হোম » শিক্ষা » মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর

মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর

জাহাঙ্গীর আলম: এক অভূতপুর্ব মোহনীয়তায় আবিষ্ট হই আমি। আমার প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কোন প্রেক্ষাপটে এই সুমধুর গীতটি রচনা করেছিলেন তা আমার জানা নেই । তবে সুরের মুর্ছনায় এই সুমধুর গীতটি আবেশে আমার মন ছুঁয়ে যায়। আর গানটির অনুরণন আমাকে মুহূর্তের মধ্যে নিদ্রার অতলান্তে নিয়ে যায়। সহসাই আমি ঘুমিয়ে পড়ি। অত:পর দিক চক্রবাল। অর্থ্যাৎ আমার ঠিকানা হয় গন্তব্যহীন সুদূর দিগন্ত । এ যেন সমুদ্রের শেষ প্রান্তে যেখানে কিছুই দেখা যায় না। অর্থাৎ দৃষ্টিসীমার অবসান।

আমি এক অতি সাধারণ মানুষ। জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌঁছেও সেই অতি সাধারণ থেকে অসাধারণ কোনো পরিবর্তন হয়নি আমার। তাই কর্মস্থলে যেতে গণ পরিবহণই আমার একমাত্র অবলম্বন। গাড়ি কেনার ক্রয়ক্ষমতা বা ভাড়ার গাড়ি এই যেমন উবার, পাঠাও বা নিদেনপক্ষে সিএনজি অটোরিক্সায় উঠার মতো অর্থেরও সংস্থান থাকে না সব সময়। তাই গণপরিবহণের বাস-ই আমার একমাত্র ভরসা।

বছর পাঁচেক আগে আমার স্ত্রীর কর্মব্যাপদেশে রাজধানী ঢাকার প্রবেশদ্বার সাভারে ছিল আমাদের বাসস্থান । আমার প্রিয় গণপরিবহণ বাসে করেই ঢাকা-সাভার যাতায়াত ছিল আমার রোজকার বিধি বা নিয়ম।

বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি উপমহাদেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ পার্লামেন্টেরিয়ান অধ্যাপক ডা. এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী মহোদয় আমার মনিব বা নিয়োগকর্তা । মান্যবরের বাসভবন বারিধারা কূটনৈতিক এলাকায়। বছরখানেক আগ পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক বাড়িটিই ছিল আমার কর্মস্থল। ঐতিহাসিক বলছি এই কারণে যে বিএনপি তথা চারদলীয জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে এই বাড়িটিতে গান পাউডার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সাবেক এই রাষ্ট্রপতিসহ পরিবারের সদস্যদের বিশেষ করে বর্তমান সংসদ সদস্য জনাব মাহী বি. চৌধুরী এবং তদীয় পত্নী বিশিষ্ট ইনটেরিয়র ডিজাইনার মিসেস আশফাহ্ হক লোপাসহ তাদের দুুই শিশু সন্তানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল চারদলীয় জোট সরকারের আস্থাভাজন একদল দুস্কৃতিকারী। কিন্তু ‘রাখে আল্লাহ মারে কে’, এই আপ্তবাক্যটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়। স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে আঁতাতকারীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

যাইহোক, আক্রমণকারীদের সেই লক্ষবস্তু আগের বাড়িটির স্থানে নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। আগের বাড়িটি ছিল দ্বিতল আর এখন ষষ্টতল। বছর দেড়েক আগেও এই বাড়ির দ্বিতলেই ছিল সাবেক রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের কার্যালয়। আর অনেকের মধ্যে আমিও ছিলাম ওই কার্যালয়ের একজন নগণ্য কর্মী । যদিও আমার পদ-পদবী তেমন কিছু নয়,। আামি সাবেক রাষ্ট্রপতি মহোদয়ের প্রেস সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি দেড় যুগেরও বেশি কাল ধরে।
বছর তিনেক আগে আমার স্ত্রী জনতা ব্যাংকের সাভার কর্পোরেট শাখায় অফিসার ছিলেন। তাঁর কর্মস্থল এবং আমার চিকিৎসক কন্যার কর্মস্থল একই এলাকায় হওয়ায় সাভারেই ছিল আমাদের আবাসস্থল।

আমি ‘ইতিহাস’ নামে একটি বাসে করে নিয়মিত ঢাকায় আসা-যাওয়া করতাম। দেখুন বাস মালিকদের জ্ঞানের বহর কতো টনটনে। না জেনে বা না বুঝেই এই বাসমালিকদের কেউ হয়তো অতি উচ্ছাসবশে ইতিহাস’ শব্দটিকেই একটি বাস কোম্পানির নাম হিসেবে বেছে নেন। হায়রে বিদ্যার বহর! এই মুর্খতার নজির আর কোনো দেশে আছে কি-না তা আমার জানা নেই। বাস মালিকদের কেউ হয়তো তার দেওয়া এই ইতিহাস নামটিকেই শ্রেষ্ঠতার বিচারে শ্রেষ্ঠ মনে করেছেন, তাই হয়তো এই নামকরণ।

