হোম » সারাদেশ » নওগাঁয় সরিষা ফুল থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ

নওগাঁয় সরিষা ফুল থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ

জাহিদুল হক মিন্টু, নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি: সরিষা ফুলে হলুদ বরণে সেজেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার ফসলের মাঠ। যতদুর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ রঙে মাখামাখি। অন্যের সরিষার ক্ষেতকে কাজে লাগিয়ে মৌবাক্স স্থাপন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু করছে শিক্ষিত বেকার যুবকরা। ক্ষেতের পাশে বা ফাঁকা স্থানে মৌবাক্স স্থাপন করে একদিকে যেমন লাভবান হচ্ছে অপরদিকে ফুলে কৃত্রিম পরাগায়নে ফসলের উপকার হচ্ছে। আগামীতে নওগাঁ জেলা মধু উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে পরিচিতি পাবে। বাণিজ্যিক ভাবে মধু সংগ্রহ সম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। জেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে জেলার ১১টি উপজেলায় ৩২হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

যেখানে ৩৩হাজার ৬৪০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। এ পরিমাণ জমি থেকে এ বছর ২৭ হাজার ৩০০ কেজি মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জেলার মান্দা উপজেলার নুরুল্লাহবাদ ইউনিয়নের কৈইকুড়ি গ্রাম, তেঁতুলিয়া ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রাম ও শংকরপুর গ্রাম, ভারশোঁ ইউনিয়নের ভারশোঁ গ্রামে সরিষা ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছেন মৌচাষিরা। এক সময় কৃষকদের মাঝে ভ‚ল ধারণা ছিল সরিষা ফুলে মৌমাছি পড়লে ফুল নষ্ট হবে এবং ফলন কম হবে।

কিন্তু কৃষকদের সে ধারণা এখন পরিবর্তন হয়েছে। মৌমাছি ফুল থেকে রেণু সংগ্রহ করে। এতে ফুলের পরাগায়ন হয়। ফসলের জন্য এটি খুবই উপকারি এবং ফলন বৃদ্ধি করে। সরিষা মৌসুমে মৌচাষিরা কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছেন। তবে স্থানীয় ভাবে কেউ মধু সংগ্রহ না করলেও রাজশাহী জেলার মোহনপুর উপজেলার দর্শনপাড়া থেকে এসে দুই উদ্যোক্তা মধু সংগ্রহ করছেন কৈকুড়ি ও শ্রীরামপুর গ্রামে। উদ্যোক্ত রুমিনুল ইসলাম রুস্তম কৈকুড়ি গ্রামের মাঠে ১৩০টি এবং শ্রীরামপুর গ্রামেরমাঠে আরিফ হাসান ৬০ টি মৌবাক্স স্থাপন করেছেন। প্রতিটি বক্সে ৮টি করে ফ্রেম সাজানো আছে।

সপ্তাহ পর পর বাক্স থেকে সংগ্রহ করা হয় মধু। মধু সংগ্রহের সময় নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারী পর্যন্ত। তবে তারা এ দুই মাঠে নভেম্বর থেকে জানুয়ারী মাস পর্যন্ত মধু সংগ্রহ করবেন। সরিষা ক্ষেতের পাশে অভিনব পন্থায় ইউরোপিয়ান মেলিফেরা জাতেরমৌমাছি দিয়ে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মৌবাক্স দিয়ে মধু সংগ্রহে ব্যস্ত দেখা যায় তাদের। বয়জ্যেষ্ঠ কৃষক আবুল কাশেম। বাড়ি উপজেলার দোডাঙ্গী গ্রামে হলেও ফসলি জমি কৈকুড়ি গ্রামের মাঠে। তিনি ও তার ছেলে আব্দুল লতিফ মিলে তিন বিঘা দেশী জাতের সরিষা আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, আগে শুনতাম মৌমাছি সরিষা ফুলে পড়লে ফুল নষ্ট হয় এবং ফলনও কম হয়। কিন্তু এখন শুনছি মৌমাছি ফসলের জন্য উপকারি। মৌমাছি ফুলে পড়লে ফুলের পরাগায়ন হয় এবং ফলনও ভাল হয়।

