হোম » মতামত » বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা, সবক’টি সরকারই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে

বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে শেখ হাসিনা, সবক’টি সরকারই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে

রাজনীতি নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে বা সুনিশ্চিতভাবে আগাম কিছু বলা অনেকটা দূরহ ব্যাপার। রাজনীতি প্রাকৃতিক বিজ্ঞান নয়, যে নির্দিষ্ট পরিমাণ হাইড্রোজন আর অক্সিজেন মেশালেই পানি হয়ে যাবে। রাজনীতি হচ্ছে সমাজ বিজ্ঞান, তাই সুনিশ্চিতভাবে কিছু বলা অসম্ভব। তবে বিগত সময় এবং বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাবলীকে বিচার-বিশ্লেষণ করলেই মোটামুটি আগাম একটা রাজনৈতিক ধারণা পাওয়া সম্ভব। আমাদের দেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পালাবদলের বেশ কয়েকটি বড় ঘটনা আছে। এ ঘটনাগুলো রাজনীতিতে গুণগত তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন। তবে প্রতিটি ঘটনা সমূহ ক্ষমতার পরিবর্তন এনেছে এবং রাজনীতিতে বিশেষ শিক্ষা দিয়ে গেছে।

বাংলাদেশ সৃষ্টির পর পঁচাত্তরের রক্তাক্ত সামরিক অভ্যুত্থান, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত জরুরি সরকার এবং ২০২৪ সালের আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে দেশের রাজনীতিতে বিশেষ ঘটনা এবং এই ঘটনাগুলো প্রবল ক্ষমতাধর শাসকদের গদিচ্যুত করেছে এবং এইসব গণ-অভ্যুত্থান দেশের আপামর সচেতন নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য নানা শিক্ষার উপকরণ রেখে গেছে।

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে আওয়ামীলীগ নতুন দেশে একটি সরকার গঠন এবং গঠিত সরকার পরিচালনায় সক্ষম ছিল, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে বলে রাখা ভালো, তখন এদেশে তেমন কোনো রাজনৈতিক দল ছিলনা। হাতে গোনা কয়েকটি রাজনৈতিক দল ছিল। কিন্তু সরকার চালানোর মতো যোগ্যতাসম্পন্ন রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতা না থাকায় আওয়ামিলীগের নেতৃত্বে এককভাবে সরকার গঠন হয়েছিল।

স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামিলীগ বা বঙ্গবন্ধুর সরকার যে খুব দ্রুত মানুষের আস্থা হারিয়ে, মানুষের বিরাগভাজন হয়ে পড়েছিল, তার প্রমাণ পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের দুরবস্থা এবং বঙ্গবন্ধুর মতো বিশাল মাপের মানুষকে ওই রকমের নির্মম হত্যার পর কোনো প্রতিবাদ না হওয়া। তখন দলটির জনপ্রিয়তা প্রায় মাটিতে নেমে পড়েছিল এবং দলের নেতারাও অন্যত্র আশ্রয় খুঁজেছে। ২০২৪ সালের আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামিলীগের পরিণতি একই অবস্থা হয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামীলীগ ব্রাকেটবন্দি হয়ে পড়েছিল। এদিকে ২০২৪ সালের আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামিলীগ পুনরায় ব্রাকেটবন্দি হয়ে পড়েছে। পঁচাত্তর-পূর্ব আওয়ামীলীগ শক্তি অর্জন করতে পারেনি, পাশাপাশি জনপ্রিয়তা হারায়। ২০২৪ সালের আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর আওয়ামীলীগ জনপ্রিয়তা হারানোর পাশাপাশি জনরোষানলে পড়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ের মতো বর্তমান সময়েও আওয়ামীলীগ বিরোধী চেতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। যার প্রেক্ষাপট অতীতের মতো বর্তমানেও আওয়ামীলীগই সৃষ্টি করেছে।

পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন বা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে একটি সরকার গঠন এবং তা পরিচালনার মতো দেশে কোনো রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতা ছিলনা। আর এ সুযোগটিই তৎকালীন সেনা কর্মকর্তা জিয়াউর রহমান গ্রহণ করেছেন। তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, প্রথমে জাগদল এবং পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) সৃষ্টি করে যোগ্য রাজনৈতিক দলের ঘাটতি পূরণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭২ থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত আওয়ামিলীগ শাসন আমলের বিভিন্ন ঘটনাবলী মানুষের ক্ষোভ থেকে সৃষ্ট আওয়ামীবিরোধী চেতনাই জিয়ার রাজনৈতিক দল বিএনপির শক্তি জুগিয়েছে। জিয়ার দলের বিভিন্ন গণমুখী কাজের কারণে এবং আওয়ামীলীগ বিরোধী শক্তির সাপোর্টের ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলটির চেয়েও জনপ্রিয়তারও ঊর্ধ্বে পৌঁছে যান জিয়া এবং তার রাজনৈতিক দল। দেশের রাজনৈতিক সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, সামরিক অভ্যুত্থানে জিয়ার মৃত্যু না হলে গণভোটে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা কঠিন হতো।

অপ্রিয় হলেও সত্য, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর আওয়ামীলীগ ধুলোয় মিশে যায়নি। কিন্তু ২১ বছর লেগেছে পুরো শক্তি ফিরে পেতে। ২০২৪ সালের আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পরেও আওয়ামীলীগ ধুলোয় মিশে যায়নি। এবার আওয়ামিলীগকে পুরো শক্তি ফিরে পেতে কত বছর লাগবে, তা ভবিষ্যত্ বলে দিবে। তবে দেশের সচেতন নাগরিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার আওয়ামিলীগকে পুরো শক্তি ফিরে পেতে পূর্বের চেয়েও অনেক বেশি সময় লাগতে পারে। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তন এবং সরকার বদলের পরে আওয়ামীলীগের অবস্থা, ’৮১ সালে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পরে বিএনপির অবস্থা এক রকমের ছিলনা। এরশাদের মন্ত্রিসভায় বিএনপির একাধিক নেতা যোগ দিলেও দলটির শক্তি ও জনপ্রিয়তা পঁচাত্তর পরবর্তী আওয়ামী লীগের পর্যায়ে নেমে যায়নি।

বঙ্গবন্ধুর সরকার থেকে শুরু করে জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া, শেখ হাসিনা সরকার সহ সবক’টি সরকার মানুষের আস্থা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বিএনপি দাবি করতেই পারে, জিয়ার প্রতি মানুষের আস্থা ও ভালোবাসা ছিল। যুক্তি হিসাবে বলা হয়, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার সৃষ্ট দলটি জনরোষানলে পড়েনি। এদিকে এরশাদ সরকারের পতনের পরে জাতীয় পার্টি জনরোষানলে পড়েনি। যেমনটা আওয়ামীলীগ জনরোষানলে পড়েছে।

এদেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর শাসন দেখেছে, জিয়ার শাসন দেখেছে, এরশাদের শাসন দেখেছে, খালেদা জিয়ার শাসন দেখেছে, শেখ হাসিনার শাসন দেখেছে। স্বল্প সময়ের জন্য আরো অনেকের শাসন দেখেছে। দেশের জনসাধারণ প্রতিবারই বিকল্প চেয়েছে, নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছে। ফলাফল কী? সবক’টি সরকারই জনআকাঙ্ক্ষা পূরণের ব্যর্থতায় কোনো মৌলিক পার্থক্য নেই। সরাসরি বললে বলতে হয়, সবক’টি সরকার জনআকাঙক্ষা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সবক’টি সরকারের শাসনে বড় ধরনের কোনো পার্থক্য নেই।