ইতিহাস নামে পরিচিত এই বাসে চড়ার বহু অম্লমধূর স্মৃতি আজও আমাকে তাড়া করে ফিরে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর প্রচন্ড দাবদাহের মাঝে বাসে ওঠার ক্লান্তি আজও আমি ভুলতে পারি না। ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পিচঢালা রাজপথ মধ্যদুপুরে যখন গনগনে রোদের আগুনে ঝলসানো থাকতো ঠিক তেমনি এক সময়ে ইতিহাস নামের বাসটির জন্য আমার অপেক্ষা নিউ সিআরপি রোডের মাথায়। বেশিরভাগ চালক বা তার সহকারী আমাকে চিনতেন ঢাকার নিয়মিত যাত্রী হিসেবে। তাই আমার প্রতি তাদের একটা এক্সট্রা ফেবার বা অতিরিক্ত আনুকুল্য ছিল।

রোদে পোড়া আমার তামাটে চেহারা দেখে বোধকরি তাদের মায়া হতো। তাই তারা ইতিহাস নামের এই শকটটিকে আমার সামনে এনে অনুগত গজ’র মতো দাঁড় করিয়ে দিতো। হেলেদুলে চলন্ত হাতীর যেন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে পড়া । আমি বেশ আয়েশ করেই বাসে উঠতাম। তবে ইতিহাসের চালক যখন ময়ূরপংখীর মতো তার শকটের গতি বাড়িয়ে দিতো অমনি আমার চোখের দু’পাতায় ভর করতেন নিদ্রাদেবী। দিবানিদ্রায় নাসিকা গর্জনের তালে তালে ইতিহাস আমার গন্তব্য পেরিয়ে দূরে,বহূ দূরে চলে যেতো মাঝে-মধ্যে। এমনতরো ঘটনা আকছার ঘটতো দিবালোকে। কিন্তু রাতের বেলা এই একই ঘটনার জন্য বেশ কড়া মাশুলও দিতে হয়েছে আমাকে।

ইতিহাসে পরিভ্রমণের সময় ঢাকায় আমার গন্তব্যস্থল ছিল মিরপুর-১০ নম্বর সেকশন। কারণ ওখান থেকেই বাড্ডার বাস ধরতে সুবিধা। আর ফেরার পথে সাভারের সিআরপি বা শিমুলতলা বাসস্ট্যান্ড। রাতের বাসে সাভার আসার পথে বেশিরভাগ সময়ই আমি ঘুমিয়ে পড়তাম । আর এই ঘুমঘোরো কখন যে মনোহার এসে হাজির হতন তার দিশা পেতাম না। ঘুমঘোরে আমার নির্দিষ্ট গন্তব্য পেরিয়ে যেতাম সাভারের শেষ প্রান্তে, মানে নবীনগর। অনেক সময় জঙ্গলাকীর্ণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাসষ্ট্যান্ডের নিশ্চিদ্র অন্ধকারে আমাকে নামিয়ে দিতো বাসের সহকারী । এ রকম ঘটনা তিন বছরে যে কতবার ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই।

এখন আমার আবাসস্থল ঢাকার কল্যাণপুরে। আর কর্মস্থল মধ্য বাড্ডার লিংক রোডে। এখনো আমি গণমানুষের পরিবহণ বাসে চড়েই অফিস করি। মাঝে-মধ্যে রাইড শেয়ারিং কোম্পানির উবার কার বা মোটর বাইকের যাত্রী হয়ে একটু, আধটু রুচি পরিবর্তনের চেষ্টা করি। বছর দেড়েক ধরে আমার বর্তমান কর্মস্থল মধ্যবাড্ডার ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারে। বাসে চড়ি কল্যাণপুর থেকে। আর নেমে পড়ি বাড্ডা লিংক রোডে। এখনও বাসে উঠলেই আমার বড্ড ঘুম পায়। তবে রাতের বেলা ঘুমানো থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু পুরনো অভ্যাস যেন আমায় ছাড়তেই চায় না।
এই করোনাকালেও বাসে উঠতে হয় মধ্যবিত্তের অর্থ সংকটের কারণে।

গতরাতে আবার সেই ইতিহাসের মতো ঘুমিয়ে পড়ার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। আবার ঘুমঘোরো হাজির হলেন মনোহর। তবে রক্ষাকবচও দিয়ে রেখেছিলেন প্রিয় মনোহর। কারণ বৈশাখী পরিবহণের বাসটি মিরপুরের দারুস সালাম থানার সামনে যেতেই নিদ্রাদেবী ছুট দিলেন। পালানোর আগেই জাগিয়ে গেলেন আমায়, বললেন এই আর ঘুমিয়ে না, এখানেই তোমায় নামতে হবে। আমি সুবোধ বালকের মতো প্রিয় নিদ্রাদেবীর কথা মেনে নিলাম।

তারপরও খেশারত যে দিতে হলো না তা কিন্তু নয়। ষাট মুদ্রা দিয়ে উবারের এক বাইকে সওয়ার হলাম। বাইকওয়ালা বয়সে বেশ নবীণ। রাস্তার পাশে আমাকে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাইক থামিয়ে গন্তব্য জানতে চাইলো। বললাম, কল্যাণপুর । ১০০ টাকা লাগবে, ওর কথা শুনে আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কি ছোকরা! আধা কিলোমিটার রাস্তা মাত্র। ছিনতাইকারীর ভয় না থাকলে তো হেঁটেই নিজ আলয়ে পৌঁছে যেতাম। বাইকওয়ালার সঙ্গে ৫০ টাকায় রফা হলো। বাসার সামনে এসে আবদার করলো ১০টা টাকা বেশি দেন স্যার। দাবি খুব একটা বেশি নয়। আমি মেনে নিলাম। ওকে মিটিয়ে বাসার প্রধান ফটকে পা বাড়ালাম। সাঙ্গ হলো মোর ঘুমঘোরের।

error: Content is protected !!