হোম » জাতীয় » এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আইএলও গভর্নিং বডির সদস্য হচ্ছে বাংলাদেশ

এবার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আইএলও গভর্নিং বডির সদস্য হচ্ছে বাংলাদেশ

বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডির সদস্য হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। মধ্য এশিয়া সাব-গ্রুপ থেকে গভর্নিং বডির সদস্য হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে বাংলাদেশ এবং ওই গ্রুপে অন্য কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় নির্বাচন হয়নি। আগামী শুক্রবার (৭ জুন) আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৪-২৬ মেয়াদের গভর্নিং বডির পূর্ণ সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের নাম ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

আইএলও জাতিসংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা। এ সংস্থাটির নীতিনির্ধারকদের একটি দেশ হলে আইএলওতে চলমান মামলায় বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পাবে।

২০১৯ সালে কয়েকটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংস্থার অভিযোগে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আইএলও সনদের আর্টিকেল ২৬ ধারা মোতাবেক মামলা হয়। তাদের অভিযোগ ছিল, বাংলাদেশ ৮১ (ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন বা কারখানা পরিদর্শন), ৮৭ (ফ্রিডম অব অ্যাসোসিয়েশন বা সংগঠনের স্বাধীনতা) ও ৯৮ (রাইট টু অর্গানাইজ অ্যান্ড কালেকটিভ বারগেইনিং বা সংগঠিত হওয়া ও দরকষাকষির অধিকার) কনভেনশন অনুসমর্থন করলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

পাঁচ বছর ধরে একটি রোডম্যাপের বিষয়ে বাংলাদেশ ও আইএলও সম্মত হয় এবং মামলাটির নিষ্পত্তির সুরাহার চেষ্টা চলছে। বিষয়টি নিষ্পত্তি না হলে শ্রমাধিকার বিষয়ের বাইরে বাণিজ্য সুবিধা এবং বাজার প্রবেশাধিকার বিষয়ে এর প্রভাব পড়তে পারে, যা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশ চাইছে তার বিরুদ্ধে শুনানি বন্ধ করতে এবং গভর্নিং বডির সদস্য হওয়ার ফলে বাংলাদেশ কিছুটা সুবিধা পাবে।’

বৃহত্তর প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব সবসময় সরব ছিল। ২০১২ সালে তাজরিন ফ্যাশন অগ্নিকাণ্ড এবং ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পরে সারা বিশ্ব শ্রম পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য বিভিন্নমুখী পরামর্শ দেয়।  সামর্থ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ সেটি করার চেষ্টা করে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে সমালোচনা করলেও কেউ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ যে যৎসামান্য জিএসপি সুবিধা পেতো যুক্তরাষ্ট্রে, সেটি বাতিল করা হয়।

নাগরিক অধিকার যেমন- গণতন্ত্র, নির্বাচন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন মানবাধিকার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অত্যন্ত সরব হলেও সম্প্রতি শ্রমাধিকার বিষয়টিকে তারা সামনে নিয়ে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র যেসব আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা দেয়, যেমন- মার্কিন ডেভেলপমেন্ট ফাইনান্স করপোরেশন থেকে ঋণ সুবিধা বা ওই দেশের বাজারে অগ্রাধিকার সুবিধা পাওয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত করেছে মার্কিন প্রশাসন।

যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নিজস্ব রিপোর্টের পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে আইএলও যে রিপোর্ট দেয়, সেটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেয়।

এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘বড় দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে বাংলাদেশের শ্রম পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে থাকে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় সবদেশই শ্রম পরিস্থিতি বিষয়ে জানার জন্য আইএলও’র রিপোর্টের ওপর নির্ভরশীল। ফলে আইএলও’র রিপোর্টে ইতিবাচক মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য ভালো।’

