হোম » সাহিত্য » ” হারাধন ভ্যারাইটি স্টোর “

” হারাধন ভ্যারাইটি স্টোর “

আওয়াজ অনলাইনঃ “বলি হারাণ, ও হারাণ , এট্টু তেল দে দিনি বাপ।আজ দত্তদের পুকুর পাড় দিয়ে আসছিলাম সকাল বেলা।রাতে ভাল ঘুম হয়না তো,তাই ভোর থাকতেই বেরিয়ে পড়ি। তা দেখি কি,মাছ ধরা চলতেছে। জালের মধ্যি খলবল করতেছে টাটকা মাছ গুলো। দেখে বড্ড নোভ হলো রে, তা ওরা আমারে নিরাশ করেনি।শালপাতার মধ্যি এত্তগুলো চুনোমাছ দেসে।আজ ভাবতেছি একটু কাঁচা মরিচ কেটে বাটি চচ্চড়ি করবো খন।কিন্তু বাড়িতে তেলের বড্ড আকাল রে বাপ “—– বলেই বুড়ি তার কোচড়ের মধ্যে থেকে একটা ছোট্ট শিশি বের করে হারাধনের দিকে এগিয়ে দেয় —-” আর পারলে কটা আলু ও দিস বাছা।নতুন আলু উঠতেসে তো।গরম ভাতের সাথে আলু সেদ্ধ মেখে খেতি দারুণ লাগে।”

মোড়ের মাথায় ছোট্ট একটা দোকান—– ” হারাধন ভ্যারাইটি স্টোর ” প্রো:—- হারাধন দাস
তা ভ্যারাইটি স্টোর ই বটে।সকালের চা থেকে রাতের গুড নাইট কয়েল— সবই হারাধনের দোকানে পাওয়া যায়।ঐ ছোট্ট ঘুপচি দোকানের মধ্যেই হারাধন সব কিছু পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে।সকালের অবসরে মাঝে মাঝেই আসি হারাধনের ইস্পেসাল কাটিং চা খেতে।দোকানের সামনে কয়েকটা নড়বড়ে বেঞ্চি আর ময়লার আস্তরণ ফেলা টেবিল। কিন্তু চা টা অপূর্ব বানায় হারাধন। সাথে লেড়ো বিস্কুট। মুড ভালো থাকলে ডিম টোস্ট ও বানিয়ে দেয়।কিন্তু আজ বোধহয় হারাধনের মুড ভালো ছিলো না।বুড়ির আবদার শুনে রীতিমত খেঁকিয়ে উঠলো—-” সকাল বেলা এই সবে দোকান খুলেছি বুড়িমা।এখনই চাওয়া শুরু কোরো না তো।সারাদিন খালি এটা দাও আর ওটা দাও।বলি তেল কি মাগনা পাওয়া যায়।খালি দাও আর দাও।”

” চুপ কর ড্যাকরা, তোর কাছে কি বিনি পয়সায় তেল চাইছি। আজ হলো গে মাসের আঠারো তারিখ। তিরিশ তারিখ এলে গুণে গুণে হিসাব বুঝে নিস রে হতচ্ছাড়া।আন্নাকালী বামনী কে পয়সা দেখাচ্ছে।রাখ তোর তেল,চাই নে আমার।
সবে চায়ের কাপে প্রথম চুমুক টা দিয়েছিলাম, বুড়ি দেখলাম ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। তাকিয়ে ছিলাম বুড়ির যাওয়ার দিকে।বয়সের ভারে একটু ঝুঁকে হাঁটছে।একটু কেন বেশ অনেকটাই কুজো।মাথায় তেল বিহীন শনের মতো সাদা চুল।পরণে একটা মলিন সাদা শাড়ি।মন টা সকাল সকাল কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল।
” দিতেই পারতে হারাধন সামান্য তেল, বুড়ির বড্ড লোভ হয়েছিল “— বলেই ফেললাম কথাটা হারাধন কে।

