হোম » প্রধান সংবাদ » মাদক একটি মৃত্যু কূপ

মাদক একটি মৃত্যু কূপ

মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী পাবেল: শুরুটা পাড়ার আড্ডায় বা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে বন্ধু বান্ধবের সাথে সিগারেটের একটি-দুটি টান, তারপর কিছুটা ভিন্নতা’র খোজে ডেন্ডি অথবা গাজা আর যাদের সামর্থ্য একটু ভাল তারা বাংলা মদ, তারচেয়ে ভাল হলে বিদেশী মদ ফেন্সিডিল কিংবা ইয়াবা, সব মিলিয়ে নেশার ঘোরে ডুবে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময় সমাজ।

মাদক একটি মরণব্যাধি। আত্মহননের অসৎ এবং কুৎসিত একটি পথ। সাময়িকভাবে মাদক সেবনে উন্মাদনা এবং উত্তেজনা সৃষ্টি করে। প্রথম প্রথম মাদক সেবীরা মনে করে মাদক সেবনের মাধ্যমে জীবন হয় আনন্দের এবং নিজেকে মনে করে রাজকীয় আসনের ব্যক্তি।

শুরুটা সিগারেট কিংবা ডেন্ডি থেকে হলেও এর পরের পর্ব কিন্তু আরো ভয়ংকর। ভুল করে নেশার জগতে ঢুকে পড়া এসব তরুণ ও যুবকেরা একসময় হারিয়ে যায় গাজা, হেরোইন, প্যাথেডিন অথবা ইয়াবার মত ক্ষতিকর থাবায়। শেষ পরিণতিরর খবর না বুঝেই যারা একটু-একটু করে নেশার জগতে পা রাখে তাদের সবারই গন্তব্য সাধারণ জগত থেকে অনেক দূরে। নেশার মাঝে সুখ খুঁজতে গিয়ে যারা নিজেদের এবং আশ-পাশের বিপদ ডেকে আনেন, তাদেরকে নিয়েই রাষ্ট্রের মাথাব্যথা।

আমাদের দেশের মূল সম্পদ হচ্ছে জনশক্তি, এই জনশক্তির দুই তৃতীয়াংশই হচ্ছে তরুণ ও যুবসমাজ। তরুণ ও যুবকের জন্য এসময়টা খেলাধুলা আর লেখা পড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকবার হলেও দুঃখের বিষয় আমাদের তরুণ ও যুবসমাজের বড় একটা অংশ আজ মাদক নামক মরণ নেশায় আক্রান্ত। বিভিন্ন সংস্থার জরিপে দেখা গেছে মাদকাসক্তদের শতকরা ৮০ শতাংশ তরুণ ও যুবক।

নেশার রাজ্যে বিচরণকারী আরেক দলের নাম মেয়ে মাদকাসক্ত। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে ছেলেদের সাথে সাথে মেয়েরাও রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে। নেশার জগতেও তাদের বিচরণ সমানে সমান। ছেলেদের চাইতে কিছুটা গোপনীয়তা রক্ষা করলেও নেশায় ক্ষতির ঝুঁকি ছেলেদের থেকে মেয়েদের’ই বেশি। কেও পারিবারিক কলহ আবার কেও ছেলেবন্ধুর প্রতারণার স্বীকার এমন মেয়েরাই মূলত বেছে নেয় নেশার পথ। বখাটে ছেলে বন্ধুরা নিজেদের দল ভারী করতে মেয়ে বান্ধবীকে এপথে টেনে নিয়ে আসে, এরপর সাময়িক স্বস্তির জন্য শুরু হলেও এই পথই হয়ে যায় তাদের জন্য না ফেরার দেশ।

কুৎসিত এবং মারাত্মক এই পথ থেকে ফেরা খুবই কঠিন কারণ আমাদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন প্রকার শারীরিক-মানসিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ফলে, মাদক সেবনে বাধ্য হয় তারা। পরবর্তীতে এটা দৈনিক সেবনে একটি নেশা হিসেবে গড়ে উঠে। মাদক সেবনে আসক্ত ব্যক্তিদেরকে মাদক দ্রব্য কুড়ে কুড়ে খেয়ে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে যায়।

মাদকসেবীর জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়।ফলে আমাদের দেশ আজ ভয়াবহ বিপর্যয়ের অতি নিকটে, মাদক সেবনের ফলে আমাদের তরুণ ও যুবসমাজ জীবনশক্তি,  সৃজনশীলতা, নৈতিকতা ও মেধা হারিয়ে তাদের সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ হয়ে পড়ছে অনিশ্চিত। এবং এদের অধিকাংশই  জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে। কুপথে যাওয়া এমন সন্তানদের বাবা-মায়ের কাছে এমন দৃশ্য যেমনি অসহ্যকর তেমনি অপমানজনক কিন্তু এসবের পেছনেও যুক্তি আছে নষ্ট হয়ে যাওয়া এসব সন্তানদের।

