হোম » মতামত » ফারাক্কা বাধঃ ভারতের আগ্রাসী স্বার্থ ও বাংলাদেশের বিপন্ন মানবতা

ফারাক্কা বাধঃ ভারতের আগ্রাসী স্বার্থ ও বাংলাদেশের বিপন্ন মানবতা

সাম্প্রতিক সময়ে ফেনী, নোয়াখালি, কুমিল্লা, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল এলাকার প্রায় ১০টি জেলায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দিয়েছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল, অতিবৃষ্টি ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ডুম্বুর জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকার কোন আগাম বার্তা ছাড়াই ত্রিপুরার ডুম্বুর বাঁধ খুলে দিলে ফেনীসহ কয়েকটি জেলা হঠাৎ করে বন্যার আগ্রাসী কবলে পড়ে মারাত্মক বিপর্যয়ের সন্মুখিন হয়।

 

এর আগে ৩১ বছর পূর্বে ১৯৯৩ সালে এই বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছিল। বাঁধ খুলে দেওয়ার কারণে বন্যার ভয়াবহতার মাত্রা যেকোন সময়ের তুলনায় বেশী হয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। ৩০ লাখেরও বেশী মানুষ এই বন্যার কবলে পড়েছে। ইতোমধ্যে সন্তান সম্ভবা নারীসহ বেশকিছু মানুষের প্রাণহানী ঘটেছে। বহু ঘরবাড়ী, গবাদিপশু ও মাছের ঘের বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। উক্ত বন্যা কবলিত এলাকা সম্পূর্নরুপে বিদ্যুত বিচ্ছিন্ন রয়েছে ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ আছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ডসহ সরকারি এজেন্সিগুলো দিনরাত কাজ করে চলেছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, সিলেট রুটে ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ রয়েছে।

বন্যা কবলিত এলাকার সবকটি নদ-নদীর পানি বিপদ সীমার উপড় দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। মহুরী নদী দীর্ঘ ৬০ বছরের ও কুমিল্লার দুঃখ খ্যাত গোমতি নদী ১৭ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে আশংকাজনক ভাবে বিপদ সীমার উপড় দিয়ে বয়ে চলেছে। বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশ ভারত কর্তৃক ইচ্ছামাফিক বাঁধ খুলে দেওয়ার মত নিষ্ঠুরতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ হঠাৎ বাস্তুহারা হয়েছে। বাঁধ খুলে দেওয়ার আগে যদি ঘোষণা করা হত তাহলে এমন পরিস্থিতি নাও হতে পারতো, মানুষ অন্তত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার সুযোগ পেত। ভারতের এই আগ্রাসী ও কুটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত আচরণের কারণে উক্ত বন্যা কবলিত এলাকায় মানবিক বিপর্যয় নেমে এসেছে এবং ডুম্বুর বাঁধের পাশাপাশি ফারাক্কা বাঁধও দৃশ্যপটে উঠে এসেছে।

গত বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল, ভারত ফারাক্কা বাঁধ নাকি খুলে দেবে, এবার সত্যি সত্যি ফারাক্কা বাঁধ খুলে দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিহার ও ঝাড়খন্ডে বন্যার জেরে গত ২৬ আগষ্ট থেকে ফারাক্কা বাঁধের ১০৯ টি গেটের সবকটি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে করে এক দিনে বাংলাদেশে ১১ লাখ কিউসেক পানি ডুকবে। সোমবার ফারাক্কা ব্যারেজ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জেনারেল ম্যানেজার আর দেশ পান্ডে বিষয়টি আনুষ্ঠানিক ভাবে জানিয়েছেন। তিনি আরও জানান ফারাক্কা এলাকায় পানি ৭৭.৩৪ মিটার উপড় দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং বিহার ও ঝাড়খন্ডে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়েছে, বাঁধ খুলে দেওয়া ছাড়া অন্য কোন উপায় তাদের হাতে নেই। সেই পুরনো কৌশল, সেই পুরনো কাসুন্দি আবারও বাংলাদেশের কাছে তুলে ধরা হলো। আসলে ফারাক্কা বাঁধকে ভারত শুধুমাত্র তাদের নিজেদের স্বার্থে একতরফাভাবে গত ৪৭টি বছর ধরে ব্যবহার করে আসছে। শুষ্ক মৌসুমে পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশকে মরুভুমিতে পরিণত করা আর ভরা মৌসুমে বাঁধ খুলে দিয়ে বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়াটা ভারতের কাছে নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের সঙ্গে বহুবছর ধরেই ভারত এমন নিষ্ঠুরতম আচরণ করে চলেছে-এটা দেখারও কেউ নেই, বলারও কেউ নেই।

