হোম » সাহিত্য » রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যার জীবননীতিই রাজনীতি

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ যার জীবননীতিই রাজনীতি

শাহজাহান সাজু: আব্দুল হামিদ বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি তার আত্মজৈবনিক বই, “আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি” তবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর মতোই অসমাপ্ত। কারণ এতে ১৯৪৪ সাল থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রযন্ত তাঁর জীবনের মাত্র ২৭ বছরের বয়ান আছে। বঙ্গবন্ধুর আর সুযোগ ঘটেনি সমাপ্ত করবার, কিন্তু মোঃ আবদুল হামিদের সুযোগ রয়েছে সমাপ্তি টানবার। আমরা পাঠকেরা অপেক্ষায় রইলাম।
যে বয়সে লোকে জীবনের যাত্রা শুরু করে, সেই বয়সে লেখক জীবনের বীর রসে সিক্ত হয়েছেন। ফলে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ২৮ বছর ১০ দিনের গল্পটা হয়ে উঠেছে শতাব্দির গল্প, মহাকালের গল্প। যা মূলত ভাটিশার্দূলের মহাজীবনের গল্প। যাতে ব্যক্তি থেকে পরিবার, পরিবার থেকে সমাজ, সমাজের মূলের উৎস সন্ধান থেকে হাওড়-বাওড়ের অলিগলি পেরিয়ে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের কথা বলেছে।
শুরুতেই তিনি জানিয়েছেন- ‘পরীক্ষার প্রয়োজন ছাড়া ছাড়া লেখালেখি খুব একটা করিনি। জীবনে বড়ো কোনো প্রেমপত্রও লিখিনি’। নিজের জবানীতে তিনি ‘রাজনীতির মানুষ, মজলিসি মানুষ’। ফলে অনুমান করা সহজ যে, বক্তব্য-বিবৃতি-আড্ডা এসবেই জীবনের গতি সঞ্চারিত হয়েছে। কিন্তু না, আত্মজীবনীতে তিনি শুধু নিজের কথাই বলেন নি। পুরো হাওড়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন। সেখানকার জনবসতির গোড়াপত্তনের সুলুক সন্ধান করেছেন। হাওড়াঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতির ইতিহাসসিদ্ধ বয়ান হাজির করেছেন।
আত্মজৈবনিক বয়ানে লেখক ভাটি অঞ্চলের উৎস-মূলের সন্ধান করেছেন, প্রাণ ও প্রকৃতির সন্ধান করেছেন এবং মাটি ও মানুষের ইতিহাস জানিয়েছেন। এসব অনুসন্ধান করা আত্মজীবনীর চিরাচরিত রেওয়াজ না হলেও সম্প্রতি এরকম আরেকটি আত্মজীবনী পড়েছি ড আকবর আলি খানের পুরানো সেই দিনের কথা, এতে অবশ্য প্রয়োজনীয় রেফারেন্স দেয়া আছে। পুরানো সেই দিনের কথাও অসমাপ্ত এবং খান সাহেব জানিয়েছিলেন দ্বিতীয় খণ্ড মৃত্যুর পরে বেরোবে, মৌলানা আজাদের মতো। মোঃ আবদুল হামিদের লেখায় শুরুতে মনে হয় একজন ইতিহাসবিদের অনুসন্ধানী প্রবন্ধ পাঠ করছি।
ধীরে ধীরে লেখক ফেলে আসা দিনগুলোতে ‘ধীরে বহে বুড়িগঙ্গা’য় পাঠককে নিয়ে যাবনে এবং সেখান থেকে উত্তাল সমুদ্র তরঙ্গের মধ্য দিয়ে ‘বন্দরের কাল হলো শেষ’ এভাবে পাঠককে নানান গলি-গুপচির আঙিনায় হাঁটিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পৌঁছে দিয়েছেন।
আত্মজবানীতে সাধারণত ব্যক্তির চোখ দিয়ে চারপাশকে দেখা হয়। সত্য-মিথ্যার প্রসঙ্গ অবান্তর। লেখক আবদুল হামিদও চারপাশ দেখেছেন এবং পরিবারের কথা, বেড়ে ওঠার কথা, রাজনীতির কথা বলেছেন। হাওড়াঞ্চল মিঠামইনের ঘোড়াউত্রা নদীর পাড়ের কামালপুর গ্রামের মানুষ লেখক। হাওড়, নদী ও ঘোড়া এই ত্রয়ীর প্রভাবে সরল-গরলের এক সমৃদ্ধ মানুষ মোঃ আবদুল হামি। যাকে ষাটের দশকেই কিশোরগঞ্জের মানুষেরা ভালোবেসে নাম দিয়েছে ভাটিশার্দূল, বঙ্গবন্ধু যাকে আদর করে ডাকতেন কিশোরগঞ্জের কিশোর-হামিদ, তাঁরই আত্মজৈবনিক বই আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি। হাওড় কিংবা নদীর পাড়ের মানুষের জীবনের নানান ঘটনার মধ্যে গ্রাম হাড়িয়ে যাওয়া, বাড়ি তলিয়ে যাওয়া এসব সাংবাৎসরিক ঘটনা। মানুষের জীবনেও এমন ঘটে। বহুকিছু হারিয়ে যায়।
