হোম » প্রধান সংবাদ » আমার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ফুসফুস

আমার অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ফুসফুস

 সায়মা ইকবাল শাফি:পৃথিবীর ৫২২তম “বিশ্ব ঐতিহ্য ” কে দেখার পর আমার বার বার মনে পড়ে প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এর কবিতা “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি,তাই আমি পৃথিবীর রুপ খুঁজিতে যাই নাই আর”।
আজ সেই ” বিশ্ব ঐতিহ্য” ভ্রমনের কিছু কথা শেয়ার করব। অনেক আলোচনার পর ঠিক হল আমাদের ফিল্ড ওয়ার্কের জায়গা।

আনন্দে মেতে উঠার সাথে সাথে ভয় ও কাজ করছিল অনেক। একে তো সাঁতার জানিনা তারপর আবার ৪ দিন থাকতে হবে লঞ্চের উপর যা চলবে গহিন বনের ধার ঘেষে ভয়ংকর সুন্দরবন এর মধ্য দিয়ে।তারপরও তার ভয়ংকর সৌন্দর্য দেখার আকাংখা দিন দিন প্রবল ভাবে বাড়তে লাগল। তারমধ্যে চেয়ারম্যান স্যার এর ৫০ পেজ এর এসাইনমেন্ট করতে গিয়ে সুন্দরবন এর প্রতি অাকর্ষণ বেড়েগেল।

নিবিড় ঘন,সবুজে আচ্ছাদিত এই বন টি ৫৭৪৭ বর্গ কি:মি জায়গা জুড়ে অবস্থিত। যাকে প্রাকৃতিক “সৌন্দর্যের রাণী” বলা হয়।ইউনেস্কো ১৯৯৭সালের ৬ ডিসেম্বর সুন্দরবন কে পৃথিবীর ৫২২তম “বিশ্ব ঐতিহ্য” হিসাবে ঘোষণা দেয়।। বলা হয়ে থাকে, প্রতি ২৪ ঘন্টায় ছয় বার সুন্দরবন তার রুপ বদলায়।

আমাদের ৭ফেব্রুয়ারি ২০২০ এই দিন যাত্রা শুরু হলো ।আমদের বহনকারি বাস টি ক্যাম্পাস গেটে প্রস্তুত যাত্রা শুরুর জন্য। প্রায় ৭টার দিকে বাস ছাড়ল ক্যাম্পাস থেকে।বাস চলছিল কমলাপুর রেলস্টেশন এর দিকে ।আগে কখনো কমলাপুর রেলস্টেশন দেখিনি তাই উত্তেজনার পর্ব টা ঘড়ির কাটাঁর সাথে সাথে ক্রমশ বাড়তেই লাগল।অবশেষে পৌছালাম স্টেশনে।সবাই নেমে যে যার মত সকালের নাস্তা সেরে ফেলল।

ছেলেরা একটা নাচ করল প্ল্যাটফর্ম এ।আমরা বেশ কিছু ছবি তুললাম। ইতিমধ্যে ট্রেন আসল।আমরা ৯:৩০এর দিকে তল্পিতল্পা সহ ট্রেন এ উঠলাম। বিমান বন্দর থেকে আমদের চেয়ারম্যান স্যার উঠলেন।অতপর আমরা একটার পর একটা স্টেশন পার হয়ে খুলনার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। যেখানে দেশের বৃহত্তম জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কারখানা অবস্থিত। আমি সারাদিন না ঘুমিয়ে রেল এর ঝকঝক শব্দ টা উপভোগ করছিলাম।প্রায় ৭-৮ ঘন্টা যাত্রার পথ শেষ হল।। আমরা খুলনা পৌছালাম।

চেয়ারম্যান স্যার এর সাজানো ফ্রেমে সবাই ছবি তুললাম। যেটা তুলতে গিয়ে আমরা একে অপরের গায়ে পরেও গিয়েছিলাম। ছবি তুলার পর্ব শেষ করে আমরা স্কুলের ছাত্রদের মত শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে হেঁটেহেঁটে চললাম লঞ্চ এর উদ্দেশ্যে।লঞ্চ এ উঠার সময় বুঝতেই পারিনি লঞ্চ এ উঠেছি, যখন রুম এর চাবি পেলাম হাতে তখন বুঝলাম এটায় আমাদের ৪ দিন এর আবাসস্থল।

যাইহোক রুমের দরজা খুলে মন টা অনেক খারাপ হয়ে গেল।মনে হচ্ছিল এটার মত বাজে ভ্রমণ আর হতে পারেনা, যদিও আমার এই অভিমত রাত পোহানোর আগেই ভুল ধারণায় পরিনত হয়েছিল।ছোট রুম আর একটা লালবাতি, আর ছোট জানালা দিয়ে দেখা এত মনোরম দৃশ্য কখনো ভুলবার নয়।লালবাতির আলোয় কয়েকটা ছবি ও তুলেছিলাম আমার লঞ্চমেটদের সাথে।