ফারাক্কা বাঁধের ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের জন্য বড়ই নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা ও বঞ্চনার ইতিহাস। ফারাক্কা বাঁধ পদ্মানদীর উজানে গঙ্গানদীর উপড় অবস্থিত একটি বাঁধ যা কিনা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য গলার কাটা সমতুল্য। ভারতের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মানের কাজ শুরু হয়ে ১৯৭৫ সালে এসে শেষ হয় এবং সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধটি চালু হয়। ফারাক্কা বাঁধ ২২৪০ মিটার লম্বা যেটা সেই সময়ে ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে সোভিয়েত রাশিয়ার সহায়তায় বানানো হয়েছিল। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হূগলি নদীতে পলি জমা হওয়ার দরুণ জাহাজ চলাচলে সমস্যা হতো, তাই এই সমস্যার সমাধানে ফারাক্কা বাঁধ নির্মানের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। হিন্দুস্থান কনস্ট্রাকশন কোম্পানী

বাঁধটি তৈরী করে। বাঁধটিতে মোট ১০৯ টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুত কেন্দ্রের জল এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধের উপড় দিয়ে গিয়েছে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ৩৪ নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। যা কেবল উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকেই নয়, ভারতের উত্তরপূর্ব অংশকে বাকী ভারতের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে।

এই বাঁধের মুল উদ্দেশ্য ছিল জলের অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগিরথীকে পুণরায় জলে পুষ্ট করা এবং কলকাতা বন্দরকে নাব্যতার হাত থেকে উদ্ধার করা। বাঁধ থেকে পানি সরিয়ে নেওয়ার জন্য ভাগিরথি-হূগলি নদী পর্যন্ত কৃত্রিমভাবে ফিডার খাল তৈরী করা হয় যার দৈর্ঘ ২৫ মাইল বা ৪০ কিলোমিটার। এই ফিডার খাল ব্যবহার করেই গঙ্গার পানি ভাগিরথি-হুগলি নদীতে সরানো হয়। ভারতের একতরফা জল প্রত্যাহারের কারণে শুধু যে পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়; বরং এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বন ও নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর গঙ্গার পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মজিবুর রহমান ও ইন্দিরা গান্ধী গঙ্গার পানি
বন্টন নিয়ে যৌথ বিবৃতি দেন। এরপর ১৯৭৭ ও ১৯৮২ সালে একটি করে চুক্তি হয়। ১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীদের এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশকে সমপরিমান পানি দেবার ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল কিছু করবে।

১৯৯৬ সালে দিল্লিতে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড়ার মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বন্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি, সবই শুভংকরের ফাঁকি- ভারত তার অবস্থান থেকে একবিন্দুও সরেনি। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানি ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালে ঐতিহাসিক ফারাক্কা লংমার্চ করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্ধিরা গান্ধী বরাবর চিঠি লেখেন। মাওলানা ভাসানীর লং মার্চের মিছিল রাজশাহী থেকে শুরু হয়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পর্যন্ত মোট ৬৪ মাইল পথ অতিক্রম করে। মাওলানা ভাসানি ৯০ বছর বয়সেও সেই লং মার্চের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়ে ছিলেন। ১৯৭৬ সালে জাতি সংঘের সাধারন পরিষদে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারাক্কা বাঁধ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। এত কিছুর পরও ভারত বাংলাদেশকে তার নায্য পানির অধিকার থেকে বঞ্চিতই রেখেছে। ভারত আন্তর্জাতিক কোন আইনের তোয়াক্কা না করে একতরফাভাবে গঙ্গাতে বাঁধ বসিয়ে ফিডার খালের মাধ্যমে পানির প্রবাহকে ঘুরিয়ে ভাগিরথি-হুগলি নদীতে সরিয়ে নিচ্ছে যা কিনা সোমালিয়ার জলদস্যুতা ও মানব খুনের চেয়েও মারাত্বক। পৃথিবীতে প্রায় ২১৪ টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে। এই নদীসমূহ একাধিক স্বাধীন দেশের উপড় দিয়ে প্রবাহিত। এসব নদীর মধ্যে অন্যতম আমাজন, জায়ার, জাম্বেসী, দানিয়ুব, নাইজার, নীল, রাইন, মেকং, লেকচাঁদ প্রভৃতি। যেকোন আন্তর্জাতিক নদীর ওপর তীরবর্তি রাষ্ট্রের অধিকার সমঅংশিদারিত্বের উপড় নির্ভরশীল।