লেখকের জীবনেও এমন হারাবার ঘটনা এক নয় একাধিক। লেখক নিজেই দেখেছেন পাশের গ্রাম মহেশপুর, কালিপুর, খিদিরপুর, বরুনপুর, নয়াহাটি ও খিলাপুর গ্রাম বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হয়ে গেছে অতীতের গহ্বরে। লেখক হারাতে চান না, তাই সম্ভবত আত্মজীবনী লিখে থাকবেন। জিনে ধরা মায়ের সন্তান তাঁর পিতার প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘সকল দিক থেকেই আমার বাবা ছিলেন একজন সফল মানুষ। কৃষি, ব্যবসাসহ প্রতিটি পেশাতেই সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে গেছেন’।
নিজে বাঁচলে বাপের নাম প্রবাদটি যথার্থভাবে প্রযোজ্য। পূর্বপুরুষের কথা বলতে গিয়ে জানিয়েছেন ‘আমার নিজ বংশটিও তৎকালীন ঢাকা বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে এসেছে।’ ভাটির বুক ভাসায় বানে, মন ভাসায় গানে; অর্থাৎ আবদুল হামিদ ভাটির মানুষ, বুকসাঁতারের মানুষ, বানের মানুষ, মনের মানুষ এবং গানের মানুষ। এইসব-মিলিয়ে তিনি একজন খাঁটি রাজনৈতিক মানুষ। যার বালক বয়সটা তাঁর ভাষায় ‘গণ-পাঠশালাতে অসীম আনন্দে কেটেছে’। গৃহস্থ ঘরের সন্তান হিসেবে হাওড়ের দাওয়াইল্লা-কামলাদের সঙ্গ, ভৈরব ও নিকলিতে স্কুলজীবনে হোস্টেল ও আত্মীয়বাড়ির লজিং, কলেজ জীবনেও হোস্টেল এবং আশ্চর্যজনকভাবে দেখি সংসদীয় জীবনেও এমপি হোস্টেলের আবাস তাঁর প্রায় চিরসঙ্গী।তাঁর শৈশবের প্রথম প্রেম তামাকপ্রীতি সহস্রবারের চেষ্টাতেও ছাড়তে না পারলেও ব্রজবালাদের প্রেমের সলিল সমাধি বানিয়ে রাশিদা খানম জ্যোৎস্নার প্রেমে বন্দি কারাগারে আছেন তিনি। তাই বলে আদিরস সম্পর্কে লিখেন নি তা নয়। বরং অনেকটা খোলামেলা-ই লিখেছেন। সেই ষাটের দশকের ব্রজবালাদের একজনের সাথে কয়েক বছর আগের ফোনালাপ প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, ‘হামিদ ভাই, তোমার রসিকতার মাত্রা ছাড়াচ্ছে কিন্তু।’ স্কুলজীবনে সাঁতারে জেলা চ্যাম্পিয়ন, ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বুকসাঁতারে চ্যাম্পিয়ন আবদুল হামিদ ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সাঁতারেও প্রথম হয়ে দেশের ‘প্রথম নাগরিক’ হয়েছেন। এ-যেন দেবেন সিকদারের ‘গল্পের চেয়েও রোমাঞ্চকর’।
১৬ ভাইবোনের মধ্যে ৭ জন ছোটো বয়সেই মারা যান। এলাকার ভাষায় ‘মইল্লা’ মোঃ আবদুল হামিদ মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম রাজনীতির স্পর্শ পেয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে লেখক তখন ভৈরব কেবি হাই স্কুলে পড়েন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভৈরবের ঈদগাঁ মাঠে জনসভায় গিয়েছিলেন। স্কুল পড়ুয়া কিশোর আবদুল হামিদ সেই প্রথম শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেখেন, ভাষণ শোনেন। লেখক জানিয়েছেন ‘এটিই আমার জীবনে প্রথম রাজনীতির স্পর্শ লাভ’। যেমনটা ১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয় এবং তখন থেকেই স্নেহ ও সান্নিধ্য লাভ করতে শুরু করেছিলেন।
মোঃ আবদুল হামিদ রাজনীতির স্পর্শ পেলেও তখনও নেতার স্পর্শ পান নাই। এজন্য আরও সাত বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সাথে ১৯৬৪ সালে প্রথম সাক্ষাতের কথা লিখেছেন এভাবে ‘সম্ভবত মার্চ মাস হবে। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব কিশোরগঞ্জ আসছেন। রাজনৈতিক দল তথা আওয়ামী লীগের মধ্যে গুঞ্জন। বাইরে তেমন একটা আওয়াজ নেই। … আমি সভার কথা শুনে গুরুদয়াল কলেজ থেকে দু’তিন’শ ছাত্র নিয়ে রংমহল সিনেমা হল প্রাঙ্গণে হাজির হলাম।