চলমান শুনানি

২০১৯ থেকে কয়েকটি কনভেনশন লঙ্ঘনের জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে শুনানি চলছে। ছয়টি শ্রমিক প্রতিনিধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ করে। একাধিকবার বাংলাদেশ এটি সুরাহা করার চেষ্টা করলেও তেমন সুফল পায়নি। এক বছর আগেও যেখানে অল্প কয়েকটি দেশ বাংলাদেশের শুনানি বন্ধের পক্ষে বলেছিল, গত মার্চের শুনানিতে বেশিরভাগ দেশ শুনানি বন্ধের পক্ষে মত দিয়েছে। মাত্র চারটি দেশ সরাসরি অথবা পরোক্ষভাবে শুনানি অব্যাহত রাখার পক্ষে বলেছে।

এ বিষয়ে একজন কূটনীতিক বলেন, ‘বহুপাক্ষিক ব্যবস্থায় বন্ধুদের সহায়তা নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমরা বন্ধুদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করছি এবং তাদের দিয়ে বলানোর চেষ্টা করছি, যাতে করে শুনানি বন্ধ হয়।’

যুক্তরাষ্ট্র ও গুটিকয়েক পশ্চিমা দেশের যে আপত্তি, সেটিও কমানোর জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আইএলও গভর্নিং বডির সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এক্ষেত্রে আরও ভালো ভূমিকা রাখতে পারবে।’

নির্বাচন ছাড়াই গভর্নিং বডির সদস্য

আইএলও’র ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট গভর্নিং বডির মধ্যে ২৮টি সদস্য হচ্ছে রাষ্ট্র, ১৪টি শ্রমিক প্রতিনিধি এবং ১৪টি হচ্ছে মালিকপক্ষের প্রতিনিধি। এর বাইরে ৫৬টি ডেপুটি মেম্বার রয়েছে। কিন্তু তারা মতামত দিতে পারলেও ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে না।

২৮টি সদস্যের মধ্যে ১০টি হচ্ছে স্থায়ী সদস্য, অর্থাৎ তারা সবসময়ের জন্য সদস্য থাকবে এবং বাকি ১৮টি রাষ্ট্র সদস্য ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী, বিভিন্ন গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হয়। বাংলাদেশ মধ্য এশিয়া (সেন্ট্রাল এশিয়া) সাব-গ্রুপের সদস্য এবং এখানে ভারত, ইরান, পাকিস্তানসহ আটটি সদস্য রয়েছে। এদের মধ্যে ভারত স্থায়ী সদস্য এবং অন্য একটি দেশ নির্বাচনের মাধ্যমে গভর্নিং বডির সদস্য হয়।

আইএলও’র গভর্নিং বডির সদস্য হওয়ার জন্য গত বছর জেনেভায় বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন তৎপরতা শুরু করে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য অনুমোদন দেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

এ বিষয়ে একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রথম থেকেই আমাদের উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচন পরিহার করার। এর কারণ হচ্ছে নির্বাচন হলে আইএলও’র ১৮৩টি দেশের সবার কাছে ভোট চাইতে হবে, যার জন্য শ্রম ও অর্থের প্রয়োজন। এছাড়া পূর্ণ সদস্য হতে আগ্রহী দেশগুলোর সঙ্গে বিভাজন তৈরি হওয়ার একটি ঝুঁকি রয়ে যায়।’

এবারে ইরান পূর্ণ সদস্য হওয়ার জন্য আগেই আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং সে কারণে বিষয়টি কিছুটা জটিল হয়ে যায় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা ইরান, পাকিস্তান এবং অন্য চারটি দেশের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করে তাদের নির্বাচন না করার জন্য প্রস্তাবে রাজি করাতে সক্ষম হয়েছি।’

বাংলাদেশ তাদের একটি ফর্মূলা দেয়, যার অধীনে এবারেরটাসহ আগামী আট সাইকেল অর্থাৎ ২৪ বছর কে কবে পূর্ণ সদস্য হবে, সেটি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ, ইরান ও পাকিস্তান দুই বার করে সদস্য হবে এবং বাকি চারটি ছোট দেশকে সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হয় বলে তিনি জানান।

জেনেভায় স্থায়ী প্রতিনিধির বিচক্ষণতার ফলে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদী নির্বাচন জটিলতা, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভোট নিয়ে দর কষাকষি পরিহার এবং বাড়তি অর্থ ও শ্রমের ব্যয় বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন বলে তিনি জানান।

Loading

error: Content is protected !!