হোম » অন্যান্য বিভাগ » বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক: নানা অনিয়ম-দুর্নীতি, ভর্তি-প্রশ্নপত্র-নিয়োগ বানিজ্যসহ বহু গুরুতর অভিযোগ রয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) সদ্য বিদায়ী রেজিস্ট্রার মোঃ মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চাপে সম্প্রতি রেজিস্ট্রার পদ থেকে তাকে অব্যহতি দেওয়া হলেও তিনি বিধিবহির্ভুতভাবে একাই দখল করে আছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনানন্দ দাশ রিসার্চ-সেন্টারের পরিচালক, কলা ও মানবিক অনুষদের ডীন, আই.কিউ.এ. সেলের পরিচালক, সিন্ডিকেট মেম্বার, একমাত্র অধ্যাপক পদ, অর্থ কমিটি, ভর্তি কমিটি, প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, নিয়োগ, টেন্ডার-ক্রয় কমিটিসহ বিভিন্ন কমিটির আহবায়ক-সচিবসহ বহু পদ।

এ বিষয়ে ইউজিসি ও অর্থ মন্ত্রনালয়ের আপত্তি আমলে নেওয়া হয়নি। এর আগে তিনি সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন এবং ইংরেজি, সাংবাদিকতা ও দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান পদও দখলে রেখেছিলেন।

শিক্ষকরা এক রুমে ৩-৪ জন করে গাদাগাদি করে বসলেও তিনি একাই ৪টি বিশাল বিশাল কক্ষ দখল করে রেখেছেন। এসব রুমে এসি, বিশাল টেবিল, সোফা সেট, চেয়ারসহ নানা ফার্নিচারে সজ্জিত।

সরকারি বিধি অনুসারে, যেকোন একটি দায়িত্ব ভাতা নিতে পারে এবং ১,৫০০ টাকার বেশি ভাতা নেওয়ার সুযোগ নেই। সরকারি বিধিমালাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মোঃ মুহসিন উদ্দীনের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে বেতন-ভাতার বাইরে অনৈতিকভাবে প্রতি মাসে ৮,০০০ টাকা করে দায়িত্ব ভাতা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

তার মুখের কথাই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন। এ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সরকারী অডিট আপত্তি থাকলেও আমলে নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। নানা পদে ও অসংখ্য কমিটিতে থাকায় অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বৈঠকী ভাতা, অনারিয়াম ও টিএ-ডিএ’র নাম করে লাখ লাখ টাকা পকেটে ভরছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

ববির ছাত্র ও শিক্ষকদের অভিযোগ, অর্থ ও পদলোভী মোঃ মুহসিন উদ্দীন বহু গুরুত্বপূর্ণ পদ একাই দখল করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা ও নানা সংকট তৈরি করে আসছেন। নিজ বিভাগে ক্লাস নেন না, অথচ বছরের পর বছর অবৈধভাবে বেসরকারী ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, বরিশাল-এ চাকুরী করে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা বেতন নিয়েছেন। এতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক তথা শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মধ্যে এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় সকল কমিটিতে তিনি আছেন এবং মিটিংয়ে উপস্থিত না থেকেও পরে স্বাক্ষর করে অনারিয়াম নেন।

অবৈধ টাকায় নামে-বেনামে বাড়ী-গাড়ী করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করেন মুহসিন উদ্দীন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুয়েল পুড়িয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ও ড্রাইভার সারাবছর ব্যক্তিগত ও পরিবারের সদস্যদের কাজে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ার সঙ্গে মোঃ মুহসিন উদ্দীন জড়িত থাকায় প্রভাব খাটিয়ে আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজনদের নিয়োগ দিয়েছেন, হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। ভর্তি পরীক্ষার সময় এলেই তার পোয়াবারো, বৈধ-অবৈধভাবে উপার্জন করেন লাখ লাখ টাকা। প্রতি বছর ভর্তি পরীক্ষার সময় সর্বোচ্চ অংকের টাকা তার পকেটে যায়। এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে সিনিয়র শিক্ষকদের মধ্যে।

হাজী মোঃ মুহসিন উদ্দীন ও তার পুরো পরিবার জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ রয়েছে। তার সহোদর ভাই বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের সাবেক ডাক্তার গোলাম সারওয়ার জামায়াতে ইসলামীর সিনিয়র সদস্য। মোঃ মুহসিন উদ্দীন নিজেও জামায়াতের অর্থায়নে সৌদি আরব, তুরস্কসহ বিভিন্ন ইসলামী দেশ সফর করেন এবং দেশ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী নানা কর্মকা-ের সঙ্গে সে জড়িত বলেও গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

সদ্য সাবেক ববি রেজিস্ট্রার মোঃ মুহসিন উদ্দীন-এর পিএ আব্দুল বাতেন নিয়োগপ্রার্থীদের সঙ্গে অবৈধ যোগাযোগ, চাকুরী পাইয়ে দেওয়ার অনৈতিক অফার, নারী প্রার্থীদের কুপ্রস্তাব দেওয়া, হয়রানীসহ নানা অভিযোগে করা মামলায় জেল খাটলেও তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়নি সে। নারী কেলেঙ্কারী ও নিয়োগ বানিজ্যের সঙ্গে নিজে জড়িত থাকায় গোমর ফাঁস হওয়ার ভয়ে কুকর্মের সহযোগী কাম পিএকে বাঁচাতে উঠেপড়ে লাগে মোঃ মুহসিন উদ্দীন।

