হোম » প্রধান সংবাদ » প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিদর্শনে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পরিদর্শনে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি

এম এ কাদির চৌধুরী ফারহান: ১১ শত বছর আগে স্থাপিত জুড়ীর সেই কথিত চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অস্থিত্বই খুঁজে পায়নি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল। শ্রীহট্টের প্রাচীনতম চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্বের পুরাকীর্তি সম্পর্কে জানার জন্য তিন দিনের অনুসন্ধানে মৌলভীবাজার জেলায় আসে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ে গঠিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল। কিন্তুু গত তিন দিনে কুলাউড়া, জুড়ী ও রাজনগর উপজেলায় চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিদর্শন বা অস্থিত্ব সম্পর্কে অনুসন্ধান চালিয়ে কোন স্থাপনা বা ধ্বংসাবশেষ উৎঘাটন করতে পারেনি তারা।

 

২৭ জুলাই সোমবার শেষ দিনের অনুসন্ধানে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোঃ আতাউর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দল রাজনগর উপজেলার পাঁচগাও ইউনিয়নের পশ্চিম ভাগ এলাকায় অনুসন্ধান চালায়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সন্ধান না পেলেও ১৯৬০ সালে পশ্চিম ভাগ এলাকার পরেশ পাল (৯০) বাড়ি থেকে প্রত্নলিপি উদ্ধার করা হয়েছে যে এটা তারা নিশ্চিত হয়েছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এবং ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে ওই দলের সাথে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফিল্ড অফিসার মো. শাহিন আলম, সহকারী কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান, গবেষণা সহকারী ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মার্মা।

 

রাজনগর উপজেলার পাঁচগাও ইউনিয়নের উত্তর পশ্চিমভাগ গ্রাম এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই এলাকার বিভিন্ন স্থানে এখনো প্রাচীন মৃৎপাত্রের ভাঙ্গা টুকরো পাওয়া যায়। ১৯৬১ সালে রাজনগরের পাঁচগাঁও ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ গ্রামে ‘শ্রীচন্দ্র পশ্চিমভাগ তাম্রশাসন’ যে স্থানে পাওয়া গেছে, সেই স্থানটি (পরেশ পালের ভিটা) ও যিনি এটি সংগ্রহ করেন সেই পরশ পালকেও খুঁজে পায় অনুসন্ধানে আসা প্রতিনিধি দল। ওই ভিটায় অসংখ্য মৃৎপাত্রের টুকরো দেখতে পেয়ে প্রতিনিধি দল ওই স্থানটিকে সাংস্কৃতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন।

 

এর আগে অনুসন্ধানের দ্বিতীয় দিন রবিবার দিনব্যাপী জুড়ী উপজেলার সাগরনাল দিঘীরপার এলাকায় চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের পুরাকীর্তির বিষয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়। কিন্তুু সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের কোন আলামত মেলেনি। অনুসন্ধান শেষে এলাকার প্রবীণদের সাথে কথাবার্তা বলার পরে দিঘীরপার এলাকাতেই সাংবাদিকদের এ কথা জানান প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. মোঃ আতাউর রহমান।

 

তবে এলাকাবাসীর সাথে কথা বলার সময় ২০ বছরের পুরনো কিছু পুতির পাথর পাওয়া যায় জগদিশ চন্দ্র শর্মা নামের স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে। নরসিংদীর উয়ারী-বটেশ্বর দুর্গ এলাকায়ও এমনি রকম ২৫০০ বছরের পুরনো কাচের পুঁতি পাওয়া গিয়েছিল। সেই রকম পুঁতি জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ইউনিয়নের পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রতিনিধি দল। তবে কাচের পুঁতিগুলো আরও অধিকতর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে গবেষণা করা প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন তারা।

