হোম » মতামত » বঙ্গবন্ধু সেতু (যমুনা সেতু ) ভ্রমণ নিয়ে কিছু কথা

বঙ্গবন্ধু সেতু (যমুনা সেতু ) ভ্রমণ নিয়ে কিছু কথা

মোঃ মনিরুল ইসলাম: ১৯৯৮ সাল, মে মাসের তীব্র গরম উপেক্ষা করে বের হলাম যমুনা সেতু দর্শনের উদ্দেশ্যে আমরা ৬ বন্ধু – আমি, আইনুল, মাসুদ, জসিম, রুহুল ও হেলাল। সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি, আসলে অপেক্ষায় ছিলাম কখন পরীক্ষা শেষ হবে। সম্ববত দিনটি ছিল মে মাসের ১৭ তারিখ। প্রায় ১০০ কিঃমিঃ রাস্তা এবং কয়েক ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে। সঙ্গী মাত্র ৪ টি বাই সাইকেল তারমধ্যে আয়নুল সাইকেল চালাতে পারেনা আর আমি নতুন চালক। যাইহোক সকাল ১০ টার দিকে রওনা দিলাম। মে মাসের তীব্র রোদ মামা যেন আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন, একেতো আমি নতুন চালক তার উপর আইনুল উঠলো আমার সাইকেলে। তারুন্যের আবেগ এবার ঘাম হয়ে গলতে শুরু করলো, কিছুদুর যাই আর বিশ্রাম নেই, শাহবাজপুর বটতলা, কর্নসুতি বটতলা অথ্যাৎ যেখানেই বটতলা সেখানেই আমাদের যাত্রা বিরতি। আমরা পাকা রাস্তা ধরেই যাচ্ছি, রাস্তার দুইপাশে ধানক্ষেত। ধান কাটার মৌসুম তখনো পুরোপুরি শুরু হয় নাই তবে প্রায় অর্ধেকের বেশী ধান পেকে গেছে। সোনালী আর কাচাপাকা ধান বাতাসে দোল খাচ্ছে। মাইলের পর মাইল যাচ্ছি আর বাংলার এই চিরচেনা দৃশ্য দেখতে পাচ্ছি।

পথে যেতে যেতে অনেক মজার মজার স্মৃতি রয়েছে, পথচারী লোক জনের কাছ থেকে বিভিন্ন গ্রাম ও এলাকা সম্পর্কে যেমন তথ্য সংগ্রহ করা তেমনি অনেক লোকের সাথে যেচে যেচে কথা বলা, অনেক পুরনো ঘটনার পুনরাবৃতি করা, অনেক খুনসুটি করা বিশেষকরে আইনুল সাইকেল চালাতে না পারায় ওকে বারবার সাইকেল পরিবর্তন করতে হয়েছে আর তখনই খুনসুটির শিকার হয়েছে ইত্যাদি। একবার এক চাচাকে জিজ্ঞেস করা হলো, চাচা সেতুর উপর উঠেন না ? চাচা বললো ঃ এহানেই থাকবার দেয়না, চাচার এই ডায়ালগটি পরে আমাদের মাঝে ব্যাপক ভাইরাল হয়েছিল, কিছু হলেই আমরা বলতাম ‘এহানেই থাকবার দেয়না’। আসলে দীর্ঘ সময় পর নতুন সিলেবাসের পরীক্ষা শেষ করে আমরা যেন একটা মুক্তি পেয়েছিলাম তাই আনন্দের সীমা ছিলনা।