এবছর আবহাওয়া ভাল থাকায় সরিষার আবাদও ভাল হয়েছে। আমার ক্ষেতের পাশেই মৌবাক্সগুলো স্থাপন করা হয়েছে। ফসলের জন্য উপকার হলেও গরু-ছাগলকে সাবধানে রাখতে হচ্ছে। উদ্যোক্তা রুমিনুল ইসলাম রুস্তম বলেন, প্রশিক্ষণ নিয়ে গত ছয় বছর থেকে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছি। প্রথমদিকে বাক্সের পরিমাণ কম ছিল। বর্তমানে খামের ১৩০টি মৌবাক্স আছে। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে মৌবাক্সগুলো স্থাপন করেছি। প্রতিটি বাক্সে ৮টি করে ফ্রেম আছে। এ পর্যন্ত তিনবারে ২৬ মণ মধু সংগ্রহ করেছি। সরিষা মৌসুমে চার মাসে প্রায় ৬০-৭০ মণ মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করেছি।

প্রতিকেজি মধু পাইকারি দাম ৩০০ টাকা কেজি। ১২ হাজার টাকা মণ হিসেবে ৭০ মণের দাম ৮লাখ ৪০ হাজার টাকা। সরিষা মৌসুমে বাড়ি আসা যাওয়া, শ্রমিক ও পরিবহণ খরচ হবে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। তবে সরিষা মৌসুমে বেশি পরিমাণ মধু সংগ্রহ করা হয়। তিনি বলেন, বছরে ৭মাস মধু সংগ্রহ করা হয়। মুলত সরিষা, কালোজিরা ও লিচু ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করেন। আর বাকী সময় মৌমাছিকে রয়েল জেলী খাওয়াইয়ে পুষতে হয়। যেখানে প্রতিমাসে ২০ হাজার টাকা হিসেবে ১লাখ টাকার মতো খরচ হয়। যার মৌবাক্সের সংখ্যা যত বেশি তার খরচও ততো বেশি হবে। সরিষার পর কালোজিরা মৌসুমে ৪০ দিনে ৫মণ মধু সংগ্রহ হয়।

প্রতিমণের দাম ২৫ হাজার টাকা মণ হিসেবে ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দাম। যেখানে খরচ দাঁড়ায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এরপর লিচু মৌসুমে ১মাসে সাতবারে মধু সংগ্রহ ৬০ মণের মতো। যেখানে প্রতিমণের দাম ১২ হাজার মণ হিসেবে দাঁড়ায় ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। আর খরচ হয় প্রায় ৬০ হাজার টাকা। এ বছর প্রায় ১৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকার মধু সংগ্রহ হওয়ার সম্ভবনা আছে। আয় থেকে খরচ হয় প্রায় ১লাখ ৫০ হাজার টাকা। এ মৌসুমে প্রায় ১৫ লাক টাকার মতো আয় হবে বলে জানান তিনি। রাজশাহী থেকে পাইকারি ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন প্রসাধনী তৈরী কোম্পানি এসে পাইকারী কিনেনিয়ে যায়। স্থানীয় চিকিৎসক জুয়েল রানা বলেন, মৌচাষ একটি লাভজনক।

সরিষা মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের মাঠে মৌবাক্স স্থাপন করে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করছে কিছু তরুন উদ্যেক্তারা। এতে করে তারা বেশ লাভবান হচ্ছে। চাকরির পেছনে না ছুটে শিক্ষিত বেকাররা যদি প্রশিক্ষণ নিয়ে উদ্যোক্তা হয় তাহলে তাদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থান হবে। এতে করে দেশের ও দশের উন্নয়ন হবে। নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. শামসুল ওয়াদুদ বলেন, গত বছর সরিষার জমিতে ২০ হাজার ২৩২টি মৌবাক্স থেকে প্রায় ২৬ হাজার ২৪৫ কেজি মধু উৎপাদন হয়েছিল। আবহাওয়া ভাল থাকায় এ বছর সরিষার আবাদ বেশি হয়েছে।

গাছে ফুলও ভাল হওয়ায় এ বছর মৌবাক্সের সংখ্যা আরো বাড়বে। সরিষার উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি ২৭ হাজার ৩০০ কেজি মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশিক্ষিত কিছু মৌ চাষি আছে যারা প্রতি বছর কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরিষা মৌসুমে কৃত্রিম পদ্ধতিতে মধু সংগ্রহ করে। ক্ষেতের পাশে মৌবাক্স স্থাপন করায় ফুলে কৃত্রিম পরাগায়নের ফলে সরিষার ফলনও ভাল হয়। মধু উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা পুরণ হবে।

error: Content is protected !!