” ও আপনি বুঝবেন না দাদা,এর পেছনে অনেক ঘটনা আছে।সারাদিন খালি এটা দাও আর ওটা দাও “—- হারাধন চা ছাঁকতে ছাঁকতে মুখ তোলে।
” আরে উনি তো দিয়ে দেবেই বলছে, নিশ্চয়ই মাসের শেষে হাতে সামান্য টাকা আসবে।এখন তো আবার সরকার থেকে অনেক ভাতা টাতাও দেয়।ওনার কি কেউ নেই? থাকেন কোথায় উনি?”
আমার একগাদা প্রশ্নের সামনে হারাধন যেন একটু বিরক্ত হলো—-” অতো শত জানিনা দাদা, একাই তো থাকে শুনেছি।মনে হয় এক ছেলে ছিলো। সে তো বিয়ের পর বউ কে নিয়ে সটকান দিয়েছে। এই মুখরা বুড়ির সাথে আর কোন বৌ ই বা থাকবে? ঐ ছেলেই নাকি মাসে মাসে মানি অর্ডার করে কিছু টাকা পাঠায়।ঐ টাকার জোরেই বুড়ির দেমাক। রোজই এটা ওটা এসে নিয়ে যায়।আর কাজের চাপে অতো লিখে রাখতেও পারি না।ঐ বুড়িই আমার দোকান লাটে তুলবে দাদা।”
তারপর বেশ কিছুদিন যাওয়া হয়নি ভ্যারাইটি স্টোরে।সেদিন কি যেন একটা কারণে ছুটি ছিল। বাজার থেকে ফেরার পথে কাটিং চা কে এড়াতে পারলাম না।দোকানে এসে দেখি হারাধন কোন এক খরিদ্দার কে ডিমের দাম নিয়ে কি যেন বোঝাচ্ছে।আমাকে দেখেই এগিয়ে এলো— ” বসুন দাদা,এখুনি আপনার চা বানিয়ে দিচ্ছি।ততক্ষণ একটু খবরের কাগজে চোখ বোলান।
খবর পড়েছিলাম আর দেখছিলাম যে হারাধন কাজের মধ্যেও বারবার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে।একটু যেন চিন্তিত মুখ।
” ব্যাপার কি হারাধন, কেউ আসার আছে নাকি?
” আর বলবেন না দাদা “—- হারাধন চায়ের কাপ নিয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো—” আজ তিন দিন হয়ে গেল বুড়ির কোন পাত্তা নেই। যে মানুষ টা রোজ এসে ঘ্যান ঘ্যান করতো তার হঠাৎ হলো কি? যাক গে,মরুক গে।আমার অতো খোঁজ খবরের দরকার কি?”
কিন্তু একটু পরে কি যেন ভেবেই হারাধন সটান বেরিয়ে এলো দোকান থেকে—” চলুন তো দাদা,একটু খোঁজ নিয়ে দেখে আসি। বুড়িটা বেঘোরে পড়ে আছে কিনা? এই তো সামনেই। মিনিট চারেক লাগবে হয়তো হেঁটে যেতে। তাছাড়া আমার এই মাসের টাকাটা পুরোই বাকি পড়ে আছে।চলুন চলুন। “

প্রথমে ভেবেছিলাম মানবিকতার তাগিদে যাচ্ছে হারাধন কিন্তু ওর শেষের কথাটা দৃষ্টিভঙ্গি টা পাল্টে দিলো।
গিয়ে দেখলাম তেমন কিছুই নয়।তবে হালকা জ্বরের মতো হয়েছিল বুড়ির। কিন্তু হারাধন কে দেখেই একদম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো বুড়ি—-” বলিহারি যাই রে তোকে হতচ্ছাড়া।মাস
শেষ হতে এখনও যে তিনদিন দেরি আছে রে। টাকা চাইতে একেবারে ঘরে এসে জুটলি? তা এলিই যখন তখন দুটি চাল আনতে পারলি নে? এই দুদিন তো পেটে বালিশ বেঁধে পড়ে আছি।”
হারাধন কি যেন ভেবে—” আপনি দু মিনিট বসুন তো দাদা “—- বলেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল।আমি চুপচাপ বসে বসে বুড়ির গজগজ শুনছি—” বড্ড দরদ দেখাতে এসেছে শালা।ও ছোড়া দেখাবে দরদ? ও এসেছে টাকার খোঁজে।”
ঠিক সাত মিনিটের মাথায় হারাধন আবার এসে জুটলো—- হাতে দুটো ক্যারিব্যাগ। ঠকাস করে বুড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে বললো—” এই দুটো জিনিস নিয়ে এ মাসে মোট আট শো বিরাশি টাকা হয়েছে বুড়িমা।এক দু তারিখের মধ্যেই যেন পুরোটা পেয়ে যাই।চলুন দাদা,এবার ওঠা যাক।”

