হোম » মতামত » বাংলাদেশ যেনো একটি অভ্যুত্থানের দেশ: শাহজাহান সিরাজ সবুজ

বাংলাদেশ যেনো একটি অভ্যুত্থানের দেশ: শাহজাহান সিরাজ সবুজ

শাহজাহান সিরাজ সবুজ- কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক

বাংলাদেশ যেনো একটি অভ্যুত্থানের দেশ। কখনো সামরিক অভ্যুত্থান আবার কখনো গণ-অভ্যুত্থান। বাংলাদেশ সৃষ্টি হওয়ার পর হইতে বাংলাদেশে ২৯ টি সামরিক অভ্যুত্থান এবং দু’টি গণ-অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছে। ২৯ টি সামরিক অভ্যুত্থান সরকার পরিবর্তন ও রক্তাক্ত নির্মম হত্যাকাণ্ড ছাড়া রাস্ট্রের তেমন কোনো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারেনি। এদিকে ১৯৯০ সালের এরশাদ বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানে এরশাদের পতন হলেও দেশের রাজনীতির মৌলিক বা গুণগত কোনো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারেনি। ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারে পতন হয়েছে। এবার দেশের মানুষ আশায় বুক বাঁধছে। দেশের মানুষ আশা করছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত অন্তবর্তিকালীন সরকার রাজনীতি, অর্থনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মৌলিক সংস্কার করে জনআকাঙক্ষার বাস্তবায়ন করবে এবং মানুষের আস্থার প্রতিদান দিবে।

ফিরে দেখা:
বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের কয়েকটি বড় অভ্যুত্থানের বিষয়ে এবার আলোকপাত করছি। বাংলাদেশের সামরিক অভ্যুত্থানের সবচেয়ে ভয়াবহ ও নির্মম অভ্যুত্থানটি সংগঠিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। যে অভ্যুত্থানে মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।

৩ নভেম্বর, ১৯৭৫ সামরিক অভ্যুত্থান:
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ বীর উত্তম দ্বারা সংগঠিত একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মোশতাক আহমদকে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করা হয়। খালেদ মোশাররফকে অনেকেই শেখ মুজিব সরকারের সমর্থক হিসেবে দেখতেন

৭ নভেম্বর, ১৯৭৫ সামরিক অভ্যুত্থান:
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানকে কেউ কেউ সিপাহি- জনতার অভ্যুত্থান বলে থাকে। এই অভ্যুত্থানটি সংগঠিত হয়েছিল, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের বামপন্থী রাজনীতিবিদদের সহযোগিতায় বামপন্থী সেনা সদস্যদের দ্বারা শুরু হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে হত্যা করা হয়। যিনি শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের নেতৃত্বে সামরিক জান্তা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।

১৯৮১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান:
১৯৮১ সালের ৩০ মে কতিপয় সেনা কর্মকর্তা তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে। ১৯৮১ সালের ২৯ মে চট্টগ্রাম সফরে যান। জিয়া ও তার সফরসঙ্গীরা বিশ্রামাগার চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে রাত্রিযাপন করেন। ৩০ মে ভোরের দিকে, একদল সেনা কর্মকর্তার দ্বারা তাকে হত্যা করা হয়। ওইসময় তার ছয়জন দেহরক্ষী এবং দুই সহযোগীকেও হত্যা করে।

১৯৮২ সালের সামরিক অভ্যুত্থান:
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ একটি রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে এরশাদ বঙ্গভবনে ঝাপিয়ে পড়েন এবং বন্দুকের জোরে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে পদ থেকে সরিয়ে দেন এবং নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন এবং সংবিধান স্থগিত করেন। ১১ ডিসেম্বর ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি।

৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী গণ-অভ্যুত্থান:
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তারকে তৎকালীন সেনাপ্রধান লেঃ জেঃ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ একটি রক্তপাতহীন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেই সামরিক আইন জারি করেন। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ করে ছাত্ররা। ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে বেশ কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গড়ে উঠা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিলে সেনাবাহিনীর হামলায় জাফর, জয়নাল, কাঞ্চন, দীপালী সাহা সহ অনেক ছাত্র/ছাত্রী নিহত হয়। তখন থেকে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে একটি লাগাতার ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটে ১৯৯০ সালের ৬ই ডিসেম্বর।

১৯৯৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা:
১৯৯৬ সালের ২০ মে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের সাথে বিরোধের পরিপ্রেক্ষিত ঢাকায় সৈন্য এনে ওইসময়কার সেনাবাহিনী প্রধান আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান করার চেষ্টা করেছিলেন। সেদিন দুপুরে জেনারেল নাসিম বগুড়া, যশোর ও ময়মনসিংহ বিভাগের সৈন্যদের ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন।