চাকুরী দেওয়ার কথা বলে নারীদের সঙ্গে অবৈধ ও অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এসব ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখলে আর কারা জড়িত তা বেরিয়ে আসতে পারে বলে বিভিন্ন পত্রিকার রিপোর্ট হলেও মুহসিন উদ্দীনের হস্তক্ষেপে ববি ভিসি ব্যবস্থা নেননি। মোঃ মুহসিন উদ্দীন যা বলেন, সেটাই করেন উপাচার্য। এই সুযোগে যা ইচ্ছা তাই করে যাচ্ছেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র শিক্ষক জানান, মোঃ মুহসিন উদ্দীন আগে একটি কলেজের শিক্ষক ছিলেন, অনার্স-মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণী না থাকার পরও কেবল লবিংয়ের জোরে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। বিধি অনুসারে নিয়োগ বোর্ডে কমপক্ষে তিনজন বৈধ প্রার্থী থাকার কথা থাকলেও তার নিয়োগ বোর্ডে তিনিই একমাত্র প্রার্থী ছিল।

অথচ সেই বোর্ড বাতিল বা স্থগিত করা হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে নিয়োগ পান তিনি। তার পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। আরও অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্য, বিভিন্ন টেন্ডার পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে ঘুষসহ নানা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে এবং বিভিন্ন কমিটিতে থেকে অবৈধ পন্থায় তিনি আয় করছেন লাখ লাখ টাকা।

মোঃ মুহসিন উদ্দীনের আপন বোন নুসরাত জাহান ফার্সিতে পড়লেও তাকে ক্ষমতার জোরে ও প্রভাব খাটিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ ও হিসাব পরিচালকের দপ্তরে ‘সহকারি পরিচালক’ পদে নিয়োগ দেন। অথচ অর্থ ও হিসাব দপ্তরে কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড থাকা বাধ্যতামূলক।

এমনকি অর্থ ও হিসাব দপ্তরে নুসরাতের কয়েক বছরের সিনিয়র কর্মকর্তা এএসএম ইকবাল মিয়াসহ অনেককে ব্যক্তিগত রোষের কারণে পদোন্নতি আটকে রেখে জুনিয়র কর্মকর্তা বানিয়ে দেয় সে।

বোনের স্বামী মোঃ আশিকুল আলম বিপ্লবকে চাকুরী দিয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চান মুহসিন উদ্দীন। ফার্সির ছাত্র আশিকুল আলম বিপ্লব কিছু ভূয়া অভিজ্ঞতার সনদ ও জাল কাগজপত্র জমা দিয়ে ববিতে অফিসার পদে চাকুরীর আবেদন করেছে।

সেইসব ভূয়া ও জাল কাগজপত্র সত্যায়িত করেছে তার স্ত্রী ও মুহসিন উদ্দীনের বোন নুসরাত জাহান। আশিকুল আলম বিপ্লবকে এর আগে শিক্ষকদের বিরোধিতার মুখে ববিতে চাকুরী দিতে না পেরে বেসরকারী ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসার পদে চাকুরী দিয়েছিল, পরে তার চাকুরী চলে যায়।

মোঃ মুহসিন উদ্দীনের গভীর চক্রান্তে সাবেক রেজিস্ট্রার মোঃ মনিরুল ইসলামের চাকুরী চলে যায়। এ ঘটনার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে এর পিছনে কলকাঠী নাড়ে মোঃ মুহসিন উদ্দীন। পরে সে নিজেই এই পদে জেকে বসে। মোঃ মনিরুল ইসলাম মামলার রায় পেলেও তাকে যোগদান করতে না দেওয়ার পেছনে কলকাঠি নাড়ে সে। হেনস্থার ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর অধ্যাপক ও সাবেক রেজিস্ট্রার ড. মোঃ হাসিনুর রহমান চাকুরী ও দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়।

বর্তমানে ববির একমাত্র অধ্যাপক মোঃ মুহসিন উদ্দীনের কুটকৌশলের কারণে সহকারি অধ্যাপকদের পদোন্নতি দীর্ঘদিন আটকে ছিল। মন্ত্রনালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের নির্দেশ থাকলেও তার কুটচাল ও কৌশলী বিরোধিতার কারনে স্থায়ী রেজিস্ট্রার ও অধ্যাপক নিয়োগ দিতে পারেনি অতীত-বর্তমান কোন ভিসিই। কথিত আছে, সব ভিসির আমলেই প্রথম কয়েক বছর লুটপাট করে শেষসময়ে রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব থেকে সরে যায় মোঃ মুহসিন উদ্দীন। সব পাওয়া শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ও উপাচার্যের বাারোটা বাজানোই তার কাজ।

অভিযোগ রয়েছে, ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ড. একেএম মাহবুব হাসান উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে থাকার সময় তাকে ভুল বুঝিয়ে প্রশ্নপত্র বাণিজ্যের অভিপ্রায়ে প্রশ্নপত্র ছাপিয়ে বিতর্ক তৈরি করেন মোঃ মুহসিন উদ্দীন।

অথচ উপাচার্য নিয়োগের আগে সেই সুযোগ ছিল না। পরে সেইসব প্রশ্ন বাদ দিয়ে আবার নতুন করে প্রশ্ন ছাপতে হয়, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক লক্ষ টাকা গচ্ছা যায়।

২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্ভার রুমে অগ্নিকাণ্ডে লাখ লাখ টাকার সম্পদের ক্ষয়ের ঘটনার পিছনেও তার হাত রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিতর্কিত এইসব কর্মকান্ডে তার কিছুই হয়নি।

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ বজায় ও অগ্রগতির স্বার্থে মোঃ মুহসিন উদ্দীনের আর্থিক অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ, ভর্তি ও নিয়োগ বাণিজ্য, কেলেঙ্কারীসহ নানা অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রনালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’

error: Content is protected !!