ফ্রেশ হয়ে এবার খাবার পালা। খেতে গেলাম লঞ্চ এর ছাদে।। কি অপরুপ সুন্দর চারদিক টা আর নিরমল বাতাস আমার প্রতিটি নিশ্বাস কে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল।খাওয়ার পর অনেকক্ষণ ছাদে কাটালাম গান, আডডা, গল্পের মধ্য দিয়ে। সারাদিন এর ক্লান্তির কথা নদী আমাকে ভুলিয়েই দিয়েছিল। নদী দেখে হেমন্ত বাবুর বিখ্যাত গান মনে পরেছিল “” ও নদী রে একটি কথা সুধাই শুধু তোমারে “”। কিছুক্ষণ পর স্যার এসে রুমে যেতে বললে আমরা যে যার রুম এ চলে যাই।এরমধ্যে নাফিসার রুমের দরজাটা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল যেটার স্থির চিত্র নিতে আমি ভুলিনি। মাত্র ২/৩ ঘন্টা ঘুমের পর আবার শুরু করলাম পরেরদিন এর যাত্রা।। চোখের মধ্যে ঘুমের ঘোর নিয়ে ট্রোলারে উঠলাম।ট্রোলার আমাদের পৌছে দিল হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে।

এই প্রথম পা রাখলাম সুন্দরবন এর মাটিতে।। হাতের দু পাশে সুন্দরী, গোলপাতা,গড়ান বিভিন্ন গাছে চিরসবুজের সমারোহ। প্রাণীদের মধ্যে এখানে হরিণ, ছোট ছোট বানর, মৌমাছির দেখা মিলে।এই অঞ্চলে বাঘ ও দেখা যায়। আমরা বাঘ না দেখলেও বাঘের পায়ের ছাপ দেখেছিলাম। খুব উৎসুক হয়ে বাঘমামার পদচিহ্নের ছবি তুললাম।আমরা সেখান থেকে পানি সংগ্রহ করেছিলাম।আমরা বয়সের দোষে অনেক বেশি কথা বলি কিন্তু হাড়বাড়িয়ার নিস্তব্ধ পরিবেশ আমাদের বাধ্য করেছিল চুপ থাকতে। পরিবেশ যে মানুষেকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করে সুন্দরবন আমাদের প্রত্যক্ষ ভাবে প্রমাণ করে দিয়েছিল।

প্রথম ধাপের কাজ সেরে আমরা লঞ্চে ফিরে এসে দুপুরের খাবার সেরে ফেললাম।সুন্দরবন ভ্রমণের দুটো উপভোগ্য বিষয় ছিল “প্রকৃতি” আর “খাবার”। খাবার নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিলনা কারো।সেই ক্ষেত্রে এজেন্সির প্রশংসা করতেই হবে। দুপুরের খাওয়া শেষ করে গেলাম কটকার উদ্দেশ্যে। প্রকৃতি, পরিবেশ ও প্রানী বৈচিত্রের নান্দনিক সৌন্দর্যে শোভিত সুন্দরবন এর এই অঞ্চলটি। এখান থেকেও আমরা পানি সংগ্রহ করেছিলাম।কিছু গ্রুপ ছবি তুলে আমরা বিদাই নিয়েছিলাম কটকা থেকে। পরদিন গেলাম শরণখোলা রেঞ্জ। তখনও সুন্দরবন এর মাটি থেকে অন্ধকার বিদাই নেয়নি,ঘুমে আচ্ছন্ন ঝাপসা চোখে শুধু দেখলাম হাস্না হেনা ফুল গুলো আমাদের বরণ করে নিচ্ছে।বনের ভিতর দিয়ে চললাম পৃথিবীর সবচেয়ে শৃঙ্খল প্রাণীর পরিচয়ে।হাঁটতে হাঁটতে দেখা হল হরিণের সাথে।।অনেক চেষ্টা করল স্যার হরিণ কে পাতা খাওয়ানোর,কিন্তু বোকা প্রাণীটা আমাদের পাত্তাই দিল না।

