হোম » অপরাধ-দুর্নীতি » চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সর্তক থাকুন- সর্তক রাখুন। চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সাহেদ-সাবরিনা মন্তব্য স্বাস্থ্যখাতের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।

চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সর্তক থাকুন- সর্তক রাখুন। চিকিৎসার নামে বাণিজ্য, সাহেদ-সাবরিনা মন্তব্য স্বাস্থ্যখাতের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে।

গোপাল অধিকারী: চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য নতুন নয়। চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা অস্বাভাবিক । তবুও দীর্ঘ অভিযান, আইন ও কর্মকান্ডের পরও স্বাভাবিক হয়নি এই সেক্টরটি। চিকিৎসকবিহীন চিকিৎসা, প্রয়োজনবিহীন টেস্ট আর প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিবিহীন রিপোর্ট নির্মূল হয়নি এসব প্রতারণা। সর্বশেষ করোনা নিয়েও চলছে চিকিৎসা বাণিজ্য। যার প্রতিফলন করোনার সার্টিফিকেট জালিয়াতি বা বা অনুমোদহীন করোনার নমুনা সংগ্রহ। কতটা অমানবিক হলে এই সংকটময় সময়ে চিকিৎসার নামে বাণিজ্য করা যায় তা আমার কাছে বোধগম্য নয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলেই সার্টিফিকেট জালিয়াতি ও প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করার সংবাদ পেয়েছি। সর্বশেষ চিকিৎসা সেক্টরের এই অপরাধের মাঝে ঘি ঢেলেছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ও রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ।

করোনা মহামারিতে মানুষের জীবন নিয়ে নির্মম প্রতারণায় উঠে এসেছে সাবরিনা চৌধুরী নামে এক চিকিৎসক ও স্বামীর নাম। জেকেজি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে বিশদ তদন্ত করতে গিয়েই উঠে আসে তাদের নাম। জেকেজির ব্যাপারে তদন্ত করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই প্রতিষ্ঠানটি ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনার টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট সরবরাহ করেছে। একটি ল্যাপটপ থেকে গুলশানে তাদের অফিসের ১৫ তলার ফ্লোর থেকে এই মনগড়া করোনা পরীক্ষার প্রতিবেদন তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মেইলে পাঠায় তারা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় থেকে জব্দ ল্যাপটপ পরীক্ষা- নিরীক্ষার পর করোনা টেস্ট জালিয়াতির এমন চমকপ্রদ তথ্য মিলেছে।

 

এতে দেখা গেছে, টেস্টের জন্য জনপ্রতি নেওয়া হয় সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। বিদেশি নাগরিকদের কাছে জনপ্রতি একশ্#৩৯; ডলার। এ হিসাবে করোনার টেস্ট বাণিজ্য করে জেকেজি হাতিয়ে নিয়েছে সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সাবরিনার হাত ধরেই করোনার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি ভাগিয়ে নেয় অনেকটা অখ্যাত জেকেজি নামে এই প্রতিষ্ঠান। প্রথমে তিতুমীর কলেজে মাঠে স্যাম্পল কালেকশন বুথ স্থাপনের অনুমতি মিললেও প্রভাব খাটিয়ে ঢাকার অন্য এলাকা আর অনেক জেলা থেকেও নমুনা সংগ্রহ করছিলেন তারা। বিএমএর নেতার পরিচয় ভাঙিয়ে চলাফেরা করেন সাবরিনা। গত ২৪ জুন জেকেজির গুলশান কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে আরিফসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। ৩৯;জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় মোট চারটি মামলা দায়ের করা হয়। সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি ছিল জেকেজির। পরে ওই চুক্তি বাতিল করা হয়। জেকেজির চেয়ারম্যান ডা. সাবরিনা চৌধুরী জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক। তার স্বামীর নাম আরিফ চৌধুরী। এই দম্পতির জীবনও রূপকথার মতো।

 

একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা হয়ে সাবরিনার এহেন কর্মকান্ড কোন বিবেকবান সমাজ মেনে নিবে বলে মনে হয় না। তারপরও চলতে থাকে বা থাকবে এমন কাহিনী। সময় ও নামের শুধু পরিবর্তন দেখি। কিন্তু কেন? এই অব্যবস্থাপনার জন্য দায়ীই বা কার্ধাসঢ়;? শুধু এই ক্যালেঙ্কারীই নয়। সাবরিনা রীতিমত মডেল হবার জন্যও চেষ্টা করছেন তার বিভিন্ন ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে যা একজন
চিকিৎসক হয়ে সকলে পারে না। চোখ রাখি সাহেদের দিকে।

