হোম » প্রধান সংবাদ » সুন্দরবন সংলগ্ন পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে মিলন বাহিনীর রাম রাজত্ব কায়েমে অতিষ্ট এলাকাবাসী

সুন্দরবন সংলগ্ন পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে মিলন বাহিনীর রাম রাজত্ব কায়েমে অতিষ্ট এলাকাবাসী

শরণখোলা প্রতিনিধিঃ বাগেরহাটের শরণখোলায় ভাই ভাই বাহিনীর অত্যাচরে অতিষ্ট গ্রামবাসীরা অবশেষে মূখ খুলতে শুরু করেছে। উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের সুন্দরবন সংলগ্ন পশ্চিম রাজাপুর গ্রামে গড়ে ওঠা নতুন বাহিনীটি জমি দখল, নিরিহ মানুষকে মারধর, ছিনতাই, হত্যা ও ধর্ষণের মতো নানা অভিযোগ থাকার পরেও এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচেছন মিলন ও তার ভাইয়েরা।
এমনকি তাদের বিরুদ্ধে থানা ও আদালতে একাধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থরা ওই চক্রের বিরুদ্ধে বাগেহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য  সহ অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মোড়েলগঞ্জ সার্কেল) ও শরনখোলা  থানা পুলিশের নিকট একাধিক অভিযোগ করেও এ পর্যন্ত কোন প্রতিকার পাননি। তবে, পুলিশ বলছে এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং তদন্ত চলছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা মেলে।প্রভাবশালী ওই পরিবারের নির্যাতনের ফলে পাঁচটি পরিবার ইতিমধ্যে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। স্থানীয়রা বলেন, মিলন, নেহারুল, মনির ও ছগির এলাকায় রাম রাজত্ব কায়েম করেছে। কতিপয় রাজনৈতিক নেতার ছত্র ছায়ায় থেকে দীর্ঘদিন ধরে নিরীহ মানুষের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে এলাকা ছাড়া হতে হয়। এদের অত্যাচারে স্থানীয় বাসিন্দা হাফেজ হাওলাদার, ছেতারা বেগম, ইউনুস হাওলাদার সহ পাঁচটি পরিবার ইতোমধ্যে এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তাছাড়া বন সংলগ্ন এই এলাকায় পুলিশের কোন নজর দারী না থাকায় ওরা কয় ভাই মিলে যা খুশি তাই করে যাচ্ছে।
ফাতিমা বেগম (২৮) জানান, স্বামী সাখাওয়াত হাওলাদার কুয়েত প্রবাসী। দুই ছেলে মুছা (৮) ও আব্দুল্লাহ (৩)কে নিয়ে বসবাস করতেন শশুর মৃতঃ আঃ গনি হাওলাদারের বাড়িতে। কিন্তু স্বামী বিদেশ যেতে না যেতেই ফাতিমার উপর কু-নজর দেন একই গ্রামের বাসিন্দা প্রভাবশালী মোঃ সামাদ হাওলাদারের ছোট ছেলে মিলন হাওলাদার। মিলনের কু-প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় রাতের আঁধারে ফাতিমাকে ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করেন মিলন সহ তার সহযোগীরা।
ছেলে মুছাকে স্থানীয় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়ার পথে তাকে ভয়ভীতি দেখাতে আরম্ভ করে মিলন। চলতি বছরের ১২মে আমাকে মারধর করে পরনের কাপড় খুলে রাস্তায় টানা-হেচড়া করেন এবং আমার কাছে থাকা লক্ষাধিক টাকা ও একটি দামী মোবাইল ফোন সহ স্বর্নলংকার ছিনিয়ে নেয়। মিলন সহ তার চার ভাই ওই সময়ে বলেন, তোকে রাস্তায় ফেলে ধর্ষণ করলেও কেউ ঠেকাতে পরবে না। তাই  বাধ্য হয়ে ছেলের স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে সন্তান দুটিকে নিয়ে উপজেলার বাংলা-বাজার এলাকায় আমার বোনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি।
শুধু ফাতিমা বেগম নয়, বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার ধানসাগর ইউনিয়নের ০৬নং ওয়ার্ড়ের পশ্চিম রাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা (সাবেক) গ্রাম পুলিশ মোঃ সামদ হাওলাদারের ছেলে মিলন সহ তার কয়েক ভাইয়ের  বিরুদ্ধে এমন  অত্যাচারের অভিযোগ  স্থানীয় একাধিক নারীর।
স্থানীয় বাসিন্দা কৃষক মোঃ আইয়ুব আলী আকন (৭০) বলেন, কয়েকদিন আগে তার একটি গরু মিলনের বাড়ীতে ঢুকে পড়ার অপরাধে তার গলায় গামছা লাগিয়ে মারধর করেন। পরে টেনে হেঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন। ওই সময় তিনি মিলনের পায়ে ধরে প্রাণে রক্ষা পান।
একই এলাকার বাসিন্দা সেতারা বেগম (৫৮) বলেন, মিলন, নেহরুল, মনির, ছগির ও নজরুল তার বাড়ীতে গিয়ে তাকে মারধর করে ৪টি দাঁত ভেঙ্গে দেয় এবং হাঁস-মুরগী সহ দুটি গরু নিয়া যায়।এখন ভয়ে রাতে বাড়ীতে থাকেন না। তিনি আরও বলেন, তার ১ একর ৬৫শতক জমি চাষাবাদে বাঁধা দেয়ায় গত বছর ওই জমি অনাবাদি থাকে। এছাড়া তার ভাইপো শহিদুলের স্ত্রী সুখীর উপর মিলন কু-নজর ফেলায় ভাই হাফেজ হাওলাদার পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