আন্তর্জাতিক নদী সম্পদের ক্ষেত্রে তীরবর্তী রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সুষম বন্টনের নীতি আজও সারাবিশ্বে স্বীকৃত। এই নীতি ভঙ্গ করে কোন দেশে আজ পর্যন্ত ভারতের মতো নজীরবিহীন বাঁধ নির্মানের ঘটনা দ্বিতীয়টি ঘটে নি। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারনের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। এতে করে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস, বনজ, নৌপরিবহন, সেচ প্রকল্প ইত্যাদি ক্ষেত্রে লোকসানের সন্মুখীন হতে হচ্ছে। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয় এবং পরোক্ষভাবে এ ক্ষতির পরিমান হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। পদ্মার পানি প্রবাহ
আশংকাজনক ভাবে কমে যাওয়ায় রাজশাহী, চাপাই নবাবগঞ্জ, পাবনা ও কুষ্টিয়া অঞ্চলে নদ-নদীর পানি শুকিয়ে মরু আবহাওয়া দেখা দিয়েছে। ভুগর্ভস্থ পানির স্তর ৮-১০ ফুট নিচে নেমে গেছে, কোন কোন জায়গায় ১৫ ফিটের মতো পানির স্তর নিচে নামার রেকর্ড রয়েছে। পানির অভাবে রাজশাহী অঞ্চলের বরেন্দ্র সেচ প্রকল্পের কাজ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের কারনে বাংলাদেশের ৪৯ টি নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে এবং আরও ১০০ টি নদ-নদী বিলিন হওয়ার পথে রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ২০০০ কিলোমিটার নৌপথ নৌ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলে মাটির লবনাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং নানাপ্রকার রোগ বালাই দেখা দেয়ার দরুণ চিংড়ি চাষ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময়ী রপ্তানি
কাঁচামাল হোয়াইট গোল্ড হিসেবে পরিচিত চিংড়ি খাত হূমকির মধ্যে রয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহারের ফলে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলোতে পানির আকাল চলছে এবং উপযুক্ত প্রজনন ক্ষেত্রের অভাবে মিঠাপানির মাছ নেই বললেই চলে। তাছাড়া দেশের নদী অববাহিকায় আশংকাজনক ভাবে কমেছে ইলিশ মাছের প্রজনন ও বিচরণ।

ফারাক্কা বাঁধের কারণে শুধু মাত্র যে বাংলাদেশের ক্ষতি হচ্ছে তা কিন্তু নয় বরং এটি ভারতের জন্যও নানামুখি সমস্যার কারণ, পরিবেশ বিপর্যয়, বন্যা, জলাবদ্ধতা ও নদী ভাঙ্গনের উপকরণ হয়ে দাড়িয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের সুদুর প্রসারি ক্ষতির প্রভাবে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত সুন্দরবনের জীববৈচিত্র, পরিবেশের ভারসাম্য ও ইকো সিস্টেম ধ্বংশ হচ্ছে। ভারত- বাংলাদেশের যৌথ সম্পদ সুন্দরবনে লোনা পানির আধিক্যের কারণে টপ ডাইং রোগে আক্রান্ত হয়ে লক্ষ লক্ষ গাছ মরে যাচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে ভারত পানির স্বাভাবিক গতিপথ রোধ করে কৃত্রিমভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে আর নদীর পলি বাংলাদেশের পদ্মায় ঠেলে দিচ্ছে। এতে করে ভারতের যে ক্ষতি হচ্ছে তাহল- পলির অভাবে সমুদ্রের নোনাজল ভুভাগের উপড়াংশ আস্তে আস্তে দখল করে নিচ্ছে ফলে লবনাক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি ভারতের নিম্ন ভুখন্ড ধীরে ধীরে সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে। গঙ্গাসাগর দ্বীপের ৩০ কিলোমিটার এলাকা ইতোমধ্যে সাগরে নিমজ্জিত হয়েছে এবং সেখানকার ১৪ টি গ্রাম সম্পূর্নরুপে বিলিন হয়ে গেছে। যে উদ্দেশ্য নিয়ে ফারাক্কা বাঁধ নির্মান করা হয়েছিল সেটি কিন্তু আজও সফল হয় নাই। গঙ্গার পানি পত্যাহার করে ভাগিরথি-হূগলি নদীতে প্রবাহের মাধ্যমে কলকাতা পোর্টকে সচল রাখা-সেটা কি আদৌ সম্ভব হয়েছে? বাঁধ নির্মানের আগে যে পরিমান ড্রেজিং করতে হতো এখন তার ৪ গুন বেশী ড্রেজিং করতে হচ্ছে। প্রতিবছর ড্রেজিংবাবদ যে ৪০০ কোটি রুপি খরচ করে কলকাতা বন্দরকে সচল রাখতে হচ্ছে সে পরিমান অর্থ কলকাতা বন্দর কিন্তু আয় করতে পারছেনা, ফলে প্রতিবছর বিপুল পরিমান অর্থ কেন্দ্রীয় সরকার ভর্তুকি দিয়ে যাচ্ছে। বহূদিন ধরেই মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলার গঙ্গা তীরবর্তী বন্যা দুর্গত ও বিপর্যস্ত মানুষ ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। জলাবদ্ধতা ও নদী ভাঙ্গন এ অঞ্চলের মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে।

