হোম » সারাদেশ » বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে  কারুকার্য খচিত হাতপাখা

বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে  কারুকার্য খচিত হাতপাখা

দাগনভূঞা ফেনী প্রতিনিধি: দুঃসহ এই গরমে মানুষ এখন একটু বাতাসের আশায় অস্থির হয়ে থাকবে। তপ্ত রোদে চলা পান্থ বা পথিক খুঁজবে একটু বাতাসের স্পর্শ। কিন্তু গরমের সাথে সাথে বাড়ে লোডশেডিং। নগরজীবনে কিংবা গ্রামে তাই আর দুর্ভোগের শেষ থাকেনা তখন। বিদ্যুৎ-বিভ্রাট কবলিত প্রযুক্তিনির্ভর যুগেও গরমের দুর্ভোগ থেকে স্বস্তির জন্য আদি ও অকৃত্রিম হাতপাখার ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে এখনো। আধুনিক যুগে দিনের পর দিন হারিয়ে যেতে বসেছে নানান প্রাচীন নিদর্শনগুলো।
তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি নিদর্শন হলো হাতপাখা। ফেনী জেলার বিভিন্ন উপজেলায় সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে কারুকার্য খচিত হাতপাখার ব্যাবহার। বৈদ্যুতিক পাখা, এয়ারকন্ডিশন সহ নানান ধরণের আকর্ষনীয় প্লাষ্টিকের হাত পাখার দাপটে বিলুপ্তির পথে প্রাচীন নিদর্শন এবং নিজ হাতে তৈরীকৃত হাতপাখা। যাতে করে হারাচ্ছে কারুশিল্পের একটি অংশ। আবহমানকাল থেকে যখন বিদ্যুতের বালাইও ছিল না,তখন থেকেই মানুষের কাছে প্রাধান্য পেতো হাতপাখা।
প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত নানাভাবে পাখার ব্যবহার চলছে। অতি গরমে বাতাসকে চলমান করে, গরম হাওয়া সরিয়ে অপেক্ষাকৃত শীতল হাওয়া প্রবাহের জন্য হাতপাখার ব্যবহার শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে রুপান্তরের ধারাবাহিকতায় হাতপাখা একটি অলঙ্কারিত শিল্পে সৌন্দর্য লাভ করেছে। প্রায় দশ বছর আগে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে হাতপাখার ব্যবহার লক্ষ করা গেলেও এখন আর লক্ষ করা যায় না। হাতপাখার সাহায্যে যতটা হাওয়া বওয়ানো যায়,তার চেয়ে বড় জায়গা ঠান্ডা রাখতে ভিন্ন প্রযুক্তির প্রয়োজন দেখা দিল। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যগুলোর মধ্যে ঐতিহ্য অন্যতম হাতপাখা গল্প,ছড়া,কবিতা,গান ও উপন্যাসের বহু জায়গা দখল করে আছে।
উপজেলায় পাখা তৈরির ক্ষেত্রে অনেক পরিবার নিয়োজিত রয়েছে। তালপাখা তৈরির ক্ষেত্রে আগে এ অঞ্চলের গ্রামের গরিব মানুষ তালপাতা,বাঁশের কঞ্চি, বাকল বিভিন্ন রকম কাপড় সংগ্রহ করে পাখা বানাত। কিছু কিছু মানুষ তালপাতা,বাঁশের কঞ্চি স্বল্পমূল্যে পাতা কিনেও পাখা বানাত অনেকে। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে দেখা যায় অধিকাংশ কারিগর বিক্রির জন্য পাখা তৈরি বন্ধ করেছেন। তবে অনেক হাতপাখার প্রধান কারিগর বা কারুশিল্পি মহিলারা নিজে ব্যবহারের জন্য কাপড়ের হাতপাখা তৈরি করছেন। তারা সুতা দিয়ে কাপড়ের পাখা তৈরির ক্ষেত্রে, সুতা দিয়ে ফুল তোলার আগে আউট লাইন ড্রইং করে নিয়ে ফর্মা তৈরির জন্য কারুশিল্পির কাজ করেন।এছাড়া এ পাখাগুলোতে রয়েছে নানান ধরনের ডিজাইন,ফুলের নকশা।
পাখার নকশা হাওয়া খাওয়া ছাড়াও লোকে ঘর সাজানো বা বিয়ের গায়ে-হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন সুদৃশ্য পাখা কেনেন। পদ্ম, শতফুল, ঊনিশকাঁটা, সংকলন, বরফি, শিঙারা, শঙ্খ, আয়নাকোটা, শঙ্খপদ্ম, ঝুরিফুল, চালতা ফুল, পানপাতা, তারাফুল, চারমাছ, হাতিবান্ধা, মোরগ, চৌখুপি, চক্র—এসব হলো পাখার নকশার নাম। এমন আরও অনেক নকশা আছে। কোনো কোনো নকশার মধ্যে আয়নার টুকরোও বসানো হয়। পাখা তৈরী চিকন বুননের নকশায় একটি বড় পাখা করতে পুরো এক দিন লেগে যায়।