 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে তাকে বোরকা সাহেদ নামে কেউ বা সাহেদা নামেও পরিচিতি করছেন। গত ৬ জুলাই তার রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর সাহেদসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অভিযানের পর প্রতারণার দায়ে রিজেন্ট হাসপাতাল ও প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দেয় র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। দেশজুড়ে আলোচিত রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদকে অবশেষে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃংখলা বাহিনী। ১৫ জুলাই বুধবার ভোরে সাতক্ষীরা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। করোনার নমুনা পরীক্ষার মনগড়া রিপোর্ট দেয়ার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে এবার মামলা হলেও ধীরে ধীরে তার সব অপকর্ম সামনে চলে আসছে। জানা গেছে, ২০১০ সালের দিকে ধানমন্ডি এলাকায় বিডিএস ক্লিক ওয়ান এবং কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি (কেকেএস) নামে দুটি এমএলএম কোম্পানি খুলে গ্রাহকদের কাছ থেকে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

 

সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩২টি মামলা খুঁজে পেয়েছেন র‌্যাব । এর বেশিরভাগই প্রতারণা মামলা। কারণ প্রতারণা করে অর্থ-সম্পদ গড়ে তোলাই ছিল তার মূলকাজ। এ জন্য করোনামহামারি চলাকালেও স্পর্শকাতর একটি বিষয়েও সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতে বিবেকে বাঁধেনি তার। ২০১১ সালে প্রতারণা মামলায় সাহেদ একবার গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের বিনিময়ে দ্রুতই তিনি জামিন নিয়ে কারাগার থেকে বের হয়ে আসেন। এরপর প্রতারণার অর্থ দিয়ে তিনি রিজেন্ট গ্রুপ নামে ব্যবসা শুরু করেন। চালু করেন রিজেন্ট হাসপাতাল। কিন্তু ২০১৪ সালেই এই হাসপাতালের লাইসেন্সর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। কিন্তু এই নিয়েও রয়েছে লম্বা ইতিহাস। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে যে, রিজেন্ট হসপিটালকে অনুমোদন দিতাম না আমাকে যদি মন্ত্রণালয় থেকে না বলা হতো।

 

অন্যদিকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তির আগে অধিদপ্তর তাদের কাছে কোনো নথি পাঠায়নি, কোনো প্রস্তাবও পাঠায়নি। তবে ওই হাসপাতালের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের অনুষ্ঠানে মন্ত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সেই দাওয়াতেই মন্ত্রী উপস্থিত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জানানো হলো স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের পূর্বের প্রধান সম্মতি দিয়েছিল। এই তথ্যের গড়মিল বা নিজেকে বাঁচানো প্রবণতা তা থেকে কিন্তু সহজেই অনমান করা গেল স্বাস্থ্যখাতের কালো বিড়ালের ইতিহাস। চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা বা জনগুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরের অব্যবস্থাপনা কোন কালের বা কোন মাত্রায়ই কাম্য নয়।

 

সাধারণ জনগণ ও গুরুত্বপূর্ণ জনগণ এই দুই নামের জনগণ আছে কি না বা তাদের জন্য আইনের ফাঁক-ফোকর আছে কি না তা নিয়ে আমি বেশ সংকিত বোধ করছি। সংকিত এই কারণেই যে, যে কোন প্রতিষ্ঠান করতে গেলে জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে শুরু করে এই সার্টিফিকেট সেই সার্টিফিকেট সত্যায়িত প্রমাণিত কত কিছু প্রয়োজন হয়। কিন্তু সাহেদ বা সাবরিনার কি কিছুই প্রয়োজন হয় নি? তাদের জন্য নিয়মটা কি পৃথক ছিল, না তাদের বৈধ্যতাদানের প্রতিষ্ঠান পৃথক ছিল যে এত অপকর্ম থাকার পরও তারা চিকিৎসা নিয়ে ব্যবসা করতে পারল। শুধু বেসরকারি সেক্টরেই নয় গলদ রয়েছে সরকারি সেক্টরেও। পর্দা ক্যালেঙ্কারী, মেশিন কেলেঙ্কারীর কথা এখনো ভুলে নি মানুষ।