স্লোগান দিচ্ছি বাইরে। হলের ভেতরে আমাদের প্রবেশ নিষেধ। অথচ হলের ভেতর পুরোটা পূর্ণ হয়নি লোকজনে। বিষয়টি আমাকে বেশ ক্ষুব্ধ করে তুলল। শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, লিডারের সঙ্গে দেখা না করে, নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অনুযোগ না দিয়ে যাবো না। বেশ কিছুক্ষণ পর সভা শেষ হলো। শেখ মুজিবুর রহমান বের হয়ে এলেন। আমি সামনে এগিয়ে গিয়ে লিডারকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন আমাদেরকে ভেতরে যেতে বারণ করল? উনি সস্নেহে জানালেন আসলে এটি ঠিক করেনি, ছাত্ররাই এদেশের ভবিষ্যৎ। তোরাইতো দেশের দুর্গতি দূর করবি। আদর করে আমার পাঞ্জাবির উপরের বোতামটা লাগিয়ে দিলেন, গাল টিপে আদর করলেন।
তাঁর ভরাট কণ্ঠের আবেগী উচ্চারণ, চোখেমুখে গভীর ভালোবাসার চুম্বক অভিব্যক্তি আমাকে পরম মুগ্ধতায় আবিষ্ট করে ফেললো। সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি স্বাভাবিকের চাইতে এক বিগত লম্বা, লম্বা-পাতলা চেহারা, বেকব্রাশ করা চুল, দৃঢ়চেতা একজন মানুষের ছবি আমার স্মৃতিতে চিরস্থায়ীভাবে গেঁথে গেল। জীবনে ঐদিনই প্রথম একজন সুদর্শন পৌরুষদীপ্ত নেতার স্পর্শ পেয়ে বদলে গেলাম আমি।’ বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতা শহীদ সাহেবের দৃষ্টি কেড়েছিলেন ১৮ বছর বয়সে। আবদুল হামিদ সাহেব বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি কেড়েছিলেন ২০ বছর বয়সে।
সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গে ১১১ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘প্রথমটায় ঐক্যবিনষ্টের আশঙ্কায় জাতীয় ছাত্র রাজনীতির বিভক্তির প্ল্যাটফরমে উঠবার অনীহা থাকলেও ছাত্র ইউনিয়নের কমিটি গঠিত হয়ে যাবার ফলে আমিও ছাত্রলীগ গড়ে তুলতে মনোযোগী হলাম। কিছুদিনের মধ্যেই একটি শাক্তিশালী কমিটি গঠন করে সদস্য সংগ্রহে নেমে পড়লাম’। এরপরেই লিখেছেন ‘আমি আমার ভক্তদের দিয়ে সদস্যভুক্তির রশিদ বই আনিয়ে লিখিতভাবে স্বাক্ষর আদায় করে সদস্য বানিয়ে নিলাম’।
কোথা থেকে আনালেন, কার কাছ থেকে আনালেন এই প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা থাকা উচিত ছিল। নইলে মনে হবে হাওয়া থেকে পাওয়া। সদস্য সংগ্রহের বিষয়ে চমৎকার কথা লিখেছেন- ‘স্বাক্ষর দিয়ে সদস্য হলে সংগঠনের সঙ্গে ব্যক্তিবিশেষের একটা মনস্তাত্ত্বিক বন্ধন তৈরি হয়, ফলে সহজে অন্যদলে চলে যায় না’। এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহ করে থাকে।
লেখক দাবি করেছেন-‘আমিই প্রথম গুরুদয়াল কলেজে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি পদে অভিষিক্ত হই’। সম্ভবত কলেজে এর পূর্বে দলীয় সাংগঠনিক রাজনীতির প্রচলন ছিল না। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ফ্ল্যাপে লেখা রয়েছে ১৯৬৪ সালে কিশোরগঞ্জ মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কিন্তু ভেতরে বর্ণিত হয়েছে গুরুদয়াল কলেজের কথা, এর স্পষ্টতা প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হলো, ১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগের জন্ম। এরপরের ১৬ বছরেও কিশোরগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ মহকুমায় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কাঠামো ছিল না, এটা আমাদের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে নতুন সূত্র হয়ে উঠবে। কেননা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৮৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম’। এরপরে ১০৯ পৃষ্ঠায় বলেছেন-‘আমি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সংগঠনের দিকে নজর দিলাম। প্রায় সকল কলেজ ও স্কুলে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল।