দিনমজুর ইউনুচের স্ত্রী হাসিনা বেগম (৪৫) জানায়, প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গত ১৬ মে রাত ৩টার দিকে ঘরের বাহিরে গেলে মিলন তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় শরণখোলা থানায় মামলা দিলে তার স্বামী ইউনুচকে মারপিট করে মামলা প্রত্যহারের জন্য আটকে রাখে। পরে  মিলনের ৪/৫ ভাই মিলে তাদের হাঁস-মুরগী, কবুতর, গরুসহ বসত ঘরের মুল্যবান মালামাল লুটে নিয়ে যায়।
উপজেলার কদমতলা এলাকার বাসিন্দা হাফসা বেগম বলেন, এই গ্রামে বাবার বাড়ী কিন্তু ওদের ভয়ে সেখানে যেতে পারিনা। আমি বছরে ২/১ বার আসলেও আমার স্কুল পড়ুয়া কুমারী মেয়েকে  কখনো এখানে নিয়ে আসিনা। এই গ্রামে  মেয়েদের ১০/১২ বছরের মধ্যেই বিয়ে দিতে হয়। বর্তমানে মিলন ও তার ভাইদের ভয়ে কুমারী সহ মধ্য বয়সের মহিলারা অনেকটা রাত জেগে আতংকের মধ্যে থাকেন।
স্থানীয় বাসিন্দা বেল্লাল, জাহিদ, জাহাঙ্গীর সহ কয়েকজন বলেন, সামাদ হাওলাদারের ৮ ছেলের মধ্যে মিলন, নেহরুল, মনির, ছগির ও নজরুল ভিবিন্ন খারাপ কাজের সাথে জড়িত এদের চরিত্রও ভাল না। গ্রামের মেয়ে ও গৃহবধুরা এদের ভয়ে রাতে প্রসাব-পায়খানার জন্য ঘরের বাইরে যেতে পারে না।
মিলনের প্রতিবেশী বৃদ্ধ মালেক হাওলাদার ও তার স্ত্রী আলেয়া বেগম বলেন, ছেলেরা চট্টগ্রামে চাকুরী করেন। মেঝ ছেলে বিয়ে করে পূত্রবধুকে তাদের সেবা যত্নের জন্য বাড়িতে রেখে যায় কিন্তু মিলনের কু-নজরের কারণে বউকে ছেলের কাছে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে ১ লক্ষ ৬হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় মিলন।
সাবেক ইউপি সদস্য ছিদ্দিকুর রহমান (৫৫) জানান, নেহারুল , মনির , মিলন ও ছগির হাওলাদার এলাকায় এক ধরণের রাম রাজত্ব কায়েম করেছে। মাদক ব্যাবসার টাকার গরমে মেম্বার চেয়ারম্যান এমনকি থানায় অভিযোগ দিয়েও মিলনের হাত থেকে বাঁচা যায়না এবং কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে, রাজাপুর বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, কিছুদিন আগে মিলন ও তার ভাইয়েরা বাজারের ৬টি দোকানে চুরি করে। থানায় অভিযোগ ও স্বাক্ষী দেওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। এছাড়া দোকান পাট থেকে মালামাল নিয়ে টাকা দেয় না। টাকা চাইলে উল্টো মারতে আসে।
স্থানীয় ইউপি সদস্য তালুকদার হুমায়ুন করিম সুমন বলেন, নেহারুল, মনির, মিলন ও ছগির হাওলাদারের বিরুদ্ধে মারধর, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জমি দখলের অভিযোগ রয়েছে। মিলন ও তাদের ভাইদের অত্যাচারে এলাকার ৪-৫টি পরিবার এলাকা ছাড়া হয়েছে। এ অবস্থায় এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে মিলন ও তার ভাইদের আইনের আওতায় আনা জরুরী।
ধানসাগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ মইনুল হোসেন টিপু বলেন,  স্থানীয়দের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে মিলন ও তার ভাইদেরকে কয়েকবার পরিষদে ডাকা হয়েছে। কিন্তু তারা পরিষদে আসেনি। ওরা আট ভাইদের মধ্যে নেহারুল, মিলন ও মনির  ডাকাতি থেকে শুরু করে নানা অপরাধের সাথে জড়িত। কোন পরিবারের সাথে ঝগড়া-বিবাদ হলেই মিলন রাতে ওই বাড়িতে গিয়ে নারীদের উপর নির্যাতন চালায়। এসব অভিযোগ পুলিশকে জানানো হয়েছে কিন্তু কিছুই হয়নি।
তবে, এ সকল অভিযোগের বিষয়ে জানতে, মিলনের বাড়ীতে গেলে তিনি সাংবাদিকদের সামনে আসেননি। তার পক্ষে ভাই নেহারুল দাবী করেন, অমাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল অভিযোগ মিথ্যা। জমিজমা সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে বিরোধ থাকায় আমাদের ফাঁসাতে নানামূখী ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন প্রতিপক্ষরা।
শরণখোলা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এসকে আব্দুল্লাহ আল সাইদ বলেন, উভয় গ্রূপের সাথে জমি-জমা নিয়ে বিরোধ আছে। পাল্টাপাল্টি একাধিক মামলাও হয়েছে। অভিযোগের বিষয়গুলো নিয়ে তদন্ত চলছে। এসব ঘটনায় যারাই জড়িত থাকুক না কেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
error: Content is protected !!