হোম » সারাদেশ » সোনাইমুড়ীতে মানব পাচারের ভয়ংকর ফাঁদ

সোনাইমুড়ীতে মানব পাচারের ভয়ংকর ফাঁদ

মোহাম্মদ হানিফ, নোয়াখালী প্রতিনিধি : স্বল্প খরচে প্রবাসে পৌঁছে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে দরিদ্র অসহায় মানুষের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে তাদের ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। কারো অঙ্গহানি হচ্ছে, কেউ দাসত্বের বেড়াজালে আটকে পড়ছে, কেউ গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই মারা যাচ্ছেন। একসময়ে মানব পাচার করা হতো জোরপূর্বক।দেশে প্রায় প্রতিদিনই মানব পাচার চক্রের সন্ধান মিলছে। এদের খপ্পরে পরে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেকেই। দালালের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার আশায় বিভিন্ন সময় লিবিয়ায় গিয়ে আটক হয়ে জেলখানায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন শত শত  বাংলাদেশি যুবক। ইতালি নেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও দালালরা ভুক্তভোগী যুবকদের লিবিয়ায় পাঠিয়ে তুলে দেয় মাফিয়াদের হাতে। তাদের খপ্পরে পড়ে শুধু অর্থ নয়, প্রাণও দিতে হচ্ছে অনেক যুবককে। 
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, চট্টগ্রামের আমানত শাহ বিমানবন্দর হয়ে দুবাই, মিসর ও লিবিয়া রুট দিয়ে ইতালিতে পাঠানোর নামে মূলত মানব পাচার করছে বেশ কয়েকটি চক্র।
জানা গেছে, চক্রের সদস্যরা প্রথমে ইতালিতে উন্নত জীবনের প্রলোভন দেখায়। নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা নিয়ে তাদের লিবিয়ায় নিয়ে মাফিয়াদের হাতে তুলে দেয়। এরপর তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। সেই নির্যাতনের ভিডিও পরিবারের কাছে পাঠিয়ে আবার লাখ লাখ টাকা আদায় করে। পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হলে কখনো কখনো জীবন দিতে হয় চক্রের হাতে। যারা টাকা দেয়, দালালরা তাদের ছাড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে নৌকা বা ট্রলারে ছেড়ে দেয়। এ সময় নৌকাডুবিতে অনেকের সলিলসমাধি হচ্ছে সাগরেই। ভাগ্যক্রমে কেউ কেউ ইতালিতে পৌঁছলেও বেশির ভাগ যাত্রী লিবিয়ার কোস্টগার্ডের হাতে ধরা পড়ে জেলখানায় বন্দি হচ্ছেন। তারপর জেল থেকে ছাড়ানোর আশ্বাস দিয়ে দালালরা পরিবারের কাছ থেকে আরেক দফায় লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ছনগাঁও গ্রামের জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে তানজিদ হাসান শুভ (১৯) দালালদের খপ্পরে পড়ে গত রমজান মাসে ইতালি যাওয়ার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করে। সেখানে পুলিশের কাছে আটক হয়ে তিন মাস জেল খেটে দেশে ফিরে এসে জানালেন জেলখানার নির্যাতনের ভয়ংকর কাহিনি।
তিনি জানান, কুমিল্লা জেলার হাসান নামে এক দালালের প্রলোভনে পড়ে গত রমজান মাসে সাড়ে চার লাখ টাকায় চুক্তিতে তিনি প্রথমে লিবিয়া যাওয়ার জন্য পাসপোর্ট জমা দেন। কয়েকদিন পর দালাল ফোন করে জানান তার পাসপোর্টে ভিসা লেগেছে। ফ্লাইটের দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেছে জানিয়ে তাকে ঢাকায় যেতে হবে। পরবর্তীতে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দালালরা সাংকেত শব্দ (দোয়েল) শিখিয়ে দেয়। সে মোতাবেক সেই শব্দ বলার পর বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তারা আর কোনো কিছু জিজ্ঞাসাবাদ না করে ইমিগ্রেশন শেষ করেন। সেখান থেকে তাকে টুরিস্ট ভিসায় দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়ায় বেনগাজী বিমানবন্দরে নেয়। সেখানকার বাংলাদেশি দালালরা এসে নাম ধরে ডেকে নিয়ে রুমে আটক করে রাখে। পরে চুক্তি অনুযায়ী তার বাড়ি থেকে টাকা দিলেই তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