বিভিন্ন জেলায়ও শক্তিশালী সংগঠন গড়ে উঠতে লাগল। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের মহকুমা শাখার কমিটি গঠনেও কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়। সে-সময়ের টাঙ্গাইলের ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার উল আলম শহীদ তাঁর একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় বইয়ের ১৩৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে টাঙ্গাইল রওশন টকিজ সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয় টাঙ্গাইল মহকুমা ছাত্রলীগের সম্মেলন।
সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে আসেন ছাত্রলীগ নেতা(তখন সভাপতি) শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন’। ১৮৭ পৃষ্ঠায় জানিয়েছেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পরে ‘গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর কখনো সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে, কখনো ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আমরা পূর্ব বাংলার সর্বত্র সফর করতে শুরু করি। প্রথমেই ভৈরবে আসমত আলী কলেজ ময়দানে ছাত্রলীগ নেতা ও কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ফয়সাল আহমেদের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। খালেদ মোহাম্মদ আলী, রাজিউদ্দিন আহমেদ রাজু, দেওয়ান গাউস সুলতান ও আমি(লেখক) এই জনসভায় যোগদান করি’।
মোঃ আবদুল হামিদের লেখায় এওরকম জনসভা কিংবা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলনে যোগদান প্রসঙ্গে কিংবা সংযোগের কোন বয়ান নাই। পাঠকের জন্য এটা একটা অপ্রাপ্তি। বইটিতে লেখকের শ্যালক বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল মাহফুজুর রহমান বীরপ্রতিকের কথা লিখেছেন। মাহফুজুর রহমান জেনারেল জিয়ার পার্সোনাল অফিসার ছিলেন। জিয়া হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ১২ জনের একজন। ফাঁসির ঘটনা ১৯৮১ সালের। কিন্তু আমি ভাবছি এর পূর্বের ঘটনাপ্রবাহ।
রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পার্সোনাল অফিসারের ভগ্নিপতি আবদুল হামিদ ১৯৭৫ সালের পরে জেল খেটেছেন বিনাবিচারে। সুদূর রাজশাহী জেলে নিয়ে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ‘বাংলাদেশে জয়-পরাজয়ের রাজনীতি(১৯৫৪-১৯৮৩)’ বইয়ের ২২১ পৃষ্ঠায় সরদার আমজাদ হোসেন লিখেছেন-‘কিছুদিন পর বদলী হয়ে জেলখানায় এলেন কিশোরগঞ্জের এডভোকেট আবদুল হামিদ। গ্রেপ্তারের পর এডভোকেট হামিদের ওপর চরম শারীরিক নির্যাতন করা হয়।
রাজশাহীতে তিনি প্রায়ই জটিল অর্শরোগে ভুগছিলেন’। এ-থেকে বোঝা যায় নীতির প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন বলেই তাঁকে এসব নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল। এতেই প্রতীয়মান হয় নীতির প্রশ্নে যেমন আপোষহীন ছিলেন তেমনি ছিলেন দলের প্রতি অনুগত। ১৯৭৮ সালে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিশোরগঞ্জ মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হবার পরে তাঁর দৃঢ়তার নজির পাওয়া যায় অপর ঘটনায়। জিয়ার কারসাজিতে দলের ভিতরে তখন কোন্দল-ভাঙ্গন-দলত্যাগের ঘটনা ছিল নিত্যকার ঘটনা।
