হোম » সারাদেশ » ফেনীতে বহুকালের পুরোনো ঐতিহ্য শীতলপাটি বিলুপ্তির পথে

ফেনীতে বহুকালের পুরোনো ঐতিহ্য শীতলপাটি বিলুপ্তির পথে

মোঃআবদুল মুনাফ পিন্টুঃ আবহমান বাংলার ঐতিহ্য ধারক ও বাহক হিসেবে ব্যবহৃত কুটির শিল্পের অন্যতম একটি শীতলপাটি। কালের বিবর্তনে তা আজ বিলুপ্তির পথে। তেমন একটি উদাহরণ ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলায়। লোকবল সংকট, পর্যাপ্ত মুজুরি না পাওয়া, চাষাবাদে অনাগ্রহতাসহ বিভিন্ন সমস্যার মাঝে থমকে গেছে ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির ব্যবহার ও তৈরির কাজ।
জানা যায়, একটা সময় ছিল যখন গ্রামের বাড়ীতে অতিথি এলে বসতে দেয়া হতো শীতল পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। বর্তমানে ও হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম আনুষঙ্গিক বিষয় শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশি থাকে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে শীতলপাটি দেহ ও মনে শীতলতা আনে। দেশের যে কয়টি জেলায় শীতলটাটি তৈরি হয় তার মধ্যে ফেনী জেলা অন্যতম। ফেনী জেলার দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা, কোরাইশমুন্সি , রাজাপুর, সিন্ধুরপুর, এলাকার বিভিন্ন গ্রামের প্রায় ২০০ টি পরিবার শীতলপাটির তৈরি ও পাটি তৈরির প্রধান কাঁচামাল পাইত্র্যা নামক এক প্রকার গুল্ম জাতীয় গাছ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এছাড়া রাজাপুর, দাগনভূঞার প্রভৃতি জায়গায় শীতলপাটি তৈরি হয়।
এছাড়া মাতুভূঞার কয়েকটা বাড়ীতে শীতলপাটি তৈরি হয়। সব মিলিয়ে দাগনভূঞার প্রায় ৩০০ (তিনশত)টি এর বেশি পরিবার শীতলপাটির সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত এবং এর মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে। দাগনভূঞার সবচেয়ে বেশি শীতলপাটি তৈরি হয় বাসুদেবপুর গ্রামে। এ গ্রামের পাটিবররা সবচেয়ে ব্যস্ত সময় কাটায় গ্রীষ্মকালে। গমরকালে ৩ মাসের আয় দিয়েই তারা প্রায় পুরো বছর চালায়। এই গ্রামে প্রায় ১০০ (একশত) বিঘা/ ৩৫ (পয়ত্রিশ) একর জমিতে শীতলপাটির কাঁচামাল পাইত্র্যা বা পাটিপাতা চাষ হয়।
এখানে প্রায় ২০০ (দুইশত) জন কৃষক এ পাইত্র্যা চাষাবাদ ও রক্ষনা বেক্ষন করেন। এছাড়া সিন্ধুরপুর  ইউনিয়নের জগন্নাথপুর গ্রামে আনুমানিক ২০ (বিশ) একর জমিতে পাইত্র্যা জন্মে। এসব গ্রামের ষাট বছরের বৃদ্ধ থেকে শুরু করে দশ বারো বছরের ছেলে মেয়েরাও পাটি বুনে। তবে সব পাইত্র্যা চাষীরা এখন আর পাটি বোনে না অনেকে বিক্রি করে দেয়। পাইত্র্যা অনেকটা এমনি এমনি প্রাকৃতিক নিয়মে জন্মে। শুধু নিয়ম মাফিক পাইত্র্যা কাটা আর নিয়মিত আগাছা পরিস্কার করা।
একবার একটি পাইত্র্যার মূল বা কন্দ লাগালে তা দীর্ঘদিন ধরে গোড়া থেকে গজাতে থাকে পাইত্র্যা গাছ। এ জন্য যে জমিতে তারা একবার চাষ শুরু করেছে সে জমিতে আর অন্য কোন চাষের কল্পনা করে না। এ গাছ প্রায় ৭-১০ ফুট লম্বা হয়। তাছাড়া তারা শুধু পাইত্র্যা বিক্রি করে ২শ থেকে ৪শ টাকা পোন (৮০টিতে এক পোন) হিসেবে। এসব এলাকার  তৈরি শীতলপাটি ব্যাবসায়ীদের হাত ধরে চলে যাচ্ছে ঢাকা, সিলেট, চট্রগ্রাম ও বরিশালের বাজারে। রপ্তানি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও ব্যক্তিগতভাবে কলকাতাসহ ইউরোপ আমেরিকার বেশ কয়েকটি দেশে নিয়মিত যাচ্ছে। মূলত গরমের অত্যাচার থেকে বাঁচতে খাটে বা মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে আরাম আয়েশের সাথে সাথে নকশা করা শীতলপাটি ঘরে ঝুলিয়ে ও শোভা বাড়াচ্ছে অনেকে। এটি বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী কুটিরশিল্প।
