হোম » জাতীয় » জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব শিশুদের জীবনেও

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব শিশুদের জীবনেও

tuhin nizam

এমডি আবু আলীঃ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এবার বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, গত কয়েক বছরে এমন বন্যা দেখা যায়নি। এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে ছোট্ট ছোট্ট শিশু। এ ছাড়া তারা স্কুল থেকেও ঝরে পড়ছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক তহবিল ইউনিসেফ বলছে, বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় পাঁচটি জেলায় ভয়াবহ বন্যার প্রভাবে ১৬ লাখের বেশি শিশুর নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষা ঝুঁকিতে পড়ে। যেকোনো জরুরি পরিস্থিতিতে শিশুরা সবচেয়ে অসহায়। ক্ষতিগ্রস্ত শিশু ও পরিবারগুলোর জরুরি নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও নিরাপদ পানির প্রয়োজনে সাড়া দিতে ইউনিসেফ সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারদের সঙ্গে মাঠপর্যায়ে কাজ করছে। বাংলাদেশের পাঁচ জেলা—সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা ও মৌলভীবাজারের ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সিলেট ও সুনামগঞ্জ এলাকার মানুষ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। কারণ, সেখানে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং কৃষিজমি, বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্কুলসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বন্যায় তলিয়ে যায়।

সিলেট বিভাগে ৯০ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্র জলমগ্ন হয়ে পড়ে, যেখানে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। শিশুরা পানিতে ডুবে যাওয়ার উচ্চ ঝুঁকিতে, যা ইতিমধ্যেই দেশে শিশুমৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। ৩৬ হাজারের বেশি শিশু তাদের পরিবারের সঙ্গে জনাকীর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেয়। স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পরীক্ষা বাতিল করা হয়, যা শিশুদের পড়াশোনাকে আরও বিঘিœত করছে। ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় ইতিমধ্যে ক্ষতির শিকার হয়েছে তারা।

ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার একটি সরকারি স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী সফিয়ার মিয়া। পানিতে ঘর ডুবে যাওয়ায় এ বছরের জুন মাসে পরিবারের সঙ্গে ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি বস্তিতে ওঠে। সফিয়ারের সঙ্গে যখন কথা হয়, তখন সে কেরানীগঞ্জের জাহাজভাঙা ঘাটে এটি জাহাজে বড় শ্রমিকদের সহকারী হিসেবে কাজ করছিল। পাশেই ছিল তাঁর বাবা মোক্তার মিয়া। সফিয়ার বলে, ‘এখানে কঠিন কঠিন কাজ করা লাগে। সকালে কলা আর রুটি খাইতে দেয়। দুপুরে বাড়ি থাইক্যা মা খাবার দিয়া যায়। কাম শ্যাষ হয় সন্ধ্যায়। এরপর রাইতে গা ব্যথা করে।’ স্কুলে যেতে চাও কি না, জানতে চাইলে সফিয়ার বলে, ‘কাজ কইরাই ক‚ল পাওয়া যায় না। স্কুলে যামু কোন সময়?’

সফিয়ারের বাবা মোক্তার মিয়া বলেন, ‘কেউ কি চায় বাড়িভিটা রাইখা চইলা আসতে? আমরা বাধ্য হইয়া ঢাকায় আইছি। আমি পাই দিনে ৫০০ টেকা আর ছেলেটা ১০০। পরিবারে ওর মা, আরও দুই শিশু আছে আমার। বস্তির বাসাভাড়া মাসে তিন হাজার টেকা। এইখানে প্যাট চালাইতে কষ্ট হয়। ওগো স্কুলে দিবার মন চায়, কিন্তু পারতেছি না। আমরা খুব কষ্টে আছি।’

ইউনিসেফ গত আগস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের শিশুরা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চরম ঝুঁকির মুখে পড়েছে। দেশগুলো হলো বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও ভারত। আর বিশ্বজুড়ে ৩৩টি দেশের প্রায় ১০০ কোটি শিশু এমন চরম ঝুঁকিতে পড়েছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়সংক্রান্ত বার্ষিক শুমারিতে গত বছর বলা হয়েছে, দেশে ৬৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। আর শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক কোটির বেশি। কিন্তু গত বছর বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার ১৭ শতাংশের বেশি। সংখ্যার হিসাবে ২০ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনার পাট চুকিয়েছে।

বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) জাতীয় প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে কর্মরত আছেন সৈয়দা মুনিরা সুলতানা বলেন, ‘আমি অনেক মেয়েশিশুকে দেখেছি, যারা বৈরী আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিদ্যালয় ছেড়ে কাজে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছে। কেরানীগঞ্জে মেয়েদের পোশাক তৈরির একটা কারখানায় ১০ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করতে দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম।’

তিনি বলেন, তাদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, বেশির ভাগই দুর্যোগপ্রবণ খুলনা, বরিশাল ও সাতক্ষীরা থেকে এসেছে। আগে সেখানে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করত। এখন ঝরে পড়েছে। সংসারে অর্থ জোগান দিতে কাজ করছে।

নদীবিধৌত দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে দুর্যোগ, বিশেষত ঝড়, বন্যা ও নদীভাঙনের ঝুঁকি তুলনামূলক বেশি। দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগে এসব শিশুকে খেসারত দিতে হয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের অনেকেই।

ইউনিসেফের তথ্যমতে, শহরের বস্তিতে থাকা বেশির ভাগ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যায় না। আর দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার সুযোগ আরও কম। সংস্থাটির গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্রায় ১৭ লাখ শিশু নিষিদ্ধ ও ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত। তাদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের বয়স ১১ বছর কিংবা তারও কম। অনেক মেয়েশিশু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে। তাদের সঠিক তথ্য ও গল্প গবেষণায় যুক্ত করা কঠিন। তা করা হলে সংখ্যাটি আরও বাড়বে।

ঢাকা ও আশপাশের বস্তিতে বসবাস করা বেশির ভাগ শিশু ট্যানারি, লঞ্চ ইয়ার্ড, দরজির দোকান, অটোমোবাইল কারখানায় কাজ করে। অনেকে ফল ও সবজির বাজারে মাল টানা এবং বাসস্ট্যান্ড, লঞ্চঘাট কিংবা রেলস্টেশনে কুলির কাজ করে। তাদের বেশির ভাগ দুর্যোগপ্রবণ বিভিন্ন জেলা থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ঢাকায় এসেছে।

error: Content is protected !!