এরকম পরিস্থিতিতে মিজান চৌধুরী আলাদা আওয়ামী লীগ(মিজান) গঠন করেন। বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীও এতে যোগ দেয়। মূলধারার রাজনীতি-বাংলাদেশ আওয়ামী লীগঃ কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬ বইতে হারুন-অর-রশিদ ২১৬ পৃষ্ঠায় জানিয়েছেন- এমতাবস্থায় ১৯৭৮ সালের ১৭ ও ১৮ আগস্ট দলের বর্ধিত সভায় আবদুল হামিদ উপস্থিত হতে না পারলেও তারবার্তা ও চিঠির মাধ্যমে দলের প্রতি আনুগত্য, সমর্থন এবং বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারীদের শাস্তি দাবি করেছিলেন।
এর আগে ও পরে আবদুল হামিদকে আমরা দেখি দল ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার একজন মূর্ত প্রতিক হিসেবে। ১৯৮৩ সালে বাকশাল, ১৯৯২ সালে গণফোরাম এবং ১/১১ সবসময়ই পথ চলেছেন অবিরত ও সোজাপথে।রাজনীতিতে এই যে দীর্ঘ পথচলা, এটা সম্ভবত পরিকল্পিত ছিল না। কৈশোর থেকেই, স্কুলবালক থাকাকালেই তাঁর চরিত্রে রাজনীতি ও নেতৃত্ব ছিল বলে লিখিত ঘটনাপ্রবাহ স্বাক্ষ্য দেয়।
কিন্তু সারাজীবন রাজনীতিই করবেন, এই বন্ধুর পথে হাঁটবেন এমনটা অপরিকল্পিত। সময় তাঁকে এই পথে নিয়ে এসেছে বলে অনুমান করি। ১৯৬৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস তিনি গুরুদয়াল কলেজের জিএস। ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- এই সময়ে হঠাৎ করেই এক ছাত্রবন্ধু এসে আমাকে জানাল সেনাবাহিনীতে কমিশন র‍্যাংকে লোক নিচ্ছে। সেনাবাহিনীতে ভর্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে ঢাকায় এলাম।
প্রাথমিক বাছাই পর্বে লিখিত ও ডাক্তারি পরীক্ষা শেষে আমরা ১১ জন মনোনীত হলাম। দ্বিতীয় পর্যায়ে কঠিন আইএসএসবি-তে এই ১১ জনের মধ্যে আমরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ছিলাম ৭ জন এবং বিহারি ছিল ৪ জন। আর্মি অফিসার হিসেবে চাকুরিতে যাবো বলে আশান্বিত হলাম। বাড়িতে ও পাশের অনেককে বিষয়টি জানালাম। অপেক্ষায় আছি চূড়ান্ত নিয়োগপত্র পাবার জন্য। কিন্তু না, শেষ পর্যন্ত আর্মির পশ্চিম পাকিস্তানি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অযৌক্তিক, বৈষম্যমূলক আচরণের কারণে আমরা বাঙালি ৭ জনই বাদ পড়লাম। কেবল বিহারি ৪ জনকে চূড়ান্ত নিয়োগ দেওয়া হলো।’ এটা থেকে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমত- তিনি চাকুরিতে যেতে চেয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত- বৈষম্য এবং তৃতীয়ত- পূর্ব পাকিস্তানী কোটায় বিহারীদের নিয়োগ। এটি পাকিস্তানের তেইশ বছরের চিত্র। ষাটের দশকের কিশোরগঞ্জ গুরুত্বপূর্ণ। গভর্নর মোনায়েম খানের বাড়ি কিশোরগঞ্জে। সেই সময় কেমন ছিল কিশোরগঞ্জের রাজনীতি? ১৩৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন- ‘ঐ সময় আমাদের মাঝে মূলত দুটো ছাত্র সংগঠন আন্দোলনের মাঠে ছিল। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন। মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন এনএসএফ কিশোরগঞ্জে ছিল না।
ময়মনসিংহ জেলার মধ্যে কেবল জেলা শহর ময়মনসিংহেই এনএসএফ-এর অস্তিত্ব ছিল। মহকুমা শহরে এর কোনো অস্তিত্ব ছিল না।’ ছাত্র সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গেলেও তৎকালীন মুসলিম লীগ এবং আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের অবস্থান বিষয়ে তেমন কিছু উল্লেখ করেন নি লেখক। একজন রাজনীতিবিদ যখন আত্মজীবনী লিখেন তখন তিনি সবকিছু নিয়েই লিখেন, যখন পথ হাঁটেন তখন তিনি সবাইকে নিয়েই পথ হাঁটেন।
