হোম » প্রধান সংবাদ » স্বাধীন বাংলাদেশ- নারী ও মুক্তিযুদ্ধ

স্বাধীন বাংলাদেশ- নারী ও মুক্তিযুদ্ধ

ফারজানা আক্তার মনি: বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধ দুইটি অবিচ্ছেদ্য শব্দ। স্বাধীন বাঙালী জাতীর হৃদয়ে গভীরের একটি শব্দ ‘মুুক্তিযুদ্ধ’। বাংলাদেশ শব্দটি গঠনের পিছনে লক্ষ বাঙালীর এক নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের গল্প আছে।

আজ ঐতিহাসিক অপারেশন সার্চলাইট, ২৫ শে মার্চ ১৯৭১। পৃথিবীর বুকে নৃশংসতম এক গণহত্যার নাম। বাঙালি যখন তার অধিকারকে আঁকড়ে ধরেছিল, বর্বর পাকিস্তানিরা তখনই বুঝতে পেরেছিল কোনোকিছু দিয়েই এই জাতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না।

বাংলাদেশিদের স্বাধীকার আন্দোলন, এমনকি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফলের আইনসঙ্গত অধিকারকেও রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শুরু করেছিল সারাদেশে গণহত্যা৷ সেইরাতে হানাদাররা একযোগে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে হত্যা করে অগণিত নিরস্ত্র দেশপ্রেমিক ও দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের৷ পাকহানাদার বাহিনী একাধিক গণকবর খুঁড়ে সেখানে শত শত লাশ মাটি চাপা দিয়ে তার ওপর বুলডোজার চালায়৷ নগরীর বিভিন্ন স্থানে সারারাত ধরে হাজার হাজার লাশ মাটি চাপা দেয়া হয়৷ পুরানো ঢাকার বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া হয় নিহতদের লাশ৷

তাই একাত্তরের সেই রাতে শুরু করে জঘন্যতম গণহত্যা। যা জন্ম দেয় মুক্তিযুদ্ধের। শুরু হয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। কবি তার ভাষায় বলেন।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো।
রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।

মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লক্ষ শহীদ এই স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলেও সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি অবহেলিত, অত্যাচারিত নারী, পুরুষ এবং শিশু সকলেই এই বাংলাদেশ গঠনের বীর সৈনিক। যারা যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়েও যুদ্ধ করেছে, মৃত্যুকে হাতের মুঠোয় বাজি রেখে জীবনের সাথে লুকোচুরি খেলেছেন, সাহস জুগিয়েছে যুদ্ধরত সৈনিকদের।

মুক্তিযুদ্ধের সময় জনসংখ্যার অনুপাতে প্রায় অর্ধেক ছিল নারী। হিসেবে কষলে বলা যেতে পারে, তিন কোটি ৭৪ লাখ নারী মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীরা খবর আদান-প্রদান করতেন ঠিক রাডার এর মতন করে। সুতরাং বলা যেতেই পারে দেশ স্বাধীন হয়েছে শুধু পুরুষের একক ভূমিকার জন্য নয় বরং নারীরাও এ ক্ষেত্রে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।

বাঙালীর সম্মান, অধিকার এবং স্বাধীনভাবে বৈষম্যহীনভাবে বাঙালীরা সুন্দরভাবে বাচতে পারে এ জন্যই এ যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে যে কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে যাওয়াই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। আর সেক্ষেত্রে নারীর শারীরিক/মানসিক।যৌন নির্যাতনের ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

মুক্তিযুদ্ধের বিশালতাকে পরিমাপ করা যাবে না। এ বিশালতায় যেসব নারী বিভিন্ন অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন তাদের অনেকের নাম এখনও অজানা। এসব ঝুঁকি সঙ্গে নিয়েও দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য পুরুষদের পাশাপাশি অসংখ্য নারী সশস্ত্র যুদ্ধসহ স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্নভাবে অংশ নিয়ে প্রমাণ করেছিল তাদের অবদানও সমান গৌরবের। নির্যাতনের শিকার হয়েছিল দুই লাখ নারী। সেই অগ্নিগর্ভ সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকার কিশোরী, তরুণী, প্রৌঢ়া এমনকি প্রবীণ অবিবাহিতা নারী ও বিবাহিত নারী কিভাবে তাঁদের ক্ষত-বিক্ষত জীবন পার করেছেন তা কল্পনার অতীত।

মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের সংখ্যা নগন্য ই বলা যায়। তবে এ যুদ্ধে নারীদের অবদান কোনো অংশেই কম নয় বরং আরা বেশি। এ যুদ্ধে মা তার ছেলেকে দেশের জন্য বলিদান করেছে, স্ত্রী তার সিথিঁর সিদুর বলিদান করেছেন, বোন তার ভাইকে হারিয়েছে, মেয়ে হারিয়েছে তার বাবার ভালোবাসা।

বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের নারীর ভূমিকাকে আলাদা কারে দেখার প্রয়াস শুরু হয় বিগত নব্বইয়ের দশক থেকে। এর আগ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আলোচনায় নারীরা ছিলেন অনুপস্থিত।” ‘মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র’ থেকে প্রথমবারের মতো বিভিন্ন অঞ্চলের মোট ১১৩ জন নারীর নিজ অভিজ্ঞতার বিবরণ তিন খন্ডে প্রকাশিত হয়। এছাড়া গবেষক আফসান চৌধুরি তাঁর ‘বাংলাদেশের ১৯৭১’ বইয়ের তৃতীয় খন্ডে ‘আদিবাসী ও বাংলাদেশের যুদ্ধ’ অধ্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী নারীদের অংশগ্রহনের বিষয়ে লিখেছেন।

খেতাবপ্রাপ্ত মোট ৬৭৬ জন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ২ জন নারী বীর প্রতীক রয়েছেন। তাঁরা হলেন মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি ও ক্যাপ্টেন সিতারা। কিন্তু নারী ও পুরুষ মুক্তিযোদ্ধা অনুপাত ১:৩৩৮ হলেও অংশগ্রহণের অনুপাতটি এতটা ব্যবধান সূচক নয়। অনুমান করা যায় অন্য অনেক কিছুর পাশাপাশি স্বীকৃত নারীযোদ্ধার সংখ্যাগত এ দৈন্য পরবর্তী সময়ের ইতিহাস প্রণেতাগণকে নারীযোদ্ধাদের অনুসন্ধান ও মূল্যায়নে প্রবৃত্ত না হতে প্রভাবিত করে থাকবে।

পৃথিবীর যেকোন দেশে যেকোন যুদ্ধে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হন নারীরা। প্রতিটি মা,বোন,মেয়ে,স্ত্রী যুদ্ধের জন্য অনুপ্রেরনা, সাহস, মনোবল জুগিয়েছে। যুদ্ধক্ষেত্রে ও এদের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছে এই বাঙালী কমলমতি নারীরা। যে হাতে ভালোবেসে নিজের সন্তান, ভাই,বাবা, স্বামীকে খাবার খাইয়েছেন সেই হাতেই দেশ মাতার জন্য অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন।

যুদ্ধকালীন সময়ে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীরা সারা দেশেই তৎপর ছিলেন। তারা বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষকে বিভিন্ন তৎপরতার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত হওয়ার ক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছেন।

মমতাজ বেগম, কাজী রোকেয়া সুলতানা, বেবী মওদুদ, রানী খান, রোকেয়া কবীর, মনিরা আক্তার প্রমুখ নারী জনমত গঠনের পাশাপাশি ফিজিক্যাল ফিটনেস, মার্চপাস্ট, অস্ত্র চালনা, ফাস্টএইড প্রদান এবং আত্মরক্ষার নানা কৌশল- এসব ব্যাপারে ট্রেনিং নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় শিক্ষা দিতেন।

