরিয়দের বিরুদ্ধে শত্রুদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করার জন্য তাদের আবাদযোগ্য জমিতে লবণ ছিটিয়ে তা চাষের অনুপযোগী করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্যরা জঙ্গলের মধ্যে ও জলাভূমিতে এজেন্ট অরেঞ্জ ব্যবহার করেছিল। (এজেন্ট অরেঞ্জ হলো, এক প্রকার রাসায়নিক উদ্ভিদনাশক পদার্থ) জঙ্গল আর জলাভূমিতে ভিয়েতনামিজ গেরিলারা ওঁৎ পেতে থাকতো বলে এই ব্যবস্থা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান লাখ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যার পাশাপাশি অসংখ্য ঘরবাড়ি, গাছপালা আর হার্ডিঞ্জ ব্রিজসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছিল। এ যুদ্ধে প্রায় দুই কোটি মানুষ গৃহহীন হয়েছিল। যারা পরবর্তীতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে জাপানের হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ফলে সৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয় বিশ^বাসী দেখেছে। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকে ৩৪০ টনের মতো ডিপ্লিটেড ইউরেনিয়ামসমৃদ্ধ মিসাইল নিক্ষেপ করে। রাসায়নিক উপাদান সমৃদ্ধ এ অস্ত্র ব্যবহারের ফলে এর নেতিবাচক প্রভাব থেকে পরিবেশের পাশাপাশি মানুষও রক্ষা পায়নি। এক গবেষণায় দেখা গেছে ঐ যুদ্ধের পর ইরাকিদের মাঝে ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। আধুনিক যুগে যুদ্ধের ধরণ বদলেছে। এসেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র। আধুনিক এসব রাসায়নিক, জৈবিক ও পারমাণবিক অস্ত্রের মানুষ ও পরিবেশের উপর মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনার নজিরবিহীন ক্ষমতা রয়েছে।

আজ নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি স্বাধীন দেশে এমন সামরিক হামলা অত্যন্ত দুঃখজনক। উদ্বেগের বিষয় হলো, ইউক্রেনে রাশিয়ার সেনা অভিযান কেবল সামরিক স্থাপনা বা ঘাঁটিতে সীমিত নেই। উপর্যুপরি বোমাবর্ষণে ইউক্রেনের শত শত বেসামরিক মানুষ মারা যাচ্ছেন। বহু স্থাপনা-ঘরবাড়ি ধ্বংস হচ্ছে। জীবন বাঁচাতে মানুষ আপন ঠিকানা, স্বপ্নের আবাস ভূমি ছেড়ে ভিনদেশে আশ্রয় নিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন এ যুদ্ধে এরই মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে বিশ্বব্যাপী। সরবরাহ বিঘিœত হওয়ায় পণ্যের দাম বাড়ছে হু-হু করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সদস্যভুক্ত দেশগুলো রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে জালানি তেল, গমসহ নানা ভোগ্যপণ্য ও সেবার দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। জালানি তেলের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি সব ক্ষেত্রেই খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাড়তি চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। যে কোন যুদ্ধেই সাধারণ মানুষ আর তাদের ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পতিত হয়। এমনিতেই করোনা মহামারির কারণে বিশ্ববাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মানবতা রয়েছে ঘোর সংকটে। এর উপর আবার এই যুদ্ধ। এ অবস্থায় আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের মানুষের দৈনন্দিন জীবনে চাপ আরও বাড়বে। সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। অবস্থাটা এমন যে, রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়, উলুখাগড়ার প্রাণ যায়। দুনিয়া জুড়ে করোনায় বিপর্যস্ত ভঙ্গুর ও নাজুক অর্থনীতির উপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ গোদের উপর বিষফোঁড়া।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক এ আগ্রাসন বন্ধে অনেক দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডেকে যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাশিয়ার ভেটোর কারণে সে চেষ্টা সফল হয়নি। বাংলাদেশও বরাবরের মতো শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। আমরা পরিস্কারভাবে বলতে চাই, যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। যুদ্ধ বন্ধ হোক। ইউক্রেনের মানুষ ও সম্পদ সবকিছু রক্ষা পাক। সারাবিশ্বের মানুষ দ্রব্যমূল্যের নিষ্ঠুর কষাঘাত থেকে মুক্তি পাক। আর রাশিয়ার প্রতি যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বলতে চাই, যুক্তরাষ্ট্র ও ইজরায়েলসহ যেসব দেশ তাদের প্রতিবেশী বা দূরবর্তী দেশে অন্যায্য ও অন্যায়ভাবে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে পরিশেষে সেসব দেশের পরিণতি সুখকর হয়নি। বরং বিশ্বশান্তি বিঘিœত হয়েছে, মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। রাশিয়াকে সেসব বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বড় ছোট সব দেশকে অপর দেশের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে হবে।

error: Content is protected !!