হোম » সারাদেশ » সোনাইমুড়ীতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ইশারায় বাড়ে-কমে টেষ্টের ফি!

সোনাইমুড়ীতে স্বাস্থ্য কর্মকর্তার ইশারায় বাড়ে-কমে টেষ্টের ফি!

মোহাম্মদ হানিফ, সোনাইমুড়ী(নোয়াখালী): সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ ইশরাত জাহানের নির্দেশে হাসপাতালের  বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরীক্ষায় নেওয়া হচ্ছে সরকারের নির্ধারিত ফি এর চেয়ে অতিরিক্ত টাকা। আর এই টাকার ভাগ পাচ্ছেন ডাক্তারেরা। ফলে অসহায়-গরিব রোগীদের রোগ শনাক্তে বিভিন্ন টেষ্ট করতে ব্যয় করতে হচ্ছে বাড়তি টাকা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরীক্ষার সরকারি মূল্য তালিকা দেওয়া থাকলেও তা মানা হচ্ছেনা। এক্স-রে, ইসিজি, সিবিসি, প্লাটিলেট চেক, আল্টাসনোগ্রাফি সহ বিভিন্ন টেষ্টে নেওয়া হচ্ছে অতিরিক্ত ফি। আর নিয়মবহির্ভূত ভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায়ের প্রমান ঘোচাতে রোগীদের দেওয়া হচ্ছেনা মূল্য আদায়ের রশিদ।
অভিযোগ রয়েছে কোন ধরনের অভিজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়াই টেকনিশিয়ান তৈরী করে দিচ্ছেন বিভিন্ন টেষ্টের রিপোর্ট। টেকনোলজিষ্ট একাই নিচ্ছেন টাকা, ঠিক করছেন সিরিয়ালের লাইন, সংগ্রহ করছেন রোগীদের স্যাম্পল, আর রিপোর্ট সরবরাহ তিনিই করছেন।
সরেজমিনে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায় দেওয়ালে টাঙ্গানো রয়েছে প্যাথলজি বিভাগ ও এক্স-রে ইউজার ফি এর মূল্য তালিকা। সেখানে উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন টেষ্টের সরকারি মূল্য। তালিকা অনুযায়ী ১৫×১২ সাইজের এক্স-রে ফিল্মের মূল্য ৭০ টাকা, ১২×১০ এবং ১০×০৮ প্রতি ফিল্ম ৫৫ টাকা। প্যাথলজি বিভাগের ২৩টি টেষ্টের মূল্য তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে। তার মধ্যে সিবিস ১৫০ টাকা, সিআরপি ১০০ টাকা, এইসবিএসএজি ১৫০ টাকা, রক্তের গ্রুপ যাচাই ৫০ টাকা, ক্রসম্যাচিং ১০০ টাকা, এস বিলুরিবিন ৫০ টাকা। তবে তালিকায় দেওয়া নির্ধারিত একটি মূল্যও মানা হচ্ছেনা। প্রতিটি টেষ্টে অতিরিক্ত ফি নেওয়া হচ্ছে।
গত মার্চের ২০ তারিখ আলতাফ হোসেন নামের ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন বুকের ব্যাথা, কাশি ও জ্বর নিয়ে। জরুরী বিভাগের চিকিৎসক তাকে দেখে সিবিসি, রক্তের বিলুরিবিন টেষ্ট ও এক্স-রে করতে বলেন। সরকারি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকেই সেগুলো করিয়েছেন তবে সরকারের নির্ধারিত ফি এর বেশি দিয়ে। আলতাফ হোসেন সাথে হাসপাতালে আসা তার ছেলে জানান, সিবিসির নির্ধারিত ফি ১৫০ টাকা থাকলেও দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা, এক্স-রে এর সরকারি ফি ৭০ টাকার পরিবর্তে দিয়েছেন ১২০ টাকা, আর রক্তের বিলুরিবিন পরিক্ষায় ৫০ টাকার জায়গায় দিতে হয়েছে ২৫০ টাকা।
আলতাফ হোসেন ছেলে সেলিম আহম্মেদ অভিযোগ করে জানান, টেষ্ট করতে গিয়ে দেখি ১০৪ নাম্বার রুমের টেকনোলজিস্ট নিজেই টাকা নিচ্ছেন, রোগীদের সিরিয়াল তিনিই ঠিক করছেন, স্যাম্পল সংগ্রহ তিনিই করছেন, আবার পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে তিনিই রিপোর্ট দিচ্ছেন। কোর বিশেষজ্ঞ সেখানে নেই। ট্যাকনিসিয়ান একাই এক’শো। টেষ্টের টাকা দিয়ে তার কাছে ফি পরিশোধের রশিদ চাইলেও দেয়নি তিনি। সরকারি তালিকার চেয়ে অতিরিক্ত ফি নেওয়ার কারন জানতে চাইলে ১০৪ নাম্বার রুমের দায়িত্বরত ওই ব্যক্তিটি দুর্ব্যবহার করেন।