অর্থাৎ একজন রাজনীতিবিদ সবসমই সহমত-দ্বিমত-ভিন্নমত এবং বিরুদ্ধমত, সবকিছুকে নিয়ে এবং মোকাবেলা করেই পথ চলেন। কিন্তু মোঃ আবদুল হামিদের আত্মজবানীতে আমাদের জন্য কিছুটা অপ্রাপ্তি রয়ে গেল। হয়ত ‘জীবননীতি ও রাজনীতি’র যেখানে শেষ হয়েছে পরবর্তী পর্বের শুরুতেই সেসব পাওয়া যাবে। তিনি একাধিকবার সরকারী দল মুসলিম লীগের সভা পণ্ড করার কথা বলেছেন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভা পণ্ড করার কথা বলেছেন, জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলমের সভা পণ্ড করার কথা বলেছেন; এক্ষেত্রে আমরা মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বের ইতিহাসের শরণ নিতে পারি।
বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ঘোষণার পর থেকেই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের চূড়ান্ত উত্থানের যুগসন্ধিক্ষণ বলা যায় এই সময়টাকে। তখন যেখানেই সরকারী দল মুসলিম লীগ সভা করতে চেয়েছে সেখানেই ছাত্রলীগ প্রতিরোধ করেছে। একই সময়ে টাঙ্গাইলে কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী খান এ সবুরের জনসভা ভণ্ডুলের কথা জানিয়েছেন আনোয়ার উল আলম শহীদ তাঁর একাত্তর আমার শ্রেষ্ঠ সময় বইতে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ১৪০ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ‘আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে ওঠে ’৬৮ সালের শেষ পর্যায়ে এবং ’৬৯ সালের প্রথমে। এই সময়ে জেলা প্রশাসক খোরশেদ আলম ও মোনায়েম খানের সহোদর খোরশেদ খান কিশোরগঞ্জে কী একটা প্রোগ্রাম দিলেন। ছাত্রসমাজ যে কোনো মূল্যে তাদের প্রোগ্রাম প্রতিহত করার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করলো’। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি খোরশেদ আলমের ‘প্রশাসনে নিবেদিত এক কর্মকর্তার আত্মস্মৃতি’ নামক আত্মজৈবনিক গ্রন্থের কথা।
তাতে তিনি জানিয়েছেন ১৯৬৭ সালের আগস্ট থেকে ১৯৬৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত এক বছর ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক ছিলেন। সম্ভবত তখন অন্য কোন জেলা প্রশাসক হয়ে থাকবেন। পাকিস্তান আমলের শুরুতে এবং ষাটের দশকজুড়ে ময়মনসিংহ জেলা এবং কিশোরগঞ্জ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল নুরুল আমীন ও মোনায়েম খানের বাড়ি হবার বদৌলতে। এমনকি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে পাকিস্তানের একমাত্র বাদাম তেল উৎপাদনের মিল স্থাপিত হয়েছিল আইয়ুব-মোনায়েম খাঁর আমলেই। এমন একটি জনপদে সরকার বিরোধী রাজনীতি এবং ছাত্ররাজনীতি যে ভয়ংকর সাহসের কাজ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমন সাহসী মানুষটিই তো এমন সাহসী কর্মকাণ্ড করবেন, এতে অবাক হবার কিছু নাই।
 ১৯৬৯ সালে কিশোরগঞ্জের রাজনীতিতে থিতু হওয়া প্রসঙ্গে ১৪৮ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘পাশ(বিএ) করেই ঢাকা চলে এলাম। ঠিক করলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব এবং আইন পড়বো। … শেষ পর্যন্ত ছোটাছুটি সফল হলো। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হলাম। ভর্তি হয়েই এক বিকেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলাম।
সালাম করে দাঁড়িয়ে জানালাম আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আমি ঢাকায় থেকে ছাত্ররাজনীতি করতে চাই। লিডার আপনি আমাকে পথ বাতলিয়ে দিন। … বঙ্গবন্ধু সোজা আমার দিকে ভরাট দৃষ্টি দিয়ে বলে উঠলেন-তোর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি ক্যানসেল। ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজে ভর্তি হও। ভর্তি হয়ে ল পাশ করার সংক্ষিপ্ত রাস্তা ধরার জন্য নোটবই সব কিনে কিশোরগঞ্জ চলে যা। তোকে কিশোরগঞ্জে রাজনীতি ও সংগঠন করতে হবে।’ সেই থেকে মোঃ আবদুল হামিদ কিশোরগঞ্জের সাংগঠনিক রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ২০০৯ সাল অব্দি সম্পৃক্ত ছিলেন। আইনের বাধা না থাকলে হয়ত আজ এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকতেন।
