হোম » অপরাধ-দুর্নীতি » লালমনিরহাটের মোগলহাট রেলপথের ১১কিলোমিটার লাইন ও স্লিপার চুরি!

লালমনিরহাটের মোগলহাট রেলপথের ১১কিলোমিটার লাইন ও স্লিপার চুরি!

মোঃ মাসুদ রানা রাশেদ, লালমনিরহাট প্রতিনিধি: লালমনিরহাট জেলা সদরের মোগলহাট স্থলবন্দরের দিকে নীরবে নিভৃতে তাকিয়ে আছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের গিদালদাহ সেতু। কোন ভাবেই চুরির কবল থেকে রক্ষা পায়নি প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে যুক্ত লালমনিরহাট টু মোগলহাটের ১২কিলোমিটার রেলপথ।
যুগের পর যুগ ধরে পরিত্যাক্ত থাকায় ১২কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে ১১কিলোমিটার লাইন ও স্লিপার চুরি হয়ে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশ পণ্য আমদানী-রপ্তানীসহ দু’দেশের পাসপোর্ট ধারী যাত্রীদের চলাচলে মোগলহাটে একটি চেকপোষ্ট ও ইমিগ্রেশনও চালু ছিল। পুরাতন দিনের কার্যক্রম আবারও চালু হবে সেই আশায় আজও মোগলহাট স্থলবন্দরের দিকে নীরবে-নিভৃতে তাকিয়ে আছে ধরলা নদীর উপর নির্মিত ভারতের গিদালদাহ রেলওয়ে সেতু।
জানা গেছে, দেশের উত্তরের সীমান্তবর্তী একটি জেলার নাম লালমনিরহাট। এ জেলাকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগীয় ডিভিশন। উক্ত ডিভিশনের আওতাধীন ৭৩টি ষ্টেশন থাকলেও এখন ৭২টি সচল রয়েছে। আর একমাত্র ষ্টেশন মোগলহাট যুগের পর যুগ ধরে পরিত্যাক্ত রয়েছে। লালমনিরহাট-টু-মোগলহাট স্টেশন হয়ে ধরলা নদীর উপর নির্মিত ভারতের গিদালদাহ রেল সেতু দিয়ে পার্সপোটধারী যাত্রীসহ ভারত-বাংলাদেশের অনেক ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্যে হতো। সেই সময় থেকে মোগলহাটকে স্থলবন্দর করার দাবীও উঠেছিল।
এই স্থলবন্দর চালু হলে বাংলাদেশ, ভারত ও ভুটানের সাথে ত্রি-দেশীয় ব্যবসা বাণিজ্য ও আমদানী-রপ্তানী প্রসার ঘটবে। যোগাযোগ, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, পুঁজি বিনিয়োগ এবং নতুন নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পাবে। তাই মোগলহাট রেলপথ, চেকপোষ্ট, ইমিগ্রেশন ও শুল্ক ষ্টেশন এবং স্থলবন্দর চালু করার দাবি তুলেছে লালমনিরহাটের মোগলহাটবাসী ও ব্যবসায়ীগণ। ইতিমধ্যে ছবি তুলে টিভিতে দেখানো, পত্রিকায় সংবাদ ছাপানো হয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, এই বুঝি নামের কলঙ্ক ঘুচবে। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে মোগলহাট স্টেশন পরিত্যাক্ত থাকার কারণে রেলপথের ১২কিলোমিটারের মধ্যে ১১কিলোমিটার লাইন ও স্লিপার চুরি হয়ে গেছে। বাকী ১কিলোমিটার লাইনের উপর গড়ে উঠেছে বাড়ী, দোকানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। কোন ভাবেই রক্ষা পায়নি ভারতের সঙ্গে যুক্ত থাকা লালমনিরহাট টু মোগলহাটের এ রেলপথ। অপর একটি সূত্র জোড় দাবী তুলে জানান, বৃটিশ আমলে উত্তর জনপদের লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের মাধ্যমে ভারতের কলকাতাসহ পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যের সাথে মোগলহাট স্টেশনের রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু ছিল।
ভাতর বর্ষের রেলওয়ে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র ছিল লালমনিরহাট। ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির পরও লালমনিরহাট সদরের মোগলহাট হয়ে ভারতের সাথে রেলওয়ে যোগাযোগ অব্যাহত ছিল। এই রেল পথের মাধ্যমে পূর্ব বাংলার উৎপাদিত পাট, চা, তামাক, চামড়া, ধান, চাল ও শালকাঠ ভারতের যেত। ভারত থেকে কয়লা, লুবলেকেটিং ওয়েল, ডিজেলসহ অন্যান্য মালামাল আমদানী করে নিয়ে আসা হতো। তাছাড়াও দু’দেশের পাসপোর্ট ধারী যাত্রীদের চলাচলে মোগলহাটে একটি চেকপোষ্ট ও ইমিগ্রেশন চালু ছিল। প্রতিদিন শতাধিক পাসপোর্ট ধারী যাত্রী মোগলহাট হয়ে ভারত ও বাংলাদেশে যাতাযাত করতো। আজও সেই মোগলহাটে চেকপোষ্ট ও ইমিগ্রেশনের ঘর পরিত্যাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুঠিয়ে পড়ে আছে।