আওয়ামিলীগ একাধারে চারবার এবং এরমধ্যে টানা তিনবার ভোটারবিহীন নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে অবকাঠামোগত ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, এটা সত্য। পাশাপাশি আওয়ামিলীগ দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ব্যাংক হজম, বিরোধী মত দমনের জন্য মামলা ও গ্রেফতার, দলীয় দৌরাত্ম্য, কবরস্থান থেকে শৌচালয় সর্বত্র দলীয়করণ, সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের চরিত্র হনন, প্রশাসন-পুলিশ-শিক্ষকদের অঘোষিতভাবে দলীয়করণ, ব্যবসা- বানিজ্যকে দলীয়করণ, মানুষের বাকস্বাধীনতা হরণ, বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ, ক্ষমতার দম্ভ, দ্রব্য মূল্যবৃদ্ধি ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস, স্বাধীনতার চেতনাকে দলীয়করণ, বঙ্গবন্ধুকে আওয়ামীলীগিকরণ। এইসব কর্মকান্ড কমবেশি বিএনপির আমলেও ছিল। পার্থক্য হলো, এইসব কর্মকান্ডকে বিএনপি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়নি।আওয়ামীলীগ সাংগঠনিক ও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়ে সেটাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কোটার আন্দোলন থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ব্যাপক মৃত্যু এবং একাধারে চতুর্থবারে ক্ষমতায় আসীন হাসিনা সরকার ও আওয়ামীলীগকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

এদিকে কেউ কেউ মনে করছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন হতে পারে। কিন্তু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। ছাত্ররা কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থার সংস্কার চায়। তাদের কোনো দলের ওপরই আস্থা নেই। তাদের দাবির মান্যতা দেওয়ার দরকার আছে বলে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন। আবার এই মুহূর্তে দেশের মানুষের আওয়ামীলীগের প্রতি কোনো আস্থা নেই। বিএনপি, জাতীয় পার্টির প্রতি আস্থা কম। তাহলে এ সময়ের মধ্যে কি নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠিত হবে, নাকি অন্যকোনো রাজনৈতিক দল এসে শূন্য স্থান পূরণ করবে? কারা নতুন দলের নেতৃত্ব দেবে? কোন দল শূন্য স্থান পূরণ করবে? এরকম অনেক প্রশ্নই এখন দেশের জনসাধারণের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। জামায়াতের প্রতিও মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। তাই পরবর্তী সরকার, জামায়াত সরকার হবে কিনা এই নিয়েও দেশে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।

জিয়া- এরশাদ ক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন। দেশের জনসাধারণের একটা অংশ আশংকা করেছিলেন, ড. ইউনুস কি জিয়া- এরশাদের পথেই হাঁটবেন? তিনি যে, জিয়া- এরশাদের পথে হাঁটবেন না, তা পরিস্কার। তাহলে দেশের রাজনীতি আসলে কোন পথে এগুবে? এইসব প্রশ্নের উত্তর সময়ের উপর ছেড়ে দিলাম।

দেশের জনসাধারণ চায়, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের রায় প্রতিষ্ঠা করাই হবে এ সরকারের অন্যতম প্রধান কাজ। তবে তা একমাত্র কাজ নয়। যেসব কারণে অর্থনীতিকে ধ্বংস করা যায়, যেসব কারণে মানুষের বাকশক্তিকে রুদ্ধ করা যায়, যেসব কারণে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ক্ষুণ্ন করা যায়, অন্তবর্তিকালীন সরকারের মাধ্যমে সেসব কারণের একটা বিহিত করতে চায় দেশের জনসাধারণ।

এদেশের মানুষ আওয়ামীলীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি সম্পর্কে ষোলআনাই জানে। এই তিন দলের নেতাদের বৈশিষ্ট্যাদি সম্পর্কে দেশের জনসাধারণ ভালোভাবেই জানেন। তাই এ সরকারের কাছে দেশের জনসাধারণের চাওয়া হলো, এমন একটি গ্রহণযোগ্য সংস্কার চাই, যাতে করে খুব সহজে আর কেউ স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে না পারে। তাই দেশের সচেতন নাগরিক সমাজ, বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করে, তাড়াহুড়ো না করে এ সরকারকে ততটা সময় দেওয়া আবশ্যক, যতটা সময় সংস্কার করতে দরকার।

লেখক: শাহজাহান সিরাজ সবুজ,
কবি ও সাংবাদিক।

Loading

error: Content is protected !!