হোম » প্রধান সংবাদ » তিন ঘন্টার ‘স্বেচ্ছা প্যারোল’ আর লক্ষণ ইতিবৃত্ত

তিন ঘন্টার ‘স্বেচ্ছা প্যারোল’ আর লক্ষণ ইতিবৃত্ত

জাহাঙ্গীর আলম:  “নেই কাছে সহচরী, পাশে নেই প্রাণ প্রিয়তম/অশোক কাননে হায় হইয়া বন্দিনী কেঁদে ওঠে জগৎ নন্দিনী/ রঘুপতি রঘুপতি দিয়ো নাকো বাঁধা/ বিনা রামে পসিয়া লংকায় ছিন্নভিন্ন করি ওই অশোক কানন জননীরে উদ্ধারিবে অনুজ লক্ষণ।”

সেই কলেজ জীবনের শুরুতে আমি ‘একটি পয়সা’ নাটকের লক্ষণ চরিত্রে অভিনয করেছিলাম। নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পর মযমনসিংহের কেওয়াটখালী রেলওয়ে কলোনীর এম রহমান মিলনাতনে। ওই নাটকে আরো অভিনয় করেছিলেন আমার অগ্রজপ্রতীম জনাব সাইফুল হুদা আনাহোলী ওরফে ‘তাহা’ ভাই। যদিও সাইফুল ভাইয়ের ‘তাহা’ নামটি ফেসবুকে’র কল্যাণে প্রায় অর্ধশতাব্দী পর জানতে পারলাম। আরো একজন শক্তিমান অভিনেতা ছিলেন ওই নাটকে আমাদের প্রিয় খালেক ভাই। এতো বছর পর নাটকের সংলাপটি যতটুকু মনে আছে সেটাই পরিবেশন করলাম। ভুল হলে বিদগ্ধজন শুদ্ধ করে দিলে কুণ্ঠিত হবো না।

একদিকে নাটকের লক্ষণ চরিত্র অন্যদিকে ছেলেবলায় লক্ষণ নামে আমার এক বন্ধু ছিলো। সুতরাং লক্ষণ নামটি আমার খুব চেনা। হাল আমলে আবার আরো এক লক্ষণ আমার বন্ধু তালিকায় যুক্ত হলো। এই লক্ষণের পুরো নাম লক্ষণ চন্দ্র দাস, পেশায় মাছ বিক্রেতা, আমার পরম হিতৈষী বন্ধু। কৈবর্ত সম্প্রদায়ের লোক, অর্থ্যাৎ মৎস্যজীবী। আগে সাভার বাজারে মাছ বিক্রির নিজের ব্যবসা ছিল তার, এখন নেই, কারণ পুঁজির অভাব। চাকরি করেন অন্যের মাছের দোকানে।

আমি মোবাইল ফোনে যখনই কল দিয়েছি তখনই লক্ষণ দাসের একটাই প্রশ্ন “গুরু মাছ লাগবো?” । আমি চাহিদা মতো কখনো ইলিশ বা নদীর মাছের কথা বলি। অনেক সময় আমার বাজারে পৌঁছতে দেরি হলে লক্ষণ নিজের দোকান ফেলে অন্য দোকান থেকে মাছ কিনে রাখতেন ।

লক্ষণ চন্দ্র দাসের বয়স ষাটের কাছাকাছি। কিন্তু এখনো মনের দিক থেকে যথেষ্ট তরুণ চলনে-বলনে, ভাব-ভঙ্গিতে। লক্ষণ দাস বংশানুক্রমে মাছ বিক্রির পেশায় জড়িত। তার বাবাও ছিলেন মাছ বিক্রেতা। সাভারের সাদাপুর গ্রামে তার পৈত্রিক বাড়ি।

আমি ২০১৫ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বছর তিনেক সাভারে ছিলাম। আমার বড় মেয়ে সাভার ইব্রাহিম জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র মেডিকেল অফিসার (বর্তমানে)। ও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই সাভারে আছে। আমার স্ত্রী জনতা ব্যাংকের সাভার কর্পোরেট শাখায় অফিসার ছিলেন। এই দুটি কারণেই আমার সাভারে বাসা নেওয়া। আমি সাভার থেকেই নিযমিত বারিধারায় অফিস করতাম।

শুক্রবার বা শনিবার বাজারে যেতাম। সাভার নিউমার্কেটের কাছে ওভারব্রিজের সামনেই সাভার কাঁচা বাজার। নতুন নতুন যখন ওই বাজারে যেতাম পছন্দসই মাছ, মুরগী ও সবজি কিনতে পারলেও ঠকবাজির শিকারও হয়েছি কমবেশি ।

