হোম » জাতীয় » ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া; বায়ুদূষণে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ জনের মৃত্যু

ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া; বায়ুদূষণে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার ৪শ জনের মৃত্যু

tuhin nizam

এমডি আবু আলীঃ ঢাকার বাতাসে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া। ৭ থেকে ১০টি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সন্ধান মিলেছে ঢাকার বাতাসে। এসব ব্যাকটেরিয়া মানবদেহের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করছে। সঙ্গে চরম বিপজ্জনক বায়ুদূষণ তো আছেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেগাসিটি ঢাকার ২ কোটিরও বেশি বাসিন্দা বিপজ্জনক বায়ুদূষণের মধ্যে বসবাস করছেন। এখন বছরের বারো মাসই ঢাকার বাতাসে বিষ থাকছে। বিশেষ করে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত পুরো সময় দূষণের মাত্রা বেশি থাকে। বিশ্ব এয়ার কোয়ালিটি প্রতিবেদন অনুয়ায়ী, দেশে প্রতিবছর এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বৈশ্বিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত রবিবার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্যে ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ৩২৩ মাইক্রোগ্রাম, যা স্বাভাবিকের চেয়ে ৫ গুণ বেশি। সব থেকে বেশি দূষণ ছিল নারায়ণগঞ্জের বাতাস। সেখানকার বাতাসে দূষণের মাত্রা ছিল ৩৪৮ মাইক্রোগ্রাম।

গবেষকরা বলছেন, চলমান মেগা প্রকল্প, যানবাহনের কালো ধোঁয়া, নির্মাণাধীন স্থাপনা, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ইটভাটা, বসতবাড়ি ও কলকারখানার বর্জ্যসহ নানাবিধ কারণে ঢাকার বাতাস দূষিত হচ্ছে। এসবের ফলে রাজধানীর বাতাসে যুক্ত হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সিসা, নাইট্রোজেন, হাইড্রোকার্বন, বেনজিন, সালফার ও ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্টস। জ্বালানির দহন, বনভূমি উজাড় প্রভৃতি কারণে বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে তুলছে। ঢাকার এমন বায়ু স্বাস্থ্যের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলছে। ফুসফুসের নানা রোগ, নিউমোনিয়া, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিলতায় পড়ছেন নগরবাসী।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণ যন্ত্র দিয়ে বায়ুর মান মাপা হয়। মূলত বাতাসে অতি সূ² বস্তুকণা পিএম ২.৫-এর পরিমাণ পরিমাপ করে বায়ুর মান নির্ধারণ করা হয়। এয়ার ভিজ্যুয়ালের হিসাবে, বায়ুর মান ০ থেকে ৫০ থাকলে ওই স্থানের বায়ু ভালো। আর মান ২০০ থেকে ৩০০-এর মধ্যে থাকা মানে খুবই অস্বাস্থ্যকর। বায়ুর মান ৩০০-এর বেশি থাকা মানে ওই স্থানের বায়ু ‘বিপজ্জনক’। তবে সা¤প্রতিককালে ঢাকার বাতাসে ব্যাকটেরিয়ার সন্ধান পেয়েছে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্র। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার আমাদের সময়কে বলেন, অন্যান্য দূষণের সঙ্গে ঢাকার বাতাসে ৭ থেকে ১০ রকমের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। যেটি মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। শহরের রাস্তার ধারের ড্রেনগুলো অধিকাংশ খোলা থাকে। ফলে সেগুলো থেকে বাতাসে ব্যাকটেরিয়া মিশছে।

বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করা গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, ঢাকার বায়ুদূষণের অন্যতম উৎস হচ্ছে ধুলাবালি। এসব ধূলিকণা মুখে গেলে মানুষ যত্রতত্র থুতু ও কফ ফেলে। তা আবার ধুলার সঙ্গে মিশে নানা মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। আরেকটি উৎস হলো- কয়লা ও জৈব জ্বালানি পোড়ানোর পাশাপাশি শহুরে যান্ত্রিকসহ নানা উৎস থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া ও ধুলা। এসব বাতাসে ক্ষুদ্র কণা ছড়ায়, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

ঢাকার ধুলাদূষণ নিয়ে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষণা আছে। তাতে দেখা গেছে, ঢাকা শহরের গাছপালায় প্রতিদিন ৪৩৬ টন ধূলিকণা জমে। সেই হিসাবে প্রতিমাসে ১৩ হাজার টন ধুলা জমার হিসাব পেয়েছেন গবেষকরা। এ জমে থাকা ধুলা দিনের বেলা বাতাসের সঙ্গে মিশে যেমন দূষণ বাড়ায়, তেমনই রাতে গাড়ির অতিরিক্ত গতির সঙ্গে বাতাসে উড়তে থাকে। ফলে দিনের বেলার চেয়ে রাতের বেলায় বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে যায়।

গত নভেম্বরে বিশ্ব এয়ার কোয়ালিটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বায়ুদূষণের কারণে দেশে মানুষের গড় আয়ু প্রায় তিন বছর কমছে। দেশে প্রতিবছর এক লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। শিশুদের অ্যাজমা রোগ বেড়ে যাচ্ছে, অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশে জিডিপির পাঁচ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে ২০২০ সালে বিশ্বে ৭ মিলিয়ন মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। আর আর্থিক ক্ষতি হয়েছে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন। একিউআই বিশ্বের ১০৬ দেশের বায়ুদূষণ নিয়ে কাজ করছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) তথ্য পর্যালোচনায় বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের প্রথম স্বীকৃতি পেয়েছে ঢাকা। বছরের পুরো সময়টায় রাজধানী ঢাকা বিশ্বের প্রথম বা দ্বিতীয় দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে অবস্থান করে। গত ডিসেম্বরেই বেশ কয়েকবার শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে ঢাকার নাম। যার অর্থ ঢাকার বাতাসের মান চরম মাত্রায় ‘অস্বাস্থ্যকর’।