আমরা ছবি তুলে সামনের দিকে গেলে কিছু ধংসাবশেষ বাড়ি দেখতে পেলাম, স্যার সেখানে দাঁতের পাটি বের করা একটা ছবি ও তুলেদিয়েছিল।আমারা পৌছে গেলাম কচিখালি সমুদ্র সৈকতের কাছে।। সুন্দরবন এর কটকা নদীর পূর্ব দিকে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত কচিখালি সমুদ্র সৈকত।এটিকে বলা হয় “ভয়ংকর সুন্দর “।কারণ সৈকতে পৌছাতে হলে বঙ্গপসাগরের মোহনার খরস্রোতা কটকা নদী ও সুন্দরবন এর ভিতরে প্রায় ৩ কি:মি বুনো পথ পাড়ি দিতে হয়।
দেখলাম বিস্তৃত বালুরাশির উপর পড়ে আছে অনেক বৈচিত্রের গাছ।সেখান থেকে বের হয়ে আমরা লঞ্চ এর দিকে এগোলাম। লঞ্চ এ গিয়ে সবাই সবার কাজ জমা দিয়ে এবার বের হলাম জামতলা সি বিচ এর উদ্দেশ্যে।ট্রলার থেকে নেমে চললাম বনের মধ্যে দিয়ে বিচ এর দিকে।।৪২প্রজাতির প্রানের অস্তিত্ব পাওয়া যায় এই সুন্দরবন এ।।আমরা বন এ কোন প্রাণী দেখলাম না তবে বনের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সাগরের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম। সাগরের গর্জন আর সুন্দরবন এর ভয়ংকর অনুভূতি আমাদের উত্তেজিত করে তুলেছিল। অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে দেখা মিলল জামতলা সি বিচ এর।যা কটকা সি বিচ নামেও পরিচিত। বিস্তৃত বালুরাশির সামনে বঙ্গপসাগরের অপরুপ সৌন্দর্য আর পেছনে চিরসবুজ সুন্দরবন, সুন্দরবন এর প্রধান আকর্ষণ।

ছেলেরা ফুটবল খেলল, আমরা কিছু ছবি তুলে ফিরে এলাম লঞ্চে।কিছুক্ষণ বিস্রাম নিয়ে রাতের ব্রিফিং এ অংশ নিলাম।পরের দিন এর কাজ ছিল”” দুবলার চর””।যাকে “শুটকি পল্লী” ও বলা হয়। যেতে যেতে নৌকা উল্টে যাচ্ছিল, সজিব ভাই পরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল কিন্তু তপুর বদৌলতে এ যাত্রায় বেঁচে গেল।যাইহক আমরা দুবলার চরে এসে পৌছালাম। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের রাসমেলা এবং হরিণের জন্য সুপরিচিত এই স্থানটি।এখানকার সকল মানুষই মৎসজীবি।আমাদের কাজ ছিল তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানা। তাদের সাথে অনেকক্ষণ কথা বলে জানতে পারলাম সাগরতীরে মানুষের সংগ্রাম করে টিকে থাকার চিত্রটি।।আমরা নিজের নিজের কাজ শেষ করে একত্রে হলাম, আর বিদাই জানালাম সুন্দরবন এর মাটিকে।

দুপুরের আহার সেরে শুরু হল পোস্টার প্রেজেন্টেশন বানানোর পালা।সুন্দরবন এ কোন নেটওয়ার্ক না থাকায় আমারা গুগল মামার সাহায্য ছাড়াই প্রেজেন্টেশন তৈরি করেছিলাম।স্যারদের যথাযথ গাইড আর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত আমাদের নিজস্বতা আর সৃজনশীল চিন্তা ধারার প্রকাশে অনেক বড় সুযোগ করে দিয়েছিল। প্রেজেন্টেশন শেষে শুরু হল পরীক্ষা।পরীক্ষাও শেষ করলাম।নোটবুক জমা দিলাম।।সারাদিন কাজ করার পর ও আমরা সবকিছু আনন্দের সাথেই করেছিলাম।।ইংরেজিতে একটি কথা আছে “” সারভাইভাল ফর দ্যা ফিটেস্ট”” যে কোন পরিস্থিতি মানিয়ে নিয়ে নিজেকে অভিযোজিত করার শিক্ষা প্রকৃতি মানুষকে দেয়।

সুন্দরবন এর প্রকৃতি ও আমাদের সেই শিক্ষাই দিয়েছিল। রাতের আহার সেরে আমরা সবাই গান, আডডা,গল্প অবশেষে বারবিকিউ এর মধ্যে দিয়ে সুন্দরবন যাত্রা শেষ করলাম।। আসলে ঘুরার ফাঁকে ফাঁকে কাজ না করে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে প্রকৃতির সাথে একাত্ত হওয়ার কারনেই সুন্দরবন এর যাত্রা আমাদের সফল হয়েছিল।।ভ্রমণ শেষে অবশ্যই বলব “” সত্যিই সুন্দরবন তুমি সৌন্দর্যের রাণী””।।

ছবি সংগৃহীত

error: Content is protected !!