মুর্তা বা পাটি, বেত বা মোস্তাক নামের গুল্মজাতীয় উদ্ভিদের ছাল থেকে এ পাটি তৈরি হয়। হস্তশিল্প হিসেবেও এ পাটির যথেষ্ট কদর রয়েছে। শহরে শো পিস এবং গ্রামে এটি মাদুর বা চাদরের পরিবর্তে ব্যাপকভাবে ব্যবহত হয়। সাজসজ্জা দ্বারা সজ্জিত মাদুরকে আবার নকশি পাটিও বলা হয়। শীতল পাটি বোনা হয় বেত জাতীয় গাছের আঁশ থেকে। এই গাছটি মোস্তাক, পাটিপাতা, পাটিবেত ও পৈতারা। এই গাছটি সিলেট, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রামে জন্মায়। শীতল পাটি সত্যিকার অর্থেই একটি বিরাট শিল্পকর্ম। এই কাজে নারীরা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই শিল্পের সাথে জড়িতরা তাদের অঞ্চলের নক্সা ও মটিফকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
বিশেষ করে শুকনা মৌসুমে মুর্তা থেকে বেত তৈরি হয়। বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘ সময় নিয়ে যত্ন সহকারে বোনা হয় শীতল পাটি। শীতল পাটিতে কারিগররা দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন গান, কবিতা, জীবজন্তুসহ প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলি। নকশা করা শীতল পাটি শৌখিন অনেকে গৃহসজ্জার কাজেও ব্যবহার করেন। আর বর কনেকে শীতল পাটিতে বসিয়ে আপ্যায়নের রীতিও পুরনো। শীতল পাটির কাহিনী অনেক দীর্ঘ। ব্রিটিশ আমল থেকেই এর কদর।
একটি পাটি তৈরি করতে সাধারণত ৩ থেকে ৪ দিন লাগে। তবে বয়স্ক একজন পাটিবর একাই পাটি বোনার কাজ করলে ৭ দিন সময় লাগে। একটি পরিবার মাসে কমপক্ষে ১০টি পাটি তৈরি করতে পারে। আর এ থেকে পরিবারটির মাসিক আয় সর্বোচ্চ ৭ হাজার টাকা। মোটাপাটি ও বুকাপাটির দাম শীতলপাটির চেয়ে অনেক কম। ৫ ফুট বাই ৭ ফুট মাপের ভালো মানের একটি পাটির দাম বাজারে প্রায় ১৬ শ থেকে ২ হাজার টাকা। মধ্যম মানের পাটির দাম ৬শ থেকে শুরু করে ১ হাজার টাকা। বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ফেনী জেলার ঐতিহ্যবাহী শীতল পাটি।
আনুমানিক ২৫০ থেকে ৩০০ বৎসর যাবৎ বংশ পরস্পরায় এটি চলে আসছে। এক সময় ফেনী শহর এবং ফেনী জেলাধীন দাগনভূঞা উপজেলার বিশেষ কয়েকটি এলাকায় এ শিল্পের প্রসার ঘটে। শুধু ফেনীতে এর সুনাম ছিল, অনেক জ্ঞানীগুণীর ও শিল্পপতির জন্মস্থান এই জেলাতে। তাদের স্বপ্নের ঘর সাজানোর প্রধান আসবাব ছিলো শীতলপাটি। দিনের ক্লান্তি মুছে দেয় একটি সুন্দর পরিপাটি শয়ন কক্ষ আরামদায়ক শয্যা এনে দেয় সুখ নিন্দ্রা। হারাতে না চাই সুখের নিন্দ্রা, হারাতে না চাই সুখ স্বপ্ন। আজও স্বপ্ন দেখছে এ সব পাটিবররা|
দাগনভূঞা শহরের কামারপট্টিতে এক সময় ৮/১০ টি শীতল পাটির দোকান ছিল। এখন মাত্র ০৩টি দোকানে পাটি পাওয়া যায়।পাটি শিল্পীরা এসব দোকানে পাইকারি মূল্যে পাটি বিক্রি করেন। এছাড়া কিছু কিছু লোকজন মাথায় ফেরী করে পাটি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। স্থানীয়ভাবে বিপননের কোন ব্যবস্থা নেই। আগে ফেনী জেলার অনেক গ্রামে লোকজন পাটি বানাত কিন্তু এখন উপজেলার মধ্যে কোনো গ্রামে তেমন কেউ পাটি বানায় না।
পর্যাপ্ত পরিমাণে মোর্তাক বা পাটিপাতা  গাছের উৎপাদন না থাকায় পাটি পেশা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। পাটি কারিগররা বলছেন সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা পেলে এই পাটিশিল্পকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে হয়তোআমাদের আশার কথা এই যে, দিন দিন বাংলাদেশের নানা ঐতিহ্য ও ইতিহাস এখন বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাচ্ছে। প্রত্নতান্ত্রিক নিদর্শন হিসেবে পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার ও বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ,
ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। এবার এই তালিকায় নাম উঠল  শীতল পাটিরও। আমরা যদি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বেত বা পাটিপাতা গাছের চাষ সম্প্রসারণ করতে পারি, পাটিয়ালদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করতে পারি তবে বিশ্ব ঐতিহ্যের আবেগি পরশ আমাদের নতুন প্রজন্মকেও নিশ্চয়তা দিতে পারি। সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আবার পিরুক শীতল পাটির অনুপম শিল্প। ঐতিহ্যের আতিশয্যে কাটুক বাঙালি জীবন।
error: Content is protected !!