যাই হোক যমুনা সেতুতে পৌছাতে আমাদের প্রায় দুপুর ঘড়িয়ে গেল। দেখলাম যমুনা সেতুর কাজ তখন প্রায় শেষের দিকে তবু শতশত শ্রমিক কাজ করছে। মুল কাজ শেষ হয়েছে- চলছে আনুষঙ্গিক বিশেষ কাজ ও সৌন্দর্য বর্ধক কাজগুলি – দেখলাম কোরিয়ান হুন্দাই কোম্পানির নিপুন কর্মযজ্ঞের মহাযজ্ঞ। একসময় ব্রিটিশ শ্রমিকরা এদেশের রেলসেতু গুলি নির্মাণ করেছিলেন নিপুন দক্ষতায় তেমনি হুন্দাই কোম্পানি তাদের লোকবল আর বাংলাদেশী শ্রমিকদের সমন্বয়ে গড়ে তুলেছেন যমুনা সেতু নামক এক নান্দনিক শিল্পকর্ম। সেতু ও সেতুর আশেপাশের সংযোগ সড়ক, পরিকল্পিত স্থাপনা সমূহ, নদীর তলা থেকে গড়ে উঠা বাধ, বিস্তির্ন খোলা মাঠ, সংরক্ষিত এলাকা, নদীর স¦চ্ছজল সব কিছুই ছিল দেখার মতো। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এই দৃশ্য দেখার জন্য এখানে আসতেন, আমরাও তাই ঘুরেঘুরে সবকিছু দেখার চেষ্ঠা করলাম। যমুনার জলে মুখ ধুতে ধুতে জসিম বললো এখন থেকে আর কোন মেয়ে বলতে পারবেনা ‘যাও যমুনার জলে মুখ ধুয়ে আসো’। যমুনা সেতু দেখতে অনেকটা ধনুকের মতো সামান্য বাকা, এর কোন ব্যাখা সেদিন খুজে পাই নাই। পরে বুঝেছি এর মধ্যেও রয়েছে সোন্দর্য, নিরাপত্তা ও মেধার মননশীলতা। সেতু উজানের দিকে বাকা হওয়াতে পিলারে পানির চাপ কম পড়বে, পানি সহজে কেটে দুভাগ হয়ে যাবে এছাড়াও আরো একটি কারন হলো সেতুটি পূর্ব-পশ্চিমে অবস্থিত, যদি সোজা হতো তাহলে চালকদের চোখে সরাসরি রোদ পড়তো সেক্ষেত্রে গাড়ী চালাতে অনেক সমস্যা হত। সেতু বাকা হওয়াতে এর দৃষ্টি নান্দনিকতা ও সৌন্দর্যের মাত্রা বহুগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেতুর লাইটগুলি যখন রাত্রে জ্বলতে থাকে তখন সেতুর এই বাকা রুপটি নান্দনিকতার সকল সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং অনেক দূর থেকেও তা দৃষ্টিগোচর হয়।

সেতু যেখানে তৈরী করা হয়েছে (পশ্চিমপাড়) সে এলাকা আমি আগেও দেখেছি। যমুনার সবচেয়ে ভাঙ্গন এলাকা ছিল এটি। একটা সময় যমুনার ভাঙ্গন এতো প্রকট ছিল যে, প্রতিবছর গ্রামের পর গ্রাম নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যেতো উদাহরন হিসেবে চৌহালী উপজেলার কথা বলা যেতে পারে, পুরো উপজেলার সমস্ত এলাকাই কিন্তু যমুনার ভাঙ্গনে সিরাজগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর পূর্বপাড়ে উঠেছে। এছাড়াও কাজীপুর উপজেলার একটা বিরাট অংশ যমুনার চরে অবস্থান করছে অথচ সেই যমুনাকে আজকে অত্যন্ত শান্ত ও নিরিহ মনে হল। এর প্রধান কারন নদীশাসন ও বিস্তীর্ন এলাকাজুড়ে স্থায়ী ও টেকসই বাধ নির্মান। সেতুর প্রতিপাড়ে ১০কিঃমিঃ এলাকা পর্যন্ত বাধের আওতায় আনা হয়েছে। নদীর পশ্চিম পাড়ে ইকো পার্ক, টোল প্লাজা, থানা, রেল ষ্টেশন, বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বিস্তীর্ন এলাকা কিছু নদীর মধ্যে ছিল, ড্রেজার দিয়ে বালি ফেলে নদীর একটা বিশাল অংশকে স্থলভাগের সাথে যুক্ত করে স্থায়ীভাবে বাধ নির্মাণ করার পর সেতু নির্মাণ করা হয়েছে ফলে সিরাজগঞ্জ শহরসহ পুরো সেতু এলাকা একটা নিরাপদ বলয়ের মধ্যে এসেছে।

