হোম » Uncategorized » আমার দেখা চেন্নাই ও বাঙালির চিতাই পিঠা

আমার দেখা চেন্নাই ও বাঙালির চিতাই পিঠা

মোঃ মনিরুল ইসলাম: ২৪ নভেম্বর, ২০২২ ঢাকা থেকে বিমানযোগে চেন্নাইয়ের উদ্দেশে রওনা দিলাম। জীবনের প্রথম আকাশ ভ্রমণ, সঙ্গী আমার সহধর্মীনি স্ত্রী-উদ্দেশ্য ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট। তার আগের রাতে রাজশাহী থেকে বাসযোগে যাত্রাকরে ঢাকা পৌছালাম ভোরবেলা। কাল বিলম্ব না করে এয়ার পোর্টে ঢুকে গেলাম এবং টাকা এক্সচেঞ্জ করার জন্য ব্যাংকের দুএকটি বুথ ঘুরে সোনালী ব্যাংকের বুথ থেকে টাকার পরিবর্তে রুপি গ্রহণ করলাম। ভদ্র মানুষগুলি সারারাত জেগে কাজ করেছেন চেহারা দেখে বুঝতে পারলাম। তারপর ইউএস বাংলার বোর্ডিং, ইমিগ্রেশন প্রভৃতি শেষ করে বেশ কিছু সময় হাতে পেলাম। ফ্লাইট টাইম ১১.০৫, তখন বাজে ৯ টার মতো। আমার ছিলো মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড-দোতালায় অবস্থিত তাদের বুফেতে গেলাম। সেখানে হরেক রকম খাবার সকালের নাস্তা হিসেবে রাখা আছে, যাদের ক্রেডিট কার্ড আছে তারা এখানে ফ্রিতে বৌ বাচ্চা নিয়ে যার যেটা খুশি সকালের ব্রেকফ্রাস্ট হিসেবে খেতে পারে। যেহেতু জীবনের প্রথম অভীজ্ঞতা তাই কিছুটা জড়তা ছিল বৈকি। অবশ্য আমার স্ত্রীর ডমেস্টিক ফ্লাইটের অভীজ্ঞতা ছিল তাই এসব ক্ষেত্রে খুব বেশী অসুবিধা হয় নাই আর কি।

বিমানে উঠে গেলাম, যথা সময়ে বিমান উড্ডয়ন করলো। বিমানের ছোট্ট জানালা দিয়ে সবকিছু দেখার চেষ্টা করলাম কিন্তু তেমন কিছু দেখতে পারলাম না- শুধু মেঘ আর মেঘ। ক্যাপটেন ঘোষনা করলেন চত্রিশ হাজার ফুট উপর দিয়ে আমাদের বিমান যাচ্ছে, আমরা এখন বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে কলকাতার আকাশে আছি, প্রায় সারে চারশত নটিক্যাল মাইল বেগে আমাদের বিমান যাচ্ছে, আকাশ-অবহাওয়া আমাদের পক্ষে আছে, দুই-আড়াই ঘন্টার মধ্যে আমরা চেন্নাই এয়ার পোর্টে পৌছে যাব প্রভৃতি। বিমানে খাবার, কমলপানীয়, চা ইত্যাদি দেয়া হল তা খেলাম। এতক্ষণে আমরা চেন্নাই এয়ার পোর্টে পৌছে গেলাম। আবার ইমিগ্রেশন, লাগেজ গ্রহণ অন্যান্য ফর্মালিটি শেষ করে ট্যাক্সি যোগে চেন্নাইয়ের আরুম বাকরুম এলাকায় অবস্থিত জীবন মিত্র ফার্টিলিটি সেন্টারে পৌছালাম। ঐদিনই প্রথমবারের মত ডাক্তার দেখালাম, একদিন হোটেলে থেকে পরদিন রংপুরের হাসেম ভাইয়ের সহযোগিতায় বাসা নিলাম। প্রয়োজনীয় কিছু বাসন পাত্র কিনলাম, শুরু হলো আমার চেন্নাই জীবন।

