হোম » অন্যান্য বিভাগ » কক্সবাজারের ৬০ ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি; প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

কক্সবাজারের ৬০ ইউনিয়নের তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি; প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা

মোহাম্মদ খোরশেদ হেলালী: টানা পাঁচ দিনের ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের ৯টি উপজেলার ৬০টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামের অন্তত তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জলবন্দি থাকা গ্রামগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য ও খাবার পানির সংকট। রাস্তা ভাঙ্গা ও পানিতে ডুবে থাকায় চলাচলের উপায় না পেয়ে এসব গ্রামের মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। সোমবার বিকেলে দেয়াল, পাহাড়ের মাটি চাপা ও পানিতে ডুবে চার শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। 
একাধিক অংশে ভেঙ্গে গেছে মাতামুহুরী, বাঁকখালী ও ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ। এসব ভাঙ্গন দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় ডুবে গেছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাথমিক হিসাবে ৫১ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক এবং আড়াই কিলোমিটার মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টসহ উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
দূর্গতদের মাঝে ইতোমধ্যে ৫৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে বলে দাবি করেছে জেলা প্রশাসন।
আবহাওয়া অফিসের কক্সবাজার আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্র জানায়, রোববার বিকেল ৩টা থেকে সোমবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। সোমবার ১২টা থেকে রাত ১২ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে ৯৩মিলিমিটার। আরও কয়েকদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে।
এদিকে, ভারী বর্ষণের কারণে সড়ক পানিতে তলিয়ে থাকায় মঙ্গলবার (৮ আগস্ট) সকাল হতে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। দোহাজারী হাইওয়ে থানার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের চন্দনাইশের হাশিমপুর কসাইপাড়া,পাঠানীপুল, দোহাজারী পৌরসভার কলঘরব্রীজ এলাকায় রাস্তার উপর প্রায় আড়াইফুট এবং সাতকানিয়ার কেউচিয়ার নয়াখাল, নতুন রেললাইন, কেরানীহাটবাজার এবং ছদাহার হাসমতের দোকান এলাকায় মহাসড়কের উপর দিয়ে একফুটের বেশি পানি উজান থেকে ভাটির দিকে প্রবাহিত হলে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। কিছু বড় যান ধীরগতিতে চললেও ছোট ও মাঝারী যান চলাচল বন্ধ থাকে। এর আগে সোমবার থেকে বান্দরবান সড়কের বাজালিয়া এলাকায় পানি উঠে কক্সবাজার-চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়।
এদিকে সামুদ্রিক জোয়ারের ঢেউতে মেরিন ড্রাইভ, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা পয়েন্ট, মহেশখালী ও কুতুবদিয়া উপজেলার উপকূলীয় এলাকায় ভাঙন অব্যাহত রয়েছে। মেরিন ড্রাইভের কিছু অংশে জিওব্যাগে বালির বাঁধ তৈরি করে ভাঙন রোধের চেষ্টা করা হলেও নতুন করে আরও কয়েকটি স্পটে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার রাতের বৃষ্টি মোষলধারের বৃষ্টিতে শহরের পর্যটন জোনের প্রধান ও উপসড়কে এক-দেড়ফুট পানি প্রবাহিত হয়। নিচু লেভেলে থাকা অনেক হোটেলের নীচতলায় পানি ঢুকে ক্ষয়ক্ষতি হয়। সৈতকপাড়ায় অনেক বাসাবাড়িতেও পানি ঢুকেছে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগীরা। একই অবস্থা পাহাড়তলী, লাইটহাউজ, রহমানিয়ামাদ্রাসা এলাকাতেও।
চকরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান ফজলুল করিম সাঈদী জানান, পাহাড়ি ঢল, বৃষ্টি এবং জোয়ারের ঢেউতে বাঁধ ভেঙে বিস্তৃণ এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চকরিয়ার পৌরসভা ও ১৮টি ইউনিয়নের মানুষ পানিবন্দি। ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয়েছে কাকরা, লক্ষ্যরচর, বুমুবিল ছড়ি, সুরেজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালী ইউনিয়ন। মাতামুহুরীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় ঢলের পানির তোড়ে কইন্যারকুম, বিএমচর, মেহেরনামা বেরি বাঁধ ভেংগে গেছে। আরো একাধিক এলাকায় পাউবোর বাঁধ ভেঙে যাওয়া এবং বৃষ্টি না থামলে ভয়াবহ বন্যার শঙ্কা রয়েছে।