যমুনা সেতু দেখতে দেখতে এবার আমরা গেলাম সিরাজগঞ্জ কান্দাপাড়া জেলখানা, সেখানে আমাদের বন্ধু মজনু রাজনেতিক মামলায় বন্দি ছিল। জীবনে প্রথমবার গেলাম জেলখানায় কাউকে দেখতে, নিয়মকানুন জানিনা – পুলিশ আঙ্গুল দিয়ে কিছু একটা ইশারা করলেন। আমরা ছাত্র মানুষ পকেটে টাকা পয়সা তেমন ছিলনা, প্রত্যেকে ২ টাকা, ৫ টাকা করে দিয়ে ২০ টাকার বিনিময়ে মজনুকে দেখতে পেলাম। তারপর একরাশ ক্লান্তি ও ভাললাগা নিয়ে বাড়ী ফিরলাম, বাড়ী ফিরে প্রত্যেকেই আমরা পরিবারে কমবেশী জেরার মুখে পড়েছি তার মধ্যে আইনুল অন্যতম।

যাইহোক এর একমাস পর অথ্যাৎ ২৩ জুন ১৯৯৮ স্বপ্নের যমুনা সেতু উদ্বোধন হলো। সেই সময়ে দেশের সর্ববৃহৎ সেতু হিসেবে যাত্রা শুরু করলো। উত্তর বঙ্গের ১৬ টি জেলা এই প্রথম পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চল তথা ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হলো। উত্তরাঞ্চল মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবী ছিল একটা সেতু তার বান্তবায়ন এই যমুনা সেতুর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা পেলো। উত্তর জনপদের প্রবেশদার হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া যমুনাসেতু বিশ্বে ১১তম এবং এশিয়ার মধ্যে ৬ষ্ঠ তম অবস্থানে রয়েছে। ৪.৮ কিঃমি দৈর্ঘ্য ও ১৮.৫ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট সেতুটি নির্মাণে ব্যয় হয় ৩ হাজার ৭৪৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। ১৯৪৯ সালে সর্বপ্রথম সেতুটি নির্মানের দাবি উত্থাপিত হলেও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯৪ সালে নির্মাণ কাজের উদ্ভোদন  হয় এবং ১৯৯৮ সালে এসে তা যাতায়াতের জন্য সম্পূর্নরুপে খুলে দেয়া হয়। সাম্প্রতিক কালে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন নিয়ে যে উচ্ছাস, আবেগ,উদ্দীপনা ও কর্মযজ্ঞ দেখা গেছে যমুনা সেতুকে ঘিরেও কিন্তু জনগনের মাঝে সেই উচ্ছাস, আবেগ, আনন্দ কোন কিছুরই কমতি ছিলনা বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশী ছিল। সেতু উদ্বোধনের পর থেকে টানা কয়েকমাস দর্শনার্থীর পরিমান এতো বেশী ছিল যে রীতিমতো পুলিশ নামিয়ে তা নিয়ন্ত্রন করতে হয়েছে। আজ থেকে ২৬ বছর আগের কথা তবুও সেই সময়ে আমাদের গ্রামের খোকন নামের একটি ছেলে সেতু এলাকায় শুধুমাত্র হকারী করেই লক্ষাধিক টাকা আয় করেছিল।