চেন্নাইয়ে অনেকের সঙ্গে পরিচয় শুরু হলো, সবার মোটামুটি একই রকম সমস্যা-বাচ্চা না হওয়া। জীবন মিত্র ফার্টিলিটি সেন্টারের মালিক এবং ডাক্তার হলেন রামাইয়া ও তার বড় বোন ডাক্তার নির্মলা। ডাক্তার রামাইয়া ভারত বর্ষের একজন নামকরা ফার্টিলিটি স্পেশালিস্ট। তারা দুই বোনই কষ্ট হলেও রোগীদের সাথে বাংলায় কথা বলেন। ফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট ধাপে ধাপে সম্পন্ন করতে হয়। আমাদের ট্রিটমেন্টও চলছে মাশাল্লাহ। প্রায় প্রতিদিনই সেন্টারে যেতে হতো। মাঝে মধ্যে ঘুরতে, বাজার করতে যেতাম। যেসকল জায়গায় মার্কেট করতাম বা ঘুরতাম তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য যেমন ভিআর চেন্নাই, ডিমার্ট, এক্সপ্রেস এভিনিউ, টি নগর, প্যারিস কর্নার, পাডি সারাবানা প্রভৃতি। ফল কিনতাম ও কাচা বাজার করতাম এশিয়ার সবচেয়ে বৃহৎ কাচা বাজার মার্কেট কয়েমবেদু থেকে-এটা একটা ছোটখাটো শহরের সমান। গরুর গোস্ত কিনতাম এমএমডিএ কোলনী, আমিন ঝিকারাই ও অত্বেরী থেকে। আর মাছের সবচেয়ে বড় মার্কেট ছিল দি চেন্নাইফিস-এখানে সামুদ্রিক মাছের বিপুল সমাহার রয়েছে। প্রতিদিন ট্রাক ভরে ভরে মাছ আসে এখানে। চেন্নাইয়ের দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে মেরিনা বিচ অন্যতম। বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পর পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত এখানে অবস্থিত। বিস্তির্ন সাগর ঘেসে চেন্নাই শহরের গোড়াপত্তন, সাগর আর শহরের মাঝে কোন দুরত্ব নেই। সাগরের বিশাল জলরাশি এ শহরের পা দুয়ে দিচেছ অনবরত। এছাড়াও চেন্নাইয়ের দর্শনীয় জায়গাগুলোর মধ্যে আরও আছে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ, সরকারী যাদুঘর, এলিয়ট সমুদ্র সৈকত, গুইন্ডি ন্যাশনাল পার্ক, স্বামী বিবেকানন্দ বাসভবন, থাউজ্যান্ড লাইটস মসজিদ, আলান্দুর পাহাড়, মেট্রোরেল প্রভৃতি।


আদিকাল থেকে মাদ্রাজ তথা চেন্নাই অঞ্চল চিকিৎসা প্রদ্ধতিতে উন্নত, আধুনিক কালে যুক্ত হয়েছে তথ্য- প্রযুক্তি ও উন্নত প্রদ্ধতি। পৃথিবীর নামিদামী ব্রান্ডের গাড়ী তৈড়ীর কারখানাগুলো এখানে অবস্থিত, পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক গাড়ী-কার, মোটরসাইকেল এখানে তৈরী হয়। চেন্নাই শহরকে বলা হয় তথ্য প্রযুক্তির শহর। যেকোন নতুন কিছু প্রথমে এ অঞ্চলে তৈরী হয় তারপর সেটি ভারতবর্ষ তথা অন্যান্য অঞ্চলে হস্তান্তর হয়। চিকিৎসা ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির কারনে এ শহরে বহূ বিদেশী ও ভিন্ন ভাষাবাসির লোক বসবাস করে থাকেন। এ শহরে উল্লেখযোগ্য মুসলমানের বসবাস রয়েছে, এছাড়াও অনেক বাংলা ভাষাবাসিকে এখানে খুজে পাওয়া যায় বিশেষকরে নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকগণ, এমনকি বাংলাদেশী শ্রমিকরাও এখানে কাজ করে কলিকাতার পরিচয়ে।

ডিসেম্বর – জানুয়ারী মাস প্রচন্ড শীত চলছে বাংলাদেশে কিন্তু চেন্নাই শহরে এসি ছাড়া বসবাস করা প্রায় অসম্ভব। চারিদিকে শীতের পিঠা, চিতাই পিঠার মহড়া চলছে ফেসবুকে। উদ্যোগ নিলাম চিতাই পিঠা বানাবো-দোকানে গিয়ে চালের গুড়া খুজছি কিন্তু পাচ্ছিনা। এখানে ভাষাগত একটা সমস্যা আছে-এরা তামিল ভাষায় কথা বলে। তামিল ভাষা পৃথিবীর অন্যতম একটা কঠিন ভাষা। অবশ্য মুটামুটি শিক্ষিত লোকেরা প্রায় সবাই ইংরেজীতে কথা বলতে পারে। যাইহোক রাইস ফ্লাওয়ার চাইলাম দোকানদার রাইস পাউডার দিলো, ওকে দাদা বলে নিয়ে নিলাম। বাসায় এসে রীতিমত ঘোষনা দিয়ে পিঠা বানানো শুরু করলাম কিন্তু পিঠা আর হলোনা, চিতাই পিঠা হয়ে গেল দোসা। হতাশ হয়ে ইউটিউব ঘাটাঘাটি করে , লোকের মুখে শুনে শুনে চালের প্যাকেট আটা আনলাম,কিন্তু আজও যতারীতি ফেল মারলাম-হলো না।