গত তিনমাস পূর্বে সোনাইমুড়ী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা সেবা নিতে আসেন গর্ভবতী নাজমা বেগম। হাসপাতাল থেকে তাকে গর্ভের শিশুর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য  আল্টাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারি ভাবে আল্ট্রাসোনোর ফি ১১০ টাকা নির্ধারিত থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে আদায় করা হয়েছে ৩৭০ টাকা। মূল্য পরিশোধের রশিদ চাইলেও দেওয়া হয়নি তাকে। একই ভাবে নোয়াগাও গ্রামের গর্ভবতী রুপাইয়া আমিন রিয়া নামের মহিলার থেকেও আল্টাসনোগ্রাফি বাবদ ৩৭০ টাকা ফি নেওয়া হয়েছে।
অতিরিক্ত মূল্য আদায়ের এই ঘটনা শুধু আলতাফ হোসেন, নাজমা বেগম কিংবা রূপাইয়া আমিনের সাথে নয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা ও পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে আসা সকলের সাথেই ঘটছে।
জানা যায়, প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার আল্ট্রাসনোগ্রাম করা হয়ে থাকে এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। প্রতি মাসে ১৫০ থেকে ৩০০ জন মহিলাকে এই সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। এছাড়া এক্স-রে, ইসিজি সহ অন্যান্য পরিক্ষা-নিরিক্ষা করাতে আসেন হাজারের বেশি রোগী।৷ আর প্রত্যেকের কাছ থেকেই নেওয়া হচ্ছে এই অতিরিক্ত ফি।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কার্ডিওলজির দায়িত্বে রয়েছেন মুনিয়া আক্তার, ট্যাকনোলজিষ্ট হিসেবে দায়িত্বে আছেন সাইমুন ইসলাম এবং এক্স-রে বিভাগের মোঃ সেলিম।
স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন টেষ্টের ফি নিয়ে কথা হয় মোঃ সেলিমের সাথে। তিনি জানান প্রতি মাসে বিভিন্ন টেষ্টের রেট কখনো বাড়ে কখনো কমে। আর এই বাড়া কিংবা কমার বিষয়টি নির্ধারণ করেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ইশরাত জাহান।
কেন ফি বাড়ে-কমে সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “বিভিন্ন টেষ্টের জন্য ডাক্তারদের ফি দিতে হয়, মেইনটেনেন্স চার্জ আছে। সরকার শুধু মেশিন দেয়, আনুষাঙ্গিক কোন খরচ দেয়না। অতিরিক্ত যে টাকাটা নেওয়া হয় সেখান থেকে ডাক্তারদের রিপোর্ট বাবদ ফি দেওয়া হয়। অতিরিক্ত টাকাটা না নেওয়া হলে মেশিন মেইনটেনেন্স কিভাবে করবো? ডাক্তার যে সেবা দিচ্ছে তার ফি কিভাবে দিবো? সব তো বন্ধ হয়ে যাবে।”
সরকার সকল পরিক্ষার ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং ডাক্তারদেরও বেতন দিচ্ছে তাহলে অতিরিক্ত ফি ডাক্তার কেন নিবেন এমন প্রশ্নে মোঃ সেলিম বলেন, “ডাক্তারেরা ডিউটির বাইরে অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন। ইউএইচও ম্যাডামের নির্দেশে এই অতিরিক্ত টাকাটা নেওয়া হচ্ছে। সরকারি ফি অনুযায়ী টাকা নিলে তো সবকিছু বন্ধ করে দিতে হবে।”
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আরএমও ডাঃ রিয়াজ উদ্দিন বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের বিভিন্ন পরিক্ষা-নিরিক্ষায় অতিরিক্ত ফি নেওয়া হয় এমন অভিযোগ তার জানা নেই। তবে তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখবন।
এ অভিযোগের সত্যতা জানতে সোনাইমুড়ী উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাক্তার ইশরাত জাহানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
নোয়াখালী জেলা সিভিলসার্জন ডাঃ মাসুম ইফতেখার এবিষয়ে জানান, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

Loading

error: Content is protected !!