একদিন আমার বড় জামাই প্রসঙ্গক্রমে এই লক্ষণের সন্ধান দিল। এরপর যখনই বাজারে গেছি লক্ষণ ছাড়া বাজার করতেই মন চাইতো না। লক্ষণের সঙ্গে শুরুটা ছিল এ রকমই। আমি সাধারণত শুক্রবার অথবা শনিবার বাজারে যেতাম। যদিও শুক্রবার বাজার ভিড়ে ঠাসা থাকে। কারণ সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বেশিরভাগ কর্মজীবী মানুষ বাজারে যান। শুক্রবার হলেও এবং লক্ষণের শত ব্যস্ততা থাকলেও তিনি আমাকে নানা পদের মাছ, মুরগী ছাড়াও সাভারে উৎপাদিত সবজি কিনে দিতেন। এমনি করেই লক্ষণ দাসের সঙ্গে আমার নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

লক্ষণ আমাকে তার গ্রামের বাড়ি সাদাপুরেও নিয়ে গেছেন। একসময় জমি কেনার জন্য আমাকে বেশ কয়েকবার সাভারের বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়েছে। এমনি একদিন জমি দেখতে গিয়ে লক্ষণ আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে গেছেন, দুপুরের খাবার খাইয়েছেন।

অনেক সময় বাজারে না গেলেও লক্ষণ ফোনে জেনে আমার এবং মেয়ের বাসায় নিজে এসে মাছ দিয়ে গেছেন। আমি আর আমার ডাক্তার মেয়ে সাভারে পাশাপাশি ফ্ল্যাটে থাকতাম। কখনো মাছের দাম বেশি নিতেন না লক্ষণ। আমি এমনও দেখেছি আমার জন্য মাছ কিনতে গিয়ে লক্ষণ তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের সঙ্গেও দর কষাকষি করছেন, এমনকি বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়েছেন। লক্ষণ আমার জন্য তার ব্যবসায়ের মূল্যবাণ সময় নষ্ট করছেন দেখে আমার খারাপ লাগতো। আমি কখনো লক্ষণকে ৫০/১০০ টাকা দিতে চাইলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখান করতেন। একে তো আমার দেওয়া টাকা তিনি নিতেন না, উল্টো বাজার শেষে চা খেতে বসলে চায়ের দামও দিতে দিতেন না। এমনি করে লক্ষণ দাসের সঙ্গে আমার গভীর সখ্য গড়ে ওঠে। আমরা বন্ধু হয়ে যাই। যদিও তিনি আমাকে যথেষ্ট সমীহ করতেন এবং এখনো করেন।

বছর তিনেক পর আমার স্ত্রীর ঢাকায় বদলী সূত্রে চলে আসি কল্যাণপুরে। কিন্তু লক্ষণের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল নিরবচ্ছিন্ন । সময় পেলেই তাকে ফোন করতাম। কুশল বিনিময় হতো যা এখনো অব্যাহত আছে । আর ইলিশ মওশুমের শেষ দিকে ইলিশের দাম যখন কম থাকে লক্ষণ তখন আমাকে কম করে হলেও এক কুড়ি ইলিশ কিনে দেন ফি বছর।

আমার ‘স্বেচ্ছা প্যারোল’
আইনের ভাষায় জেলে বন্দি কোনো বিচারাধীন হাজতী, আসামী বা কয়েদিকে শর্তাধীনে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য মুক্তি দেওয়াকেই প্যারোল বলে। আইনের এই প্যারোলের মতো আমারও স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি মিলেছিল ৭ জুলাই, তিন ঘন্টার জন্য। বিশেষ প্রয়োজনে সাময়িকভাবে নিজের জন্য নিজেই প্যারোল মনজুর করলাম, সাভার যাবো বলে।
আগের দিন রাতেই লক্ষণ দাসকে ফোন করে জানিয়েছিলাম, আমি স্বল্প সময়ের জন্য সাভার আসছি। বাজারে ইলিশের আমদানি ও দাম কেমন? লক্ষণ জানালেন ইলিশের আমদানি ভালো, দাম হাজার বারো’শ টাকা কেজি। তাকে জানালাম সাভার থেকে ঢাকা ফেরার পথে ইলিশ আর নদীর চিংড়ি নিয়ে যাবো। কথামতো কাজ শেষে লক্ষণকে ফোন দিলাম। সাভার কাঁচা বাজারের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই দেখি মাস্ক পরা লক্ষণ সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। মাছের ব্যাগ উঠিয়ে দিলেন গাড়িতে। লক্ষণকে বললাম, আজ আর নয়, করোনামুক্ত পরিবেশে আসবো আবার একদিন। অতি বিনয়ী লক্ষণ আমাকে সালাম জানিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। চালক গাড়ি ছেড়ে দিল। পিছন ফিরে দেখি লক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছেন। চালক গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিলেন, ধুসর হতে শুরু করলো পিছনে ফেলে আসা সাভার কাঁচাবাজারের দৃশ্য। গাড়ি ছুটছে দ্রুত, পেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক জনপদ। আর আমি ভাবছি কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ‘স্বেচ্ছা প্যারোলে’ মুক্তির সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে। আবার শুরু হবে আমার স্বেচ্ছা গৃহবন্দির জীবন।

error: Content is protected !!