হোম » সারাদেশ » নোয়াখালী পাসপোর্ট অধিদপ্তরে সক্রিয় দালাল চক্র

নোয়াখালী পাসপোর্ট অধিদপ্তরে সক্রিয় দালাল চক্র

Oplus_131072

মোহাম্মদ হানিফ , নোয়াখালী প্রতিনিধি : নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অধিদপ্তরে দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ করেছেন সেবাগ্রহীতারা।ভুক্তভোগীরা জানান, এ দপ্তরে দালাল ছাড়া কোনো গ্রাহক পাসপোর্ট নামের সোনার হরিণ সহজে হাতে পায় না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাইমুড়ী উপজেলার এক দালাল বলেন, ‘সাধারণ ই-পাসপোর্ট করতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ব্যাংক ড্রাফট ৪ হাজার ২৫ টাকা, অনলাইনে আবেদন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের এক হাজার টাকা দিতে হয়।’
নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া হয় না কোনো কাজ। বাধ্য হয়ে চক্রের হাতে জিম্মি হতে হচ্ছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের। এ অফিসে দালালদের মাধ্যমে অতিরিক্ত ফি ও উৎকোচ ছাড়া মিলছে না পাসপোর্ট।
এসব ঘটনা নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে বলে অভিযোগ করছেন সেবাগ্রহীতারা।
অভিযোগকারীরা জানান, নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দালালদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেট ছাড়া পাসপোর্ট করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। প্রতিটি পাসপোর্টে দুই-তিন হাজার টাকা ঘুষ বাণিজ্য হয়ে থাকে।
সরেজমিনে দেখা যায়, পাসপোর্ট অফিসের সামনে নোয়াখালী-ঢাকা মহাসড়কের দুই পাশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কম্পিউটারের দোকান।
এসব দোকানের আড়ালে চলে পাসপোর্টের দালালি। অনেকেই এদের খপ্পরে পড়ে অতিরিক্ত টাকা গুনছেন বলে জানান অভিযোগকারীরা। পাসপোর্ট অফিসের সামনে ও ভেতরে এসব দালাল চক্রের লোকজন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ঘোরাঘুরি করতে দেখা যায়। দালাল চক্রের অনুসরণ না করলে পাসপোর্ট প্রত্যাশীকে পড়তে হয় বিপাকে। নিজের পাসপোর্ট নিজেই করতে গেলে সময়মতো পাওয়া অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
অভিযোগকারীরা আরও জানান, প্রতিটি আবেদনে দালালের সাংকেতিক চিহ্ন রয়েছে। এ চিহ্ন ছাড়া কেউ গেলে নানা ভুল-ভ্রান্তির অজুহাতে হয়রানি হতে হয় সাধারণ গ্রাহকদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ২৬ আগস্ট নোয়াখালী পাসপোর্ট অফিসে র‍্যাব-১১ অভিযান পরিচালনা করে ১৭ জন দালালকে আটক করে। একই বছরের ২০ মার্চ আরেক অভিযানে ১৪ জন দালালকে আটক করে র‍্যাব, তবে এর পরেও থেমে নেই দালাল চক্রের কর্মকাণ্ড।
কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগ করে জানান, পাসপোর্ট করার জন্য নিজে আবেদন করতে গেলে অফিসের কর্মচারীরা নানা ভুল দেখিয়ে হয়রানি করেন। তাই ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে অনেকেই দালালির মাধ্যমে পাসপোর্ট করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর এ সুযোগে প্রতিটি পাসপোর্ট বাবদ দুই থেকে তিন হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়, যার একটি নির্দিষ্ট অংশ পৌঁছে যাচ্ছে পাসপোর্ট অফিসের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের হাতে।
এক অভিযোগকারী বলেন, ‘কর্মকর্তাদের নির্দেশে অফিসের সামনে কম্পিউটার দোকানদার দালাল সেলিমের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। নাম, পিতার নাম, বয়স ভুল হলেই এ অফিসে টাকা গুনতে হয় ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত।’