আশা ছেড়ে দিলাম, তারপর একদিন আমাদের সিরাজগঞ্জের আশরাফুল ভাইয়ের পরামর্শে তার বাসাতে আতপ চাউল বেøন্ড করে তাদের চুলাতেই পিঠা ট্্রাই করলাম-আংশিক সফল হলাম। এখানে যেটা বুজতে পারলাম তা হল সঠিক চালের গুড়ার পাশাপাশি একটি উপযোগী মাটির পাত্রের প্রয়োজন। এবার খোজাখুজি শুরু হল কোথায় মাটির পাত্র পাওয়া যায়। আধুনিক চেন্নাই শহরে মাটির পাত্র পাওয়া সত্যি কঠিন ছিল, শেষে সেই আশরাফুল ভাইয়ের সহযোগিতায় হাসপাতালের কাছাকাছি একটা দোকানে মাটির পাত্র পাওয়া গেল-দাম দুইশত রুপি কিন্তু সেটাও আসলে অন্য কাজের জন্য বানানো ঠিক পিঠা বানানোর জন্য নয়। পরবর্তীতে অবশ্য এটা দারুণ কাজে দিয়েছে বটে। এবার আতপ চাল কিনে আনলাম, এক ঘন্টা ভিজিয়ে রাখলাম, তারপর ব্লেন্ডার  ধার করে তা ব্লেন্ড করলাম, পরিমিত পানি দিয়ে চালের আটাকে খামি করে নিলাম, মাটির পাত্র চুলায় চড়িয়ে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করলাম। পিঠা তৈরী হতে লাগলো, সামান্য কিছু সমস্যা ফেস করলাম-যেমন পিঠা বাজার সময় সঠিক মাপমত ঢাকনা ব্যবহার করা, পরিমিত পানি ছিটিয়ে দেয়া, ভালভাবে জাল দেয়া, পানি ও আটার মিশ্রনটা সঠিক রাখা প্রভৃতি। এগুলি সঠিক নাহলে পিঠা ভাল হবেনা। অবশ্য এখানে আমার সুপারিন্টেন্ডেন্ট অডিটর স্ত্রী পরামর্শ দিয়ে আংশিক সহযোগিতা করেছেন বটে।

যাই হোক পারফেক্ট চিতাই পিঠা তৈরী হল- আলহামদুলিল্লাহ। প্রতিবেশী রোগীরা অনেকেই খেয়েছেন এবং ভাল বলে মন্তব্য করেছেন। আমার বিশ্ববিদ্যালয় বান্ধবী মাকসুদা মনি আমাদের পাশের হাসপাতালে এই একি ধরনের ট্রিটমেন্টে ছিল, তখন ওকেও ওর বাসাতে গিয়ে নতুন পাত্র কেনাসহ পিঠা তৈরীর এই রেসিপি দেখিয়ে দিতে হয়েছে। প্রতিবেশী রোগী অ্যামেরিকান প্রবাসী ঢাকার বাপ্পি ভাই আমাকে রাজশাহী পিঠাঘর বলে ডাকতেন। পিঠা তৈরীর এই রেসিপি আমার চেন্নাই জীবনে অনেকটা আনন্দ ও বৈচিত্র এনে দিয়েছে বৈকি। তারপর দফায় দফায় এই পিঠার আয়োজন হয়েছে অনেকবার। এদিকে আমাদের চিকিৎসা একেএকে সকল ধাপ সফলতার সাথে সম্পন্ন করে পূর্নতার দিকে ধাপিত হল। আল্লাহর বিশেষ রহমত, সকলের দোয়া ও আশির্বাদে প্রত্যাশিত ফলাফল নিয়ে ৭ মাস পর ২১ জুন, ২০২৩ দেশে ফিরলাম। আমার স্ত্রী বর্তমানে পূর্ন বিশ্রামে আছে। আশাকরি গত চৌদ্দ বছর ধরে তার কাঙ্খিত ও লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন হবে ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সেই দিনটির পথ চেয়ে অনাগত সন্তানের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনছি।

লেখকঃ

মোঃ মনিরুল ইসলাম
সিনিয়র অফিসার
জনতা ব্যাংক পিএলসি
এরিয়া অফিস, রাজশাহী।

Loading

error: Content is protected !!