এলাকা পরিদর্শন, অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ করে পুরাকীর্তির কিছু আলামত সংগ্রহ করে প্রতিনিধি দল। তবে সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে প্রতিনিধি দল ধারণা করছেন, এই এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের কোন নিদর্শন ছিল না। তবে প্রাচীন কোন সভ্যতা, ব্যবসায়িক কেন্দ্র  ট্রেড সেন্টার বা কামারের কোন কেন্দ্র থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া অনুসন্ধানের প্রথম দিনে শনিবার বিকেলে কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলকটি পরিদর্শন করে অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ করে প্রতিনিধি দলটি।

 

এসময় তারা ভাটেরার রাজার টিলা এলাকায় ভাটেরা তাম্রফলক পরিদর্শন করে আলামত হিসেবে ইটের ভাঙ্গা টুকরো, পাথর ও পাতিল সংগ্রহ করেন। ভাটেরা টিলায় বড় একটি দিঘী রয়েছে। এই টিলায় অবস্থিত রাজবাড়িতে ৭ ভাই ছিলেন। ৭ ভাইয়ের মধ্যে সর্বশেষ রাজা ছিলেন ঈসান দেব বলে পূর্ব-পুরুষদের কাছ থেকে জেনেছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় ভাটেরা স্কুল এন্ড কলেজের প্রভাষক মোহাম্মদ আলী চৌধুরী তরিক বলেন,

‘কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কলিমাবাদ (সাত বাদশার টিলা/রাজার টিলা) এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলকের নিদর্শনের পুরাকীর্তি অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের মনে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সবাই মনে করছেন এই এলাকায় প্রাচীন রাজাদের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এটা খনন ও অনুসন্ধান করলে হাজার বছরের পুরনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’

প্রতিনিধি দলের প্রধান এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মোঃ আতাউর রহমান তিন দিনের অনুসন্ধান শেষে সোমবার বিকেল পাঁচটায় বলেন, আমরা গত তিন দিনে কুলাউড়া, জুড়ী ও রাজনগর উপজেলায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অস্থিত্ব পাইনি। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পরিদর্শনে এসে অনুসন্ধানের প্রথম দিনে ভাটেরা তাম্রফলক এলাকা থেকে প্রাচীন রাজাদের স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত অনেক পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেছি। এখানে প্রাচীন রাজাদের বসতি ছিল যে সেটা আমরা অনুসন্ধানে নেমে পুরাকীর্তি দেখে বুঝেছি। আগামী শুষ্ক মৌসুমে এই তাম্রফলক এলাকা খনন কাজ শুরু করা হবে।

দ্বিতীয় দিনে জুড়ী উপজেলার সাগরনাল দিঘীরপার এলাকা পরিদর্শন করে স্থানীয় এক ব্যক্তির বাড়িতে সংগ্রহে থাকা পুরাতন পুঁতির পাথরের কিছু স্যাম্পুল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে। তবে এগুলো দেখতে প্রায় ২৫০০ বছরের পুরনো পুঁতির মতোই লাগছে।’ তৃতীয় দিনে রাজনগর উপজেলার পশ্চিমভাগ এলাকায় অনুসন্ধান করেছি। তিনি আরো বলেন, মৌলভীবাজারের ভাটেরা টিলা, রাজনগর পশ্চিমভাগ ও জুড়ীর সাগরনাল এই তিনটি এলাকাতেই প্রাচীন হিন্দু ও বৌদ্ধ সভ্যতার অনেক নিদর্শন ছিলো -তা আমাদের জরিপ ও  অনুসন্ধান করে তা অনুভব করছি।

উল্লেখ্য, গত ১৫ জুলাই ‘চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক স্থাপিত কথিত শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে সরেজমিন জরিপ ও পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রয়োজন’ উল্লেখ করে সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালককে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোঃ হান্নান মিয়া।

 

চিঠিতে ‘কথিত বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি অ্যান্টিকস অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংস্কার-সংরক্ষণের কোনো সুযোগ আছে কিনা এ সম্পর্কে সরেজমিন পরিদর্শন পূর্বক আলোকচিত্র ও মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিলো। জুড়ী উপজেলার সাগরনালে কথিত চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বেশ কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ফলাও করে নিউজ প্রকাশিত হলে দেশ বিদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম নেয়।

Loading

error: Content is protected !!