বদরুন্নেসা আহমেদ পুনর্বাসন কার্যকলাপ ও মহিলা সংগঠন মুজিবনগরের সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করেন একাত্তরে। বেগম নূরজাহান খুরশীদ বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকাণ্ড পরিদর্শন ও রিপোর্ট আদান-প্রদানের কাজ করলেও পরবর্তী সময়ে কূটনীতিকের দায়িত্বও পালন করেছেন।

সাজেদা চৌধুরী তার বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতেন। সেই সঙ্গে সচেতন করতেন কোন কোন বিষয়ে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ মুক্তিযুদ্ধে মহিলা মুক্তিফৌজের হাল ধরেছিলেন।

এ মহিলা কমিটি মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদান রেখেছিল। এ কমিটির প্রীতিরানী দাস পুরকায়স্থ ছাড়াও গীতারানী নাথ, নিবেদিতা দাস, সুধারানী কর মঞ্জুদেবী, সুষমা দাস ও রমা রানী দাসের নাম উল্লেখযোগ্য।

ইতিহাসের পরিক্রমায় এটা লক্ষণীয়ভাবে প্রমাণিত হয় যে, যুদ্ধকালীণ নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং এটি একটি সুপরিকল্পিত বিষয় এবং যুদ্ধকৌশল। সাধারণভাবে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের ব্যবহার হয়ে থাকে। একটি জাতীর মানসিক মুক্তিকে পর্যদুস্ত করার উপায় হিসেবে ভাবা হয়। সরকারী বেসরকারী বা রাজনৈতিক কোন উদ্যোগের সঙ্গেই নারীদের সংযুক্ত করা হয়নি। ব্যক্তি উদ্যোগে সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন যেসব নারী তাঁদের নামের কোন তালিকা নেই। তাঁরা যে কষ্ট করেছেন, নির্যাতিত হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করেছেন এসব কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের কাজ বলে আজও স্বীকৃতি পায়।
তথ্যসূত্র : মুক্তিযুদ্ধে নারী, মালেকা বেগম।

কিন্তু আফসোস মুক্তিযুদ্ধে নারীদের মূল্যায়ন হয়নি। যুদ্ধ শেষে এই নারীদের ই সমাজ গ্রহণ করেনি। লেখক রমা চৌধুরী (একাত্তর এর জননী গ্রন্থের লেখক) এমন একজন নারী যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন কিন্তু যুক্ত শেষে স্বামী গৃহে তার ঠাই মেলেনি। এরকম হাজারো নারী অপমানিত হয়েছে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী দ্বারা ধর্ষিত নারীদের সমাজ মেনে নেয়নি। যেখানে বীর বেশে নিজ গৃহে প্রবেশের কথা ছিলো সেখানে অপমানিত হয়েছেন বাংলার এই বীর নারীরা। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘেটে দেখলে আমারা দেখতে পারবো নারীদের সাহায্য ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং গেরিলা যুদ্ধ চালানো সম্ভব ছিলো না।

মুক্তিযুদ্ধে নারীকে একদিকে যেমন অসহায় করেছে, তেমনই আরেকদিক থেকে করেছে সাহসী যোদ্ধা। যুদ্ধ করেছেন বহু প্রচারবিমুখ নারী এখন বেঁচে আছেন। কিন্তু খেয়াল করলে দেখবেন সেই তুলনায় বীর প্রতীক খেতাব বা বীরের সম্মান তেমনভাবে দেয়া হয়নি নারীদের কে। পুরুষরা পেয়েছেন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক বীরের সম্মান। মুক্তিযুদ্ধে নারীর অবদান কোনো অংশেই পুরুষের থেকে কম নয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসে বীর সন্তানদের নাম থাকলেও বীর কন্যাদের নাম পাওয়া যায় না। একজন নারী হিসেবে আমার নারী মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান প্রাপ্য সম্মান যাতে দেওয়া হয় এটাই আমার আবেদন।

“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যানকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর। “

error: Content is protected !!