২৭০ টাকা পাউন্ডের উন্নত চীনা সুতোয় পাখা বোনা হয়। একটি পাখা তিন-চার বছর পর্যন্ত চলে যায়। প্রথমে বাঁশের কাঠি দিয়ে বৃত্ত তৈরি করে নিতে হয়। এর নাম মূলট। এর ওপরেই সুতোর বুনন। সরু চোঙের মধ্য দিয়ে হাতলের সঙ্গে মূলট জুড়ে তার চারপাশে লাল কাপড়ের ঝালর দিয়ে হাতলের ওপরের মাথায় রঙিন সুতোর মোড়ন দিলেই পাখা তৈরি সম্পন্ন হয়। এ তো গেল সুতোর তৈরি বাহারি পাখার কথা। হাত পাখার ক্ষেত্রে তালের পাখার ব্যবহার বরাবরই এগিয়ে। সচরাচর যে তালপাতার পাখা হাতে হাতে ঘুরে বা দুলে দুলে গরম তাড়ায়, তারও বেশ রকমফের আছে। পাটির মতো বুনন বা বাঁশের দুই কাঠির মাঝখানে সুতোয় গাঁথা ভাঁজ করে রাখার পাখা প্রভৃতি।v তালের পাতায় নানা রঙের ডিজাইন করা পাখাও পাওয়া যায়। তাছাড়া গ্রামের অনেক মেয়েরাই পাটি পাখা, কাপড়ের নকশা করা পাখা, সুতায় বোনা পাখাসহ নানা রকম পাখা তৈরি করে। ব্যবসায়িক ভিত্তিতে এসব পাখা তৈরি হয়ে থাকে।
প্রাচীনকালেও এ উপকরণে হাত পাখা তৈরি হতো। তবে আজকাল রকমফেরের আধিক্য দেখা যায়। যে সব এলাকায় পাখা তৈরী হয় পাখা তৈরির জন্য কিশোরগঞ্জ, কৈতরকান্দি, নারায়ণগঞ্জ, সোনারগাঁ, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল করটিয়া, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর বরিশাল প্রসিদ্ধ। তাছাড়া, নওগাঁ, নোয়াখালি ও ঢাকার কিছু কিছু অঞ্চলে পাখা তৈরী হয়। তালপাখা নওগাঁ, ঢাকা, নোয়াখালীর হাতপাখা বিখ্যাত। তাল গাছের বেশ বড় পাতাসহ কেটে বিভিন্নভাবে প্রক্রিয়াকরণ করে তাল পাখা তৈরি করা হয়।
সাদামাটা এই পাখাগুলো সর্বত্রই পাওয়া যায়। ১৫ টাকা থেকে শুরু করে স্থান ভেদে ২৫ টাকা পর্যন্ত তাল পাখার দাম হতে পারে। গরমে বড় তালপাখার সাথে ছোট ছোট তাল পাখার চাহিদা বেশি। স্কুল-কলেজের সামনে অপেক্ষমান অভিভাবকগণ প্রচন্ড গরমে স্বস্তি পেতে হাতে তুলে নেন ছোট পাখা। এগুলোর দামও কম। সাধারণত গাজীপুর অঞ্চল থেকে এই পাখাগুলো আনা হয়। বিভিন্ন রকম পাখা তালপাখার পাশাপাশি কাপড়ের পাখার ঐতিহ্যও প্রাচীন। গ্রাম বাংলার ভিন্ন মেলার গন্ডি পেরিয়ে আজ নগর জীবনের মেলাগুলোতেও বিভিন্ন রকম কাপড়ের পাখা দেখতে পাওয়া যায়।
খুলনা, বাগেরহাট, সিলেট ও বরিশাল অঞ্চলে কাপড়ের নকশি পাখাগুলো পাওয়া যায়। চৈত্র মাসের আগেই এসব এলাকার মেয়েরা পাখা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পুরনো কাপড়ে রঙ দিয়ে তাতে নানা রঙের সুতার কাজ করে পাখা তৈরি হয়। অনেক পাখায় ঝালরও লাগানো হয়। পাখার ডাটিতে আছে বৈচিত্র্য। অনেক পাখায় বাঁশের একটা চোঙ দেয়া থাকে। এতে পাখাটি ঘোরাতে সুবিধা হয়। এ সকল বাহারি পাখা ঘর সাজানো ও উপহার দেবার উপকরণ হিসেবেও ব্যবহার হয়। যশোর ও নারায়ণগঞ্জ-এ সুতোয় বোনা পাখা পাওয়া যায়। নানা রকম ও রঙের সুতা ব্যবহার করে এই পাখাগুলো তৈরি হয়। মেলা পার্বণে এই পাখার কদর বেশি। আড়ং সহ অনেক ফ্যাশন হাউজে এই পাখা পাওয়া যায়। সুতোয় বোনা পাখার দাম একটু বেশি। তবে ৩০০ টাকার ভিতর একটি পাখা পাওয়া যাবে।
error: Content is protected !!