তারপর বেশ কয়েকদিন যাওয়া হয়নি ভ্যারাইটি স্টোরে।একঘেয়ে নিত্যযাত্রা আর সংসারের চাপে জীবনের সুতো টা লাটাই এর মধ্যে কেমন জট পাকিয়ে গেছিলো।
সেদিন অফিস ফেরতা যেতেই হলো ভ্যারাইটি স্টোরে।সিগারেট ফুরিয়ে গেছিলো।তখন সন্ধ্যে প্রায় সোয়া সাতটা।গিয়ে দেখি হারাধন একমনে বসে বসে একটা মানি অর্ডার ফর্ম ফিল আপ করছে।আমাকে দেখেই তড়িঘড়ি করে সেটা লুকানোর চেষ্টা করলো।

” কাকে টাকা পাঠাচ্ছো গো হারাধন? আর এতে অতো লুকানোর বা কি আছে? ”
আমার প্রশ্নের উত্তরে হারাধন মুখ তুললো—
—- ” ঠিকই বলেছেন দাদা।লুকানোর মতো তেমন কোন ব্যাপারই নয়।তবে কি জানেন, এইসব জিনিস প্রচার করতেও তেমন ভাল লাগে না।আসলে সব গোলমালের মূলে ঐ বুড়ি। রাখতেও পারি না আবার ফেলতেও পারি না।ছেলে তো ভুলেও খোঁজ নেয় না।মাঝে আমি চেষ্টা চরিত্র করে বুড়ির ছেলের নাম্বার জোগাড় করে ফোন করেছিলাম।বেশ কিছু টাকা বাকি পড়ে গেছিলো সেইজন্য। তা এমন ধমকে কথা বললো যে বলার নয়।তা আজকের দিনে আর কেই বা বুড়ো মা বাবা কে দেখে বলুন? এরা তো সংসারের বোঝা,তাই না।আমার নয় অনেক কাল আগেই মা বাবা চলে গেছে।থাকলে হয়তো আমিও এমন আচরণ করতাম।

তখনই ডিসিশন নিলাম বুঝলেন।ঐ তো বুড়ি, সে আর মাসে কত টাকার ই বা জিনিস নেবে।ও টুকু আমি ঠিক ম্যানেজ করতে পারবো।মুখে এমন ভাব দেখাতাম যে আমি যেন জিনিস দিতে মোটেই পছন্দ করি না।বুড়িও তখন তার ছেলের কথা বলতো যে সে নাকি মাসে মাসে টাকা পাঠায়।বুড়ির এই শেষ বয়সে বুড়ি কে আর এই অপ্রিয় কথাটা বলতে চাইনি দাদা,যে ছেলে তার খোঁজ ই নেয় না।কতদিন ই বা বাঁচবে বলুন। শেষ জীবনে এই শোক টা নয় নাই পেলো মানুষ টা।তাই নিজেই পোস্ট অফিস থেকে মানি অর্ডার ফর্ম এনে মিছিমিছি ফিল আপ করে মাসে দু হাজার টাকা বুড়ির ঘরে পাঠিয়ে দিতাম ডাক পিয়নের হাত দিয়ে।বুড়ি ভাবতো ওর ছেলেই পাঠিয়েছে।পরের দিনই বুড়ি যখন টাকা শোধ করতে দোকানে আসতো,তখন ওর সে কি মেজাজ। ঐ মেজাজ টুকুই তারিয়ে আরিয়ে উপভোগ করতাম দাদা।আমার টাকা আবার আমার কাছেই ফিরে আসতো দাদা।মোটে তো দু হাজার টাকা।ও টুকু ভগবানের আশীর্বাদ ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবো।
মানুষ টাকে ভাল রাখার জন্যই এই মিথ্যাচার টুকু প্রতি মাসে করে চলেছি।এ কথাটা আপনি ছাড়া আর যেন কেউ না জানে দাদা… প্লিজ। ওওও ভুলেই গেছি।এই নিন আপনার গোল্ড ফ্লেক।”
দোকান থেকে বেরিয়ে এলাম। ছোট্ট ভ্যারাইটি স্টোর এক লহমায় অনেক বড় হয়ে গেল আমার কাছে…..জীবনের সন্ধানে(jiboner sondhane)

সংগৃহীত।

error: Content is protected !!