হোম » সারাদেশ » মিয়ানমারে সংঘাত: গোলাগুলির শব্দে আতংকে স্থানীয়রা ,আবারও  অনুপ্রবেশর চেষ্টা ‘ রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ফিরিয়ে দিল বিজিবি

মিয়ানমারে সংঘাত: গোলাগুলির শব্দে আতংকে স্থানীয়রা ,আবারও  অনুপ্রবেশর চেষ্টা ‘ রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ফিরিয়ে দিল বিজিবি

মিয়ানমার রাখাইনে আরাকান আর্মি ও দেশটির সেনাবাহিনীর মধ্যেই সংঘর্ষ যেন থামছেই না। রাতে-দিনে চলছে গোলাগুলি। ওপারের বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে এপারের সীমান্তের বাড়িঘর। নদী পার দূরত্ব হলেও ভয়ে এপারের অনেকে নির্ঘূম রাত কাটিয়েছে। 
আর ওপারে বাস করা সাধারণ রোহিঙ্গারা আতংকে এলাকা ছাড়ছে। নাফতীরে বাসরত রোহিঙ্গারা জড়ো হয়ে নৌকা বোঝাই করে নাফনদী পেরিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়েছে। এমন শতাধিক রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুকে আবার নিজদেশে ফিরিয়ে দিয়েছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা।
বুধ রাত ও বৃহস্পতিবার সকালে নাফ নদী দিয়ে তারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায় বলে জানিয়েছে প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় একাধিক সূত্র।
তবে এ প্রসঙ্গে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক বা তার কোন সূত্রের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রে জানায়, মিয়ানমারের রাখাইনের মংডু শহর দখলে নিতে আরাকান আর্মি, দেশটির সেনাবাহিনীর সাথে চুড়ান্ত লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। আর শহরটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পাল্টা হামলা চালাচ্ছে দেশটি’র সেনাবাহিনীও। এ হামলার বিস্ফোরণের বিকট শব্দে তিনদিন ধরে কাঁপছে টেকনাফ সীমান্ত।
অসমর্থিত সূত্র মতে, মিয়ানমারে এখনও সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর মধ্য রাখাইনের বুথেডংয়ে আড়াই লাখ, মংডুতে তিন লাখ এবং বাকিরা আকিয়াবসহ অন্য টাউনে রয়েছে। বর্তমানে মংডুতে হামলা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ রোহিঙ্গাদের বাস। তাদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফে পালিয়ে আসার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
রাখাইন ও সীমান্তের স্থানীয় সূত্র মতে, দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি রাখাইনের মংডু শহর নিয়ন্ত্রণে নিতে সামরিক বাহিনীর ওপর প্রবল হামলা চালাচ্ছে। শহরটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্থল-আকাশ ও জলপথ থেকে আরাকান আর্মিকে হামলা চালায়। ফলে তুমুল যুদ্ধে ঘটছে প্রাণহানিও। এই গৃহযুদ্ধে রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের সুদাপাড়া, হাদিবিল, নুরুল্লা পাড়া, হাইর পাড়া, মুন্নী পাড়া, সাইরা পাড়া, ফাতনজা, ফেরানপ্রু, সিকদার পাড়া, হাঁড়ি পাড়া, হেতিল্লা পাড়ার বাসিন্দারা গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছেন। এদের মধ্য অনেকে সীমান্ত দিয়ে এপারে অনুপ্রবেশের অপেক্ষা জড়ো হয়েছে। ফলে মিয়ানমার সীমান্ত পেরিয়ে টেকনাফে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা বাড়তে পারে। একই সঙ্গে মিয়ানমারের বিজিপি সদস্যদের অনুপ্রবেশও বাড়তে পারে।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য মতে, রাখাইনে দুই পক্ষের যুদ্ধে মংডু ও বুচিডংয়ে অর্ধলাখাধিক রোহিঙ্গা আটকা পড়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাফনদীতে মাছ আহরণ করা একাধিক জেলে ও জেটিঘাটের স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, দেখা গেছে নাফনদীর টেকনাফ জেটিঘাটের শেষের অংশে নারী-পুরুষ ও শিশুসহ কিছু রোহিঙ্গাকে জড়ো করে রাখেন বিজিবি’র সদস্যরা। পরে তাদেরকে নৌকাসহ বিজিবি’র সদস্যরা আবার মিয়ানমারের ফেরত পাঠায়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, টেকনাফ জেটিঘাট, নাইট্যংপাড়া, দমদমিয়া, শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং, নাজিরপাড়া নাফনদীর ওপারে রাখাইনের মংডু শহরের নিকটবর্তী সীমান্তে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জড়ো হয়েছেন। সুযোগ পেলেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে টেকনাফ সীমান্তে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন তারা।
তবে, রোহিঙ্গারা যাতে নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য সীমান্ত-নাফনদে বিজিবি-কোস্ট গার্ড সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।
উখিয়ার আশ্রয় ক্যাম্পের কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, দুই পক্ষের গোলাগুলিতে অনেক রোহিঙ্গা মারা যাচ্ছে। এখন পাশের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ছাড়া তাদের যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই যে কোনো সময় তারা সীমান্তের দিকে ছুটতে পারে। কিন্তু যারা এপারে আসতে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছে, তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের (এআরএসপিএইচ) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, মূলত রাখাইনে যেসব রোহিঙ্গা রয়েছে তাদের নিশ্চিহ্ন করতেই যুদ্ধের নামে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে দেশটির সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির মাঝে নাটক চলছে। আমি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অনুরোধ করবো, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপত্তার সাথে বসবাস করতে সহযোগিতা করুন।
সীমান্ত পেরিয়ে রোহিঙ্গা আসা কিংবা এপারে আসা নৌকা ফেরত পাঠানোর বিষয়ে বিজিবির স্থানীয় দায়িত্বশীলদের কারো বক্তব্য না পাওয়ায় সবিশেষ লিখে বিজিবি হেডকোয়ার্টারের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরীফুল ইসলামকে ম্যাসেজ দেয়া হয়। তিনি কোন উত্তর না করায় বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
তবে, বিজিবির ওয়েবসাইটের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ৩ হাজার ৩৫৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে তাদের মিয়ানমারে (স্বদেশে) ফেরত পাঠায় বিজিবি। তাদের মধ্যে ৮৪৮ জন নারী, ৭৪৯ শিশু ও এক হাজার ৭৫৭ জন পুরুষ। আর তিন রোহিঙ্গাকে থানায় দেয়া হয়।
সীমান্ত পরিস্থিতি বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, স্থানীয়দের মাধ্যমে আমিও শুনেছি রোহিঙ্গা বোঝাই কয়েকটি নৌকা নাফনদী পেরিয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে অনুপ্রেবেশের চেষ্টা করে। আর বিজিবির সদস্যরা তাদেরকে মিয়ানমারের ফেরত পাঠায়। রাখাইনের ওপারে বিস্ফোরণের শব্দ টেকনাফে এখনো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
সীমান্ত সূত্র জানায়, টানা সাড়ে তিন মাস ধরে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর সঙ্গে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। সম্প্রতি মংডু টাউনশিপের উত্তর ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে দুটি শহরসহ সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ১৪টি সীমান্তচৌকি, রাচিডং-বুচিডং টাউনশিপের বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এখন মংডু শহর দখলের জন্য লড়ছে তারা।
-মোহাম্মদ খোরশেদ হেলালী-

Loading

error: Content is protected !!