যুবসমাজের এই বিপদগামিতার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে বেকারত্ব। দেশে কর্মক্ষেত্রের অভাব হেতু লক্ষ লক্ষ তরুণ-তরুণী লেখা পড়া শেষ করে বেকার জীবন যাপন করছে। এরা বাবা মায়ের উপরও নির্ভর করতে পারে না। চাকরির চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে তারা যখন হতাশার গর্তে পড়ে হাবুডুবু খায়, ঠিক তখনি তারা কিছুটা মিথ্যে সুখ খুঁজতে নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়ে ভয়াবহ এই নেশার জগতে।

পৃথিবীর অনেক কিছুই দেখবার আগে সব সব কিছু শেষ হয়ে যাবার এই গল্পের পরের অংশ আরো নির্মম নিষ্ঠুর এবং হৃদয়বিদারক। কিন্তু যাদের গল্প এখনো সুস্থ স্বাভাবিক তাদেরকে রক্ষায় আমাদের পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কতটা সাবধান?
আমরা জানি নেশার মরণথাবা মানুষের অমূল্য জীবনকে মূল্যহীন করে দিচ্ছে। একজন নেশা ক্ষোর মানুষ যেভাবে নিজের জীবন ধ্বংস করছে ঠিক একই ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে তার আশ-পাশের মানুষ গুলোকেও। কিন্তু সেই নেশার আসর বন্ধ করতে আমরা কতটা সতর্ক?

নেশার ছোবল থেকে মানুষকে দূরে রাখার দুটো পদ্ধতি বিশ্ব জুড়ে প্রচলিত রয়েছে, এর একটি মানুষকে সচেতন করে মাদকদ্রব্য উন্মুক্ত করে দেয়া এবং অন্যটি মাদকদ্রব্য প্রদর্শন বাজারজাতকরণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে।  তাছাড়া মাদকের এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে সমাজকে বাচাতে হলে সর্বপ্রথম মাদকের চাহিদা শূন্যের কোটায় নিয়ে আসতে হবে। তার পাশাপাশি পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে বিভিন্ন ধরনের সৃষ্টিশীল প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান, খেলাধুলা এবং মাদক-বিরোধী সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে শিশু-কিশোর ও তরুণ সমাজকে গড়ে তোলতে হবে।

মাদকাসক্তির ভয়াবহতা এবং কুফল সম্পর্কে পরিবার, সমাজ, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর কুফল এবং ভয়াবহতা সম্পর্কে জানানো হলে এবং সামাজিকভাবে মাদকবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণ সমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির ভয়াবহতার কুফল সম্পর্কে জানিয়ে, জনগণের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে, যাতে আর নতুন করে কারো সন্তান, কারো ভাই, কারো প্রিয়জন মাদক নামক মরণ নেশায় আক্রান্ত হয়ে নিজের সুন্দর জীবনকে তিলে তিলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে না দেয়। ইতিমধ্যে যারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছেন তাদেরকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে, কারণ একজন আসক্ত ব্যক্তি খারাপ নয়, পাগল নয়, তবে অসুস্থ।

জীবনের এই কালো অধ্যায় থেকে কবে তারা ফিরে আসবে জানে না তাদের কেওই, আমরাও জানি না আমদের এই তরুণ প্রজন্ম কবে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে। তবে স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? শুধু তাদের উপর দোষ চাপিয়ে না দিয়ে আমাদের উচিত তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়া।  অর্থাৎ সমাজকে মাদকমুক্ত করতে রাষ্ট্র এবং পরিবারের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্রের পাশাপাশি  প্রতিটি পরিবারের সচেতনতা, ভালবাসা, দৃঢ় অঙ্গীকার ও সক্রিয় ভূমিকা মাদকাসক্তি নামক বিভীষিকাকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করতে পারে।

একই সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা এবং প্রত্যেক পরিবার, সমাজ এবং সরকারকে একসাথে এগিয়ে আসতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের গণ-সচেতনতামূলক আন্দোলনের মাধ্যমে একটি সুন্দর জাতি গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করার মাধ্যমেই একটি সুস্থ জাতি গঠন করা সম্ভব। চলুন মাদক’কে নেশা না বানিয়ে “মাদক কে না বলুন” এই উক্তি’কেই বানাই বাস্তবিক জীবনে আমার আপনার এবং গণ-মানুষের নেশা।

error: Content is protected !!