 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, একটি দেশের জনসংখ্যার অনুপাতে যতজন ডাক্তার, নার্স, মেডিকেল টেকনলজিস্ট, অ্যানেস্থেটিস্ট থাকা আদর্শ সেটি বাংলাদেশে নেই৷ করোনার কারণে সেই সংকট প্রবলভাবে দেখা গেছে৷ বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী বলছেন, একজন ডাক্তারের বিপরীতে নার্স থাকতে হয় তিন জন৷ কিন্তু বাংলাদেশে আছে আধা জন৷ এছাড়া স্বাস্থ্যসেবা দিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবতো আছেই৷ একটার পর একটা দুর্নীতি অনিয়মের কেলেঙ্কারি ধরা পড়ছে বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতেও।

আর এসব ঘটনার সাথে যারা জড়িত তারা সবাই অপকর্ম করছে রাজনৈতিক পরিচয়ে। দলগুলো তাদের পরিচয় অস্বীকার করলেও দায় কি এড়াতে পারে? আমি পূর্বেই বলেছি চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য কাম্য নয় কারো কাছেই। আমি মনে করি চিকিৎসা নিয়ে বাণিজ্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার সামিল। কারণ চিকিৎসার অধিকার একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার। তাছাড়া অন্যান্য মৌলিক অধিকার খর্ব হলে মানুষ বাঁচতে পারে মানবেতরভাবে কিন্তু চিকিৎসাখাতে বাণিজ্য হলে অনেকেই মৃত্যুর কোলে ঢোলে পরে। ইতিমধ্যে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যম থেকে দাবি উঠেছে।

বর্তমানে স্বাস্থ্যখাতে প্রকৃতপক্ষেই ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি চোখে পরছে। হয়ত করোনায় সেগুলো প্রকাশ করতে সহায়তা করছে। আমার কাছে মনে হয় খারাপ কাজে জয়ী হবারচেয়ে ভাল কাজে পরাজয়ও ভাল। এখন যদি স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন তিনি নিজের সুবুদ্ধিরই পরিচয় দিবেন। কারণ তার বিভাগের দূর্নীতি ও তার কথার গলদ সকলে জেনেছেন। স্বাস্থ্যবিভাগের তিনটি বিষয়ে আমার মনে হয় কঠোর নজরদারী প্রয়োজন।

এক. কোন প্রতিষ্ঠান সঠিক নিয়মে অনুমোদন নিচ্ছে বা নবায়ন করছে কি না, দুই. কোন প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনবিহীন টেস্ট করছে কি না, তিন. কোন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান চিকিৎসকবিহীন চলছে কি না। প্রয়োজনে এই তিনটি কাজ তদারকির জন্য সারাদেশে আলাদা পরিষদ গঠন করতে পারেন। চিকিৎসার নামে বাণিজ্য বা অপচিকিৎসা কোনটাই সভ্য রাষ্ট্রের জন্য কাম্য নয়। কাম্য নয় চিকিৎসা বিভাগের ধীরগতি। করোনা টেস্টের যে বাধ্যবাধকতা দিয়েছে আমি তার সাথে দ্বিমত পোষণ করছি।

কারণ জাতীয় সংকটময় সময়ে দেশে যেমন জরুরী অবস্থা জারী করা হয় আমার মতে সংকট সময়ে যে সেক্টরে সংকট ত্বরান্বিত হচ্ছে সেই সেক্টরকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া উচিত। অথ্যাৎ আমি বলতে চাইছি বর্তমানে করোনার টেস্ট বৃদ্ধি করা ও ফি বাদ দিয়ে রাষ্ট্রমালিকানায় বিনামূল্যে করা উচিত। সংকট দ্রæততম সময়ে সমাধান করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় সীমিত সময়ের মধ্যে করা উচিত। তবেই সংকট সহজে সমাধান হবে। সরকারের উপর দায়ভার কমবে।

একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে আমি স্বাস্থ্যবিভাগের উন্নতি কামনা করি। আমি দাবি করছি অনিয়মে জড়িত থাকা সকল চিকিৎসাকেন্দ্রের কঠোর ব্যবস্থা। সরকারের ভাবমূর্তি অক্ষুন্ন রাখতে স্বাস্থ্যখাতের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। কঠোর আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে স্বাস্থ্য সুরক্ষা। স্বাস্থ্যখাতের কঠোর সর্তকতা ছাড়া সাহেদ বা সাবরিনার মত আরও অনেক ধূর্ত ব্যক্তিরা এই সেক্টরকে ব্যবসায় পরিণত করবে। ক্ষুন্ন হবে সরকার তথা দেশের সুনাম। এখনই সময় স্বাস্থ্যখাতকে ঢেলে সাজান। সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিন। সর্তক থাকুন আর সর্তক রাখুন।

Loading

error: Content is protected !!