৮০দশকে ভারতের সাথে রেলওয়ে যোগাযোগ বন্ধ ও সড়ক পথে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পাওয়ায় অ-লাভজনকের কারণে ১২কিলোমিটার লালমনিরহাট-মোগলহাট রেলপথ বন্ধ করে দেয়া হয়। ২০০২ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত মোগলহাট চেকপোষ্ট, ইমিগ্রেশন ও কাষ্টমস বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে দু’দেশের পাসপোর্ট ধারী যাত্রী সাধারণকে বুড়িমারী চেকপোষ্ট কাষ্টমস ইমিগ্রেশের মাধ্যমে যাতাযাত করতে হচ্ছে।
এতে বাংলাদেশের ময়মনসিংহ, টাংগাইল, জামালপুর, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, রংপুর ও কুড়িগ্রামসহ আশেপাশের জেলার পাসপোর্ট ধারী যাত্রী সাধারণকে প্রায় ১শত কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করে ভারতে যেতে হচ্ছে। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের যাত্রী সাধারণকেও অতিরিক্ত পথ অতিক্রম করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত মোগলহাট ষ্টেশন হয়ে ভারতে মালবাহী ওয়াগানে মালামাল পরিবহণ অব্যাহত ছিল। ১৯৮৮ সালের প্রবল বন্যায় ধরলা নদীর তীব্র স্রোত ও ভাঙ্গনে রেলপথে ভারতের ও বাংলাদেশের অংশের প্রায় দু’কিলোমিটার নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তখন থেকে রেলওয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়।
এই রেলপথ, চেকপোষ্ট, ইমিগ্রেশন ও শুল্ক ষ্টেশন চালু হলে, বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি রাজ্য ভুটানের সাথে আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কয়েকশত কিলোমিটার দুরত্ব কমে আসবে এবং সময় ও আর্থিক সাশ্রয় হবে। ১৯৯৬ সালে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লালমনিরহাটে এক নির্বাচনী জনসভায় মোগলহাট রেলওয়ে ষ্টেশন, চেকপোষ্ট ও ইমিগ্রেশন চালুসহ শুল্ক ষ্টেশন স্থাপনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ছিলেন।
ফলে ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কর্তৃক প্রকাশিত প্রজ্ঞাপনে মোগলহাটকে রেলরুট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এদিকে, ২০১১ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মোগলহাটে শুল্ক ষ্টেশন স্থাপনে অবকাঠামো, নিরাপত্তা, বাণিজ্য সম্ভবনা, লোকবল ও যোগাযোগ বিষয়ে পর্যালোচনা পূর্বক মতামত প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃক্ষের নিকট পত্র প্রেরণ করা হলেও কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অপরদিকে দি-ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রীজ (এফবিসিসিআই) এর উদ্যোগে ২০১৬ সালের ১৫ থেকে ১৭ জুলাই ভারতের কলকাতা ও শিলিগুড়িতে ৪ দেশীয় বিজনেস ডেলিগেশন (বিবিআইএন) সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এতে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ও নেপালের ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ অংশ গ্রহণ করেন। পরে লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাষ্ট্রির প্রতিনিধি দলের সাথে ভারতের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের এক দ্বি-পাক্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন মন্ত্রী রবীন্দ্র ঘোষ উপস্থিত ছিলেন।
error: Content is protected !!