পরে ওই দালালের পরিচিত লিবিয়ান দালাল মাগুরা জেলার জাকিরের মাধ্যমে ইতালি যাওয়ার জন্য পুনরায় তিন লাখ টাকা দাবি করে। এবং তিনি বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে দেন। পরে লিবিয়ার জিলিটন শহর থেকে তাকে ও তার চাচাতো ভাই মামুনকে লিবিয়ার খমশ নামক স্থানের একটি পাহাড়ে নিয়ে আটক করে রাখে। মামুনও একইভাবে তিন লাখ টাকা চুক্তিতে সাগর পথে ইতালি যাওয়ার জন্য দালালকে টাকা দেন। সেখান থেকেই নৌকা ছাড়ার কথা ছিল। দীর্ঘ ২৭ দিন দালালরা ঘরে রাখার পর খমশ পুলিশ খবর পেয়ে দরজা ভেঙে বাংলাদেশি ৭ জন ও অন্যান্য দেশের মহিলা-শিশুসহ মোট ২৮ জনকে আটক করে। লিবিয়ার তরিক জিগা নামক জেলখানায় তাদের আটক রাখা হয়। একটি রুমে ৭০০ বাংলাদেশিকে গাদাগাদি করে রেখে প্রতিরাতে লিবিয়ার পুলিশ মারধরসহ অমানবিক নির্যাতন চালায়। প্রতি রাতে একটা রুটি খেতে দিত। খাবার পানি দিত না। বাথরুমের পানি এনে কোনোরকম খেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হতো। তার সঙ্গে ছিল নোয়াখালীর মামুন, সাইফুল, আবুল বাশার, মিরাজ, সাইফুল; শরীয়তপুরের শাহ আলম, বরিশালের মিরাজ ইব্রাহিম।
তানজিদ আহসান শুভ তিন মাস সেখানে জেলে বন্দি থাকার পর গত ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দূতাবাস ও আইওএমের সহযোগিতায় দেশে ফিরে আসেন।
লিবিয়ার বন্দিদশা থেকে দালালের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়ে ছাড়া পাওয়া নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার ছনগাঁও গ্রামের মামুন জানান, লিবিয়ার পুলিশ প্রতিনিয়ত বাংলাদেশিদের মারধর করে। লিবিয়ার পুলিশ ও বাংলাদেশ দূতাবাসের কতিপয় কর্মকর্তার চুক্তির মাধ্যমে তাদের জেল থেকে বের করা হয়। বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্বহীনতায় সেখানে প্রবাসীরা এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
নোয়াখালীর দালাল গিয়াস উদ্দিন জানান, অবৈধ পথে ইতালি যেতে হলে লিবিয়াই নিরাপদ রুট। তাদের সঙ্গে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তাদের চুক্তি রয়েছে। তাই তাদের লোক ধরে না। বাংলাদেশ থেকে দুবাই, মিসর হয়ে লিবিয়া নিরাপদ রুট।
লিবিয়ার ত্রিপলীর বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত একজন কর্মকর্তা জানান, জানুয়ারির ২৪ তারিখে ১৩১ জন ও ২ ফেব্রুয়ারি ১৩৯ জন অবৈধ অভিবাসীকে আইওএমের সহযোগিতায় বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবাইকে পাঠানো হবে।
নোয়াখালী পুলিশ সুপার (এসপি) মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বিপিএম, পিপিএম এ প্রসঙ্গে জানান, অবৈধভাবে প্রবাসে যাওয়া সম্পূর্ণ বেআইনি। দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।
দালালদের এই ভয়ঙ্কর ফাঁদ ইতিমধ্যেই মৃত্যু ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই ফাঁদ থেকে দেশবাসীকে বাঁচাতে প্রশাসনকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।
error: Content is protected !!