এমনকি তিনি কিশোরগঞ্জ জেলার বাইরে অর্থাৎ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কমিটিতেও ছিলেন না। জেলা পর্যায়ের নেতা থেকেই ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে দুই মেয়াদ শেষ করতে চলেছেন। এ-এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত। কর্মীদের মধ্যে কাকে কোথায় কাজে লাগাতে হবে এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর ছিল অতুলনীয় দূরদৃষ্টি। পাবনার এডভোকেট আমজাদ হোসেনও একরকম কথা লিখেছেন তাঁর ‘বিস্মৃত প্রায়’ আত্মজৈবনিক গ্রন্থে। ১০০ পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন ‘১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে পাবনা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাই এবং সেই সুবাদে মুজিব ভাইয়ের(বঙ্গবন্ধু) সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে বললেন, সংবাদপত্রে দেখেছি তুই ছাড়া পেয়েছিস। ভালোই হল। দুই একদিন ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে যা।
সেখানে মেডিক্যালের ছাত্র বাচ্চুকে(পরে চাঁপাইনবাবগঞ্জের এমপি ডা. এ এ মেছবাহুল হক) পাবি। তাঁকে সাথে নিয়ে ছাত্রলীগ সংগঠিত কর। বলেই আমার আমার মুখে নজর করে হো-হো করে হেসে উঠলেন। তুই নেতা হওয়ার আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাস বলে বুঝতে পারছি।
কিন্তু কাকে কোথায় দিতে হবে তা আমি ভাল জানি। তোকে রাজশাহীতেই যেতে হবে এবং ছাত্রলীগ করতে হবে। ফল পরে বুঝবি। … এরপর অনেক কথা। ছাত্রলীগের পথ ধরে আওয়ামী লীগে আসা আর এমপি নির্বাচিত হওয়া। সেদিন মুজিব ভাইয়ের নির্দেশে কাজ করার সুফল বহুদিন পরে হলেও পেয়েছিলাম। আমি তাঁর(বঙ্গবন্ধু) কাছে চিরঋণী’। বঙ্গবন্ধুর ‘আমজেদ’র সাথেও আবদুল হামিদের আরেকটি মিল আছে। ১৯৭৩ সালে নির্বাচনের অব্যবহিত পূর্বে দলের প্রার্থী আবদুর রব বগা মিয়ার আকস্মিক মৃত্যুর পরে আমজাদ সাহেব দলের মনোনয়ন পেয়ে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ভাগ্য লেখককে ছাত্রনেতা থেকে জাতীয় রাজনীতির মাঠে নিয়ে গেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু তাঁকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য পদে প্রার্থী হবার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। মোঃ আবদুল হামিদ চেয়েছিলেন জাতীয় পরিষদে প্রার্থী হতে। কিন্তু এ-পদে মেজবাহউদ্দিন নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজকে বঙ্গবন্ধু ঠিক করে রেখেছিলেন। কিন্তু বিধাতার নির্দেশ ছিল ভিন্ন। ১৫২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন-‘আমি বাসায় ঢুকতেই লিডার আমাকে দেশে শিশুর মতো অট্টহাসিতে চারদিক চমকিত করে তুললেন। আমি অনেকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এদিক অদিক তাকাতে থাকলাম।
একপর্যায়ে খোঁজ নিতে থাকলাম শার্ট প্যান্টের বোতাম ঠিকমতো লাগিয়েছি কি না, অথবা অন্য কোনো বিসদৃশ্য কিছু আছে কি না। আমাকে হতভম্ব অবস্থা থেকে তিনিই উদ্ধার করলেন আরও রহস্য ঢাকা কথা বলে। বললেন, তোর জজ মারা গেছে! তোর কথা তো না রেখে পারি না।’ অর্থাৎ জজ সাহেবের আকস্মিক মৃত্যুতে জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে নমিনেশন নিশ্চিত হলেন।