পরিবেশ অধিদপ্তরে নির্মূল বায়ু ও টেকসই উন্নয়ন প্রকল্পের বাতাসের মান পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৪ সালে ১৬৫ দিন রাজধানীর বায়ু বিপজ্জনক পর্যায়ে ছিল। পর্যায়ক্রমে দূষণের মাত্রা বাড়ছে। ২০১৫ সালে দূষণের মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮ দিন। এর পর ২০১৬ সালে দূষণ ছিল ১৯২ দিন। আর ২০১৭ সালে ২১২ দিন পর্যন্ত দূষণের কবলে ছিল ঢাকার মানুষ। এর পর ২০১৮ সালের ২৩৬ দিনই ছিল ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা চরম বিপজ্জনক। ২০১৯ সালে ২৮৩ দিন দূষণের কবলে থাকে ঢাকার মানুষ। ২০২০ ও ২০২১ সালে সারাবছরই বায়ুদূষণে শীর্ষে বাংলাদেশ। রাজধানী ঢাকায় বায়ুদূষণ রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালে একাধিকবার হাইকোর্ট হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের সচিবদের তলব পর্যন্ত করেন হাইকোর্ট। পরিবেশ অধিদপ্তর ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে জরিমানা আদায় করলেও থামেনি দূষণ কার্যক্রম। দূষণের লাগাম টেনে ধরতে দেশে বর্তমানে প্রায় ৬ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর আগে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশে নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেস) শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে ৮০২ কোটি টাকা প্রদান করে।

স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়নকেন্দ্রের অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, দিনের পর দিন বায়ুদূষণ বাড়ছে। ঢাকা ছাড়াও সারাদেশে বায়ুদূষণের পরিমাণ বাড়ছে। ঢাকা তো প্রায় বসবাসের অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। বায়ুদূষণে স্বাস্থ্য ও আর্থিক খাতের ক্ষতি বিবেচনায় সরকার নির্মূল বায়ু আইন না করে শুধু নীতিমালা করার কথা বলছে। সারাদেশের জন্য আইন করা প্রয়োজন। খ-িত পদক্ষেপ কখনো সুফল বয়ে আনতে পারে না। তিনি বলেন, এতদিন আমরা মনে করতাম, ইটভাটা হচ্ছে ঢাকার বায়ুদূষণের ৬০-৬৫ শতাংশ উৎস। কিন্তু বায়ুদূষণকারী উপাদানগুলো বিশ্লেষণ করে এখন মনে হচ্ছে, রাজধানীতে বিপুল পরিমাণে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও সীমান্ত পেরিয়ে আসা দূষিত বায়ু ঢাকা শহরের বাতাসকে বিষিয়ে তুলছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুস সোবাহান বলেন, এক সময় ইটভাটাকে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ মনে করা হলেও এখন যানবাহনের কালো ধোঁয়াকেই বায়ুদূষণের সব থেকে বড় কারণ মনে করা হচ্ছে। এ ছাড়া বাস্তাঘাট খোঁড়াখুঁড়ি, চলমান মেগা প্রজেক্ট, বর্জ্যসহ নানা কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে। বায়ুদূষণ রোধ করা যাদের দায়িত্ব তাদের অবহেলা দায়ী। কারণ যানবাহনের সনদ দেওয়ার দায়িত্ব বিআরটিএর। কিন্তু ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোও সনদ পেয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া প্রতিবছর ঢাকার যানবাহন বাড়ছে। ফলে পুরনো যানবাহনের সংখ্যাও বাড়ছে। সিটি করপোরেশনের দায়িত্বহীনতাও আছে। আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। একই সঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশনকে তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হতে হবে। না হলে বায়ুদূষণ রোধ সম্ভব না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. আহম্মদ পারভেজ জাবীদ বলেন, বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় শিশুরা। দূষিত বায়ুসেবনের কারণে অ্যাজমা ও সিওপিডি (ক্রনিক অবজট্রাক্টিভ পালমোনারি ডিজিজ) এসব রোগে আক্রান্তরা অতিরিক্ত কার্বন মিশ্রিত কার্বণ গ্রহণ করলে স্বাভাবিক শ্বাস প্রশ্বাস কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়। এতে তাদের শ্বাসকষ্ট এমনকি ক্ষেত্র বিশেষ রেসপারেটরি ফেইলিউর হতে পারে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল মোতালিব বলেন, ঢাকাসহ আশপাশের বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণ কমানোর জন্য ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা চলছে। বছর ধরে উন্নয়নমূলক কাজ অব্যাহত থাকায় সারাবছরই দূষণ হচ্ছে। দূষণ রোধে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান আছে। দূষণ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা চলছে। এ জন্য সবার মধ্যে সচেতনতা প্রয়োজন। যেখানে-সেখানে নির্মাণসামগ্রী ফেলে দূষণ করা হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলোর কালো ধোঁয়া বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। আমরা মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে চেষ্টা করছি। ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত ৪৬৬টি ফিটনেসবিহীন যানবাহন বন্ধ করা হয়েছে। ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা। একই সময়ের মধ্যে ১০০৭টি ইটভাটা উচ্ছেদ করা হয়েছে। জরিমানা করা হয়েছে ৪৫ কোটি টাকা।

error: Content is protected !!