জেলা পরিষদের ঈদগাঁও উপজেলার সদস্য মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ঈদগাঁও ফুলেশ্বরী নদীর বাঁধ ভেঙ্গে ঈদগাঁওর জালালাবাদ, ঈদগাঁও, ইসলামাবাদ, ইসলামপুর, পোকখালী ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামে বন্যার পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামের সড়কগুলোও। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। কৃষিজমিসহ তলিয়ে গেছে শত শত হেক্টর আমনের বীজতলা। তলিয়ে গেছে মাছের ঘের, হ্যাচারি, পুকুর।
রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা মুস্তফা জানান, উপজেলার ফতেখাঁরকুল, গর্জনিয়া, কচ্ছপিয়া, চাকমারকুল, রাজারকুল, জোয়ারিয়ানালা, দক্ষিণ মিঠাছড়িসহ বিভিন্ন এলাকার পানিবন্দি মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বাঁকখালীর পানি বিপদ সীমা অতিক্রম করায় তীব্র স্রোতে বিভিন্ন গ্রামের সাঁকো ভেসে গেছে। ফলে স্থানীয়রা ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় পারাপার করছেন। বন্যাদুর্গতের জেলা প্রশাসকের দেয়া ২ মেট্টিক টন চাল ও পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে। দেয়া হচ্ছে শুকনো খাবারও।
কক্সবাজার সদরের ঝিলংঝা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান টিপু সুলতান বলেন, আমার ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা নিচু হাওয়ায় পানিতে ডুবে আছে। এসব এলাকার লোকজনকে সরিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়।
পেকুয়ার ইউএনও পূর্বিতা চাকমা জানান, পাহাড়ি ঢলে পেকুয়া সদর ইউনিয়ন, উজানটিয়া, মগনামা, টৈটং, বারবাকিয়া, শিলখালী ও রাজাখালী নিম্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। দেখা দিয়েছে নিরাপদ পানি, খাবারের সংকট দেখা গেছে। বানৌজ শেখ হাসিনা সড়কসহ অনেক সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। অধিকাংশ গ্রামে বাসাবাড়ি পানিবন্দি।
অপরদিকে, সোমবার (৭ আগস্ট) বিকেলে চকরিয়ার বরইতলী ইউনিয়নের ৩নং ওয়ার্ড সবুজ পাড়া (বরঘোনা) এলাকার মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের দুই শিশু সন্তান তাবাচ্ছুম (১) ও মোহাম্মদ সাবিদ(৫) বাড়ির দেয়াল চাপা পড়ে মারা যায়। এসময় আহত হয়েছেন নাজিম, তার স্ত্রীসহ আরও চারজন। একই সময়ে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৯ এর এ/৬ ব্লকে ঘরের উপর পাহাড় ধসে ওই ক্যাম্পের আনোয়ার ইসলামের স্ত্রী জান্নাত আরা (২৮) এবং তাদের মেয়ে মাহিম আক্তার (২) মারা যায়। একই সময়ে রামুর রাজারকুলের মৌলভীপাড়ায় বাড়ির উঠানে আসা বন্যার পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছে সৌদী প্রবাসী মৌলভী ওবাইদুল হকের শিশু কন্যা সামিয়া (২)।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, জেলার ৬০ ইউনিয়নে  তিন লক্ষাধিক মানুষ জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় কয়েককোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এ পর্যন্ত তিন উপজেলায় প্রাণহানি হয়েছে ৫ জনের। দূর্গত মানুষদের জন্য ২০৮টি আশ্রয় কেন্দ্র খুলে দেয়া হয়েছে। সেসব আশ্রয় কেন্দ্রে ৪০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। চকরিয়া-পেকুয়ায় ৪৮ কিলোমিটার আঞ্চলিক সড়ক, উখিয়ায় ৩ কিমি কাঁচা সড়ক এবং টেকনাফ মহাসড়কে আড়াই কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অতিবর্ষণে দূর্গতদের ইতোমধ্যে ৫৮ মেট্রিক টন চাল এবং নগদ ৭ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। বড় ধরনের ক্ষতি এড়াতে সকল বিভাগ একীভূত হয়ে কাজ করছে।
দুর্যোগ মোকাবেলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন:
ভারী বর্ষণের ফলে কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের কয়েকটি উপজেলায় চলমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সেনাবাহিনীর ১০ পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় উখিয়া-টেকনাফে অবস্থিত বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের ক্যাম্পে সেনাবাহিনীর উদ্ধারকারী দল কার্যক্রম শুরু করেছে। ১০ পদাতিক ডিভিশন কর্তৃক কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য সংস্থার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিয়মিত সংবাদ সংগ্রহ ও বিভিন্ন তথ্যের জন্য রামু সেনানিবাসে দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য কন্ট্রোলরুম স্থাপন করা হয়েছে।
error: Content is protected !!