এরপরেই লিখেছেন-‘আমার জীবনে এ ধরনের সৌভাগ্যজনক ঘটনার উদাহরণ বহু আছে। একে কাকতালীয় বলবো, না অদৃশ্য আলিমুল গায়েবের অপার রহমতের লীলা বলবো বুঝতে পারছি না’। পাঠক মাত্রই জানেন, স্পিকার হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শূন্যস্থান পূরণে ২০০১ সালে প্রথমবার তিনি স্পিকার এবং ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতির শূন্যস্থান পূরণে তিনি রাষ্ট্রপতি হয়ে বাংলাদেশের ‘প্রথম নাগরিক’ হন।
লেখক আবদুল হামিদ এমএনএ হয়ে ঢাকায় এসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়েছিলেন পরিচয়পত্র নিতে। কিন্তু দলের দপ্তর সম্পাদক তাঁকে বলেছিলেন যার পরিচয়পত্র তাঁকে এসে নিতে হবে। দপ্তর সম্পাদক বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে মাত্র ২৫ বছরের তরুণ এমএনএ হয়েছেন। বয়সের এই গ্যাড়াকলে বঙ্গবন্ধুও পড়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। সেবার বিহারের পাটনায় গিয়েছিলেন দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহযোগিতা করতে।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশ ছিল যে, যদি বিহার-পাটনা থেকে আক্রান্তদের বাংলায় পাঠানো হয় তাহলে বাংলা সরকার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করবে। এই কথাটা যখন তরুণ শেখ মুজিব পাটনার এসডিও আকমল হোসেন আইসিএস সাহেবকে বললেন আকমল সাহেব কোনক্রমেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না, বরং বলেছিলেন আপনি কেমন করে শহীদ সাহেবের পক্ষে কথা বলতে পারে? আমার অল্প বয়স দেখে তিনি বিশ্বাস করতেই চাইলেন না যে, শহীদ সাহেব আমার সাথে এ ব্যাপারে আলাপ করতে পারেন।
১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে লেখক এমএনএ নির্বাচিত হন। একাত্তরের মার্চের প্রথম দিকেই বঙ্গবন্ধু তাঁকে কিশোরগঞ্জে চলে যেতে নির্দেশ দেন। কার্ফু শুরু হয়ে যাচ্ছে এরমধ্যে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যেতে লেখক এক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কমলাপুর থেকে ট্রেনের ভেতরে উঠতে না পেরে ট্রেনের হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাত্রা করেছিলেন এবং পরে মাঝপথে ট্রেন থামলে একজন জানালা খুললে সেই জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন। এমন ঘটনা বঙ্গবন্ধুর জীবনেও ঘটেছিল ১৯৪৬ সালে।
মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশন শেষে গিয়েছিলেন আগ্রা ঘুরতে। ফেরার পথে সঙ্গিসাথি সকলেই ট্রেনে উঠে গেলেও বঙ্গবন্ধু উঠতে না পেরে এক ফার্স্ট ক্লাস কামরার দরোজার হাতল ধরে রওয়ানা করেছিলেন। ভাগ্যক্রমে কিছুক্ষণ পরে ট্রেন থেমেছিল এবং যথারীতি জানালা দিয়ে কোনক্রমে ট্রেনে উঠতে পেরেছিলেন। নেতা ও শিষ্যের জীবনের কাকতালীয় ঘটনা বৈকি!
বইটির পরতে পরতে রাজনীতির কথা আছে, বিভিন্ন ঘটনা বা ফ্যাক্ট আছে, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বের কথা আছে, আছে সবকিছুর পূর্বাপর এবং সবশেষে লেখক মুক্তিযুদ্ধের বর্ণনা দিয়েছেন। এই নিয়ে আমি আলোচনা করছি না। কেননা, বাংলাদেশের সেসময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় সকলেই একটা গল্প আছে, কর্মীদের গল্প আছে, সংগঠকদের গল্প আছে, নেতাদের গল্প আছে; সবগুলো গল্পের মিলিত মহাগল্পের নাম আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে পূর্ণতা লাভ করেছে। লেখক এইদিন পর্যন্তই লিখেছেন। আমিও এখানেই শেষ করছি। আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি বইটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

Loading

error: Content is protected !!