নবম পদাতিক ডিভিশনের মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান, যিনি ঢাকার সবচেয়ে কাছে অবস্থিত ডিভিশনের কমান্ড করেছিলেন, তিনি রাষ্ট্রপতির অনুগত ছিলেন। বগুড়া ও যশোর বিভাগ যাতে নদী পার হতে না পারে সেজন্য তিনি আরিচা বন্দরের যমুনা নদী থেকে সব নৌযান ও ফেরি সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন । তিনি ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করতে ট্যাংকসহ সৈন্যদের একটি দল পাঠান। এতে ময়মনসিংহ বিভাগীয় সেনাবাহিনী ঢাকায় প্রবেশে বাঁধা দেয়।

এসময় কুমিল্লায় অবস্থিত ৩৩ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনও রাষ্ট্রপতির সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার কমান্ডার অধীনে একটি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ১০১ পদাতিক ব্রিগেডকে সংগঠিত করেছিলেন। শাহ ইকরাম (পরে মেজর জেনারেল) রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ বঙ্গভবনকে সুরক্ষিত করতে ঢাকায় আসেন।

চট্টগ্রামে অবস্থিত ২৪ পদাতিক ডিভিশনের বিরুদ্ধে অবরোধ সৃষ্টির জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ৭ম হর্স আর্মার্ড ব্যাটালিয়নের একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন এবং একটি কোম্পানির ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে ৩৩তম ডিভিশন মোতায়েন করা হয়েছিল।

এইসময় সরকার সমস্ত সৈন্যদের তাদের নিজস্ব সেনানিবাসে থাকতে বলে ঘোষণা প্রচার করে। কয়েক ঘণ্টা পর ময়মনসিংহ বিভাগের সৈন্যরা তাদের ব্যারাকে ফিরে আসে। চট্টগ্রাম বিভাগ কখনই ঢাকার দিকে জড়ো হয়নি। চট্টগ্রাম বিভাগের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং বুঝতে পেরেছিলেন যে সামরিক অভ্যুত্থান সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। পরে সেনাপ্রধান নাসিমকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

২০০৭ সালের সামরিক অভ্যুত্থান:
সেনাপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মঈন ইউ আহমেদ ১২ জানুয়ারী ২০০৭ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। সাংবিধানিক বিধানের বাইরে সামরিক-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল। ফখরুদ্দিন আহমেদকে সরকার প্রধান করা হয়। ওই সেনা শাসনামলে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন আহমদকে অস্ত্রের মুখে রাষ্ট্রপতির পদ চালাতে হয়েছিল। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে সামরিক সরকার একটি সংসদীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পর অভ্যুত্থান শেষ হয়।

২০০৯ বিডিআর বিদ্রোহ:
বিডিআর বিদ্রোহ হলো ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় তৎকালীন বিডিআরদের একটি গ্রুপ দ্বারা সংগঠিত বিদ্রোহ। বিদ্রোহী বিডিআর সৈন্যরা পিলখানায় বিডিআর সদর দফতর দখল করে বিডিআরের মহাপরিচালক শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন অন্যান্য সেনা কর্মকর্তা ও ১৭ জন বেসামরিককে হত্যা করে। বিদ্রোহের দ্বিতীয় দিনের মধ্যে বিডিআর ক্যাম্প আছে এমন অন্য ১২ শহরে অশান্তি ছড়িয়ে পড়েছিল। সরকারের সাথে একাধিকবার আলোচনার পরে বিদ্রোহীরা অস্ত্র সমর্পণ করে। অস্ত্র সমর্পণের মধ্য দিয়ে এ বিদ্রোহের অবসান ঘটে। পরবর্তীতে সংস্থাটির নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ বা সংক্ষেপে বিজিবি করা হয়েছে। বর্তমানে বিজিবি নামে সংস্থাটি পরিচিত।

২০১১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা:
২০১১ সালের বাংলাদেশ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ছিল। এটি ১৯ জানুয়ারী ২০১২ একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টাকারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন যে তাঁরা বাংলাদেশকে ভারতের পুতুলে পরিণত হতে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করছেন মাত্র। এই ঘটনায় অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ বেশ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

এছাড়াও ১৯৭৭-১৯৮০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সামরিক অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়েছিল।

২০২৪ সালের ছাত্র- জনতার গণ-অভ্যুত্থানের একপর্যায়ে এসে অনেকেই মনে করেছিলেন, দেশের এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী রাস্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এই কাজটি না করে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বকদের সহযোগিতায় ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে প্রধান উপদেষ্টা করে একটি অন্তবর্তিকালীন সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই উদ্যোগটি একটি চমৎকার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বাংলাদেশের ইতিহাসে।

দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখছে, বাকস্বাধীনতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ভোটার অধিকার সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাবে। পাশাপাশি সন্ত্রাসমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, চাঁদাবাজ, লুটপাটমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অন্তবর্তিকালীন সরকার প্রয়োজনীয় সবধরনের পদক্ষেপ নিবে। এমনটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা।

লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ,
কবি, কলামিস্ট ও সাংবাদিক।

Loading

error: Content is protected !!