কয়েকজন পাসপোর্ট আবেদনকারী জানান, সোনাইমুড়ী উপজেলার বাগপাচঁরা গ্রামের শফিকুর রহমান ওরফে হোডা মামু, কাঁঠালি গ্রামের আনোয়ার হোসেন, সোনাইমুড়ী বাজারের শাপলা স্টুডিওর স্বপন, ডুমুরিয়া গ্রামের খোকন ওরপে আর্মি, দেওটি বাজারের ব্যবসায়ী মনির, মতিন, বাংলাবাজার এশিয়া ব্যাংকের এজেন্ট খোকন, বজরা বাজার এশিয়া ব্যাংকের এজেন্ট মতিন, ছাতারপাইয়া বাজারের স্টুডিও ব্যবসায়ী জহির পাসপোর্টের দালালি করে থাকেন।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সোনাইমুড়ীর খাদ্য গুদামের বিপরীতে বদরুদ্দোজা মার্কেটে নুরুল আলম আনোয়ার নামে এক ব্যক্তি সুফিয়া এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠান দিয়ে দীর্ঘ বছর ধরে পাসপোর্টের দালালি করে আসছেন। সে পাসপোর্টের আবেদন ও পরামর্শ দেয়ার কথা বলে ভিজিটিং কার্ড ছাপিয়ে করছে দালালি। প্রতিটি পাসপোর্টে সে অতিরিক্ত টাকা নিয়ে থাকেন। ভুল ত্রুটি থাকলে মোট অঙ্কের টাকা চুক্তি করে অফিসের মাধ্যমে কাজ করিয়ে দেন।
নোয়াখালী সদর এলাকার সোহাগ জানান, দালাল ছাড়া কোনো কাজ হয়না এ অফিসে। আবেদন ফর্ম পূরণ, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও ছবি তুলতে গেলে অফিসের কর্মচারীরা খারাপ ব্যবহার করে থাকেন। আর মাইজদী শহরে অধিকাংশ কম্পিউটার দোকানে পাসপোর্টের আবেদন করার নামে চলে চুক্তি। তাদের সঙ্গে চুক্তি করলেই হয়রানি ছাড়া পাসপোর্ট করা যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সোনাইমুড়ী উপজেলার এক দালাল বলেন, ‘নতুন সিস্টেমে কাজ করতে হয়। বাইরে গেট থেকে আমাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ লোকদের কাগজপত্র দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেই। অফিসে কর্মকর্তাদের ফোন করে নাম-ঠিকানা জানিয়ে দেই।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণ ই-পাসপোর্ট করতে ছয় থেকে সাড়ে ছয় হাজার টাকা নিয়ে থাকি। এর মধ্যে ব্যাংক ড্রাফট ৪ হাজার ২৫ টাকা, অনলাইনে আবেদন ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, পরিস্থিতি বুঝে পুলিশ ভেরিফিকেশনে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা দিতে হয়। পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের এক হাজার টাকা দিতে হয়। আর জরুরি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে সাড়ে ১০ হাজার নিয়ে থাকি। সে ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের একটু বেশি টাকা দিতে হয়।’
নোয়াখালীর ডিএসবির এক কর্মকর্তা জানান, দালালদের সঙ্গে রয়েছে অফিসের কর্মকর্তাদের গোপন সিন্ডিকেট। পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন করতে সেবা প্রত্যাশীদের ফোন দিতে গেলেই দেখা যায় ওই পাসপোর্টের আবেদনে দালালদের ফোন নাম্বার রয়েছে। এদের পেশাই পাসপোর্ট এর দালালি করা।
ই-পাসপোর্ট পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ থাকলে আমাদের বলেন। আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব, তবে পাসপোর্ট অফিসের টিঅ্যান্ডটি নম্বর কেন বন্ধ রয়েছে তা আমি জানি না।’
এ বিষয়ে নোয়াখালী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপপরিচালক মোহাম্মদ হাফিজুর রহমানের বক্তব্য নিতে একাধিকবার সরকারি নম্বরে ফোন দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি
error: Content is protected !!