সেতু উদ্বোধন হলো, ১০ টি বছর আবেগে আবেগে কেটে গেল তারপর স্বপ্নের যমুনা সেতুতে ফাটল ধরা পড়লো। এ ফাটল শুধু সেতুর দেহে নয় গোটা উত্তরবঙ্গ তথা দেশের ১৬ কোটি মানুষের প্রাণে চির ধরিয়ে দিলো। পরবর্তি ২ বছরে এ ফাটল আরো ৫০ শতাংশ বেড়ে গেলো, যে সেতুর আয়ুষ্কাল ধরা ছিল ১০০ বছর সেই সেতু কিনা মাত্র ১০ বছরে এসে রুগ্ন হয়ে গেল। দেশের এতো বড় সম্পদ আদৌ টিকবে কিনা তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলো। কারন হিসেবে সেতুর একপাশে রেল বসানোর বিষয় টি যৌত্তিক ছিলনা কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিলো। গত দের যুগ ধরে যমুনা সেতুতে একপ্রকার ঝুকি নিয়েই ট্রেন চলাচল করছে, এইতো সেদিন ট্রেনে করে ঢাকা যাচ্ছি আর উদ্বিগ্ন হৃদয় নিয়ে সেতুকে জিজ্ঞাসা করছি ‘প্রিয় সেতু তুমি ভাল আছতো’। বর্তমানে যমুনা সেতুতে খুব ধীর গতিতে ট্রেন চালানো ও এক্সেল লোড নিয়ন্ত্রক দিয়ে যানের ভার ও গতি সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। আশার কথা হলো সাম্প্রতিক সময়ে জাপানের সহযোগীতায় যমুনা সেতুর সমান আর একটি রেলসেতু নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে ২০২০ সাল থেকে এবং ২০২৪ সালে এর নির্মাণ কাজ শেষ হবে। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ডাব্লিউ ডি-১ ও ডাব্লিউ ডি-২ নামে দুটি প্যাকেজে জাপানি ৫ টি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্পটি বান্তবায়ন করছে। সেতুটি নির্মানে জাপান, অষ্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম, নেপাল ও বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কর্মী দিনরাত কাজ করছেন। যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে দুটি রেল লাইন বিশিষ্ট এই রেলসেতুর কাজ বলতে গেলে প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এটি চালু হলে ১০০ থেকে ১২০ কিঃমিঃ বেগে ট্রেন চলতে পারবে কোন প্রকার বিরতি ছাড়াই। বর্তমানে যমুনা সেতু দিয়ে ৩৮ টি ট্রেন চলাচল করছে রেল সেতু চালু হলে প্রতিদিন ৮৮ টি ট্রেন চলবে। আরও আশার কথা হলো যমুনা সেতু কে ঘিরে দুই পাড়ে পর্যটন খাতের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে। সেতুর পশ্চিমপাড়ে রয়েছে প্রাকৃতিক নৈস্বর্গিক খ্যাত বঙ্গবন্ধু যমুনা ইকোপার্ক ও সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম। পর্যটনস্পট ও পিকনিকস্পট হিসেবে এটি বহুলভাবে পরিচিত। পশ্চিম পাড়ের পাশাপাশি পূর্ব পাড়েও গড়ে উঠেছে হোটেল, রিসোর্ট, পর্যটন কেন্দ্র, সেনানিবাস প্রভৃতি। এক সময়ের এই অবহেলিত জনপথ হয়ে উঠেছে দেশের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালুর সময় এর ব্যয় ভার পরিশোধ করার সময় সীমা ছিল ২৫ বছর। নির্ধারিত সময়ের ৭ বছর বাকী থাকতেই সেতুর টাকা সম্পূর্নরুপে পরিশোধ হয়েছে। বর্তমানে যমুনা সেতু থেকে প্রতিদিন গড়ে কোটি টাকার উপরে টোল আদায় হচ্ছে এবং বছরে আয় হচ্ছে ৪০০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা।

লেখক,

মোঃ মনিরুল ইসলাম
সিনিয়র অফিসার, জনতা ব্যাংক পিএলসি.
এরিয়া অফিস,রাজশাহী।

ছবিঃ সংগৃহিত

Loading

error: Content is protected !!