ফারাক্কা চালুর পর থেকে মালদহ ও মুর্শিদাবাদের নদী ভাঙ্গনের মাত্রা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। আশির দশকের ছোটখাটো ভাঙ্গন নব্বইয়ের দশকে এসে মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ১৯৯০-২০০২ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলের বেশকিছু ইউনিয়ন নদীগর্ভে বিলিন হয়ে যায়। ২০০৪-২০০৫ সালেও নতুন করে ভাঙ্গতে থাকে বিভিন্ন গ্রাম ও পঞ্চায়েত। গঙ্গা ভাঙ্গন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির জরিপে বলা হয়ঃ কালিয়াচক ও মানিকচকের ৭৫০ বর্গকিলোমিটার এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তলিয়ে গেছে ৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ১৪টি উচ্চ বিদ্যালয়। রুটিরুজি হারিয়ে বান্তুহারা হয়েছে অন্তত ৪০ হাজার পরিবার। ফারাক্কা বাধের কারনে শুধু পশ্চিবঙ্গ নয়, পাশ্ববর্তী বিহার ও উত্তর প্রদেশও মারাত্বক ক্ষতির মুখে পড়েছে। গঙ্গার উজানে বিহার ও উত্তর প্রদেশ প্রতিবছর ভয়াবহ বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। ২০১৬ সালে বিহারে যে ভয়াবহ বন্যা হয় তার জন্য ফারাক্কা বাধকে দায়ী করা হয়। একইভাবে ২০১৯ সালের বন্যাকেও ফারাক্কার অভিসাপ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঐবছর একই দাবি তুলে বিহারের পানিসম্পদ মন্ত্রী সঞ্জয় কুমার ঝা বলেন-‘ফারাক্কার কারনেই গঙ্গা ভরা মৌসুমে পানির স্বভাবিক প্রবাহ ঠিক রাখতে পারছেনা যার ফলে বিহারে বন্যা হচ্ছে।’ বিহার রাজ্য সরকার বরাবরই দাবী করে আসছে, ফারাক্কা বাধের কারনেই প্রতিবছর তাদের রাজ্য বন্যা ও নদী ভাঙ্গনের শিকার হচ্ছে। বিহারের ৩ বারের মূখ্যমন্ত্রী নিতিশ কুমার ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ফারাক্কা বাধ ভেঙ্গে ফেলার কথা বলেছেন। বিহারের মানুষ অতিষ্ট হয়ে ফারাক্কা বাধের বিরুদ্ধে শাবল নিয়ে মিছিল করেছে। পশ্চিমবঙ্গের চিপ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা পরিকল্পনার শুরুতেই এর বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০ হাজার কিউসেক পানি ফিডার খাল বা ভাগিরথি-হুগলি নদী কেউই বহন করতে পারবেনা। তাছাড়া এর প্রভাবে গঙ্গার উজানে ও ভাটিতে নদী ভাঙ্গন ও জলাবদ্ধতাসহ বিরুপ প্রভাব দেখা দিবে। তখন তার বক্তব্য আমলে না নিয়ে বরং তাকে পাকিস্থানের দালাল বলে আখ্যায়িত করা হয়। পরবর্তিতে কপিল ভট্টাচার্যের কথাই কিন্তু সত্যি হয়েছে। ভারতে নামি সংরক্ষন অ্যাক্টিভিস্ট ও নর্দমা বাচাও আন্দোলনের নেত্রী শ্রী মেধা পাটকর বলেন -কোন সংশয় নেই ভারতের জন্য ফারাক্কা যতটা না উপযোগী তার চেয়ে বেশী ধ্বংশ ডেকে আনছে।

তিনি পরিস্কার ভাবে বলেন- না ভাটিতে না উজানে ফারাক্কার প্রভাব কোথাও সুখকর হয়নি। প্রখ্যাত নদী বিশেষজ্ঞ হিমাংশু ঠোক্কর বলেন- যে কলকাতা বন্দর টিকিয়ে রাখার জন্য ফারাক্কা বাধ নির্মান করা হয় সে উদ্দেশ্য কিন্তু ফারাক্কা পূরন করতে পারেনি। তিনি ফারাক্কার সড়ক ও রেলপথ রেখে দিয়ে ব্যারেজটি ভেঙ্গে ফেলা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নদী বিশেষজ্ঞ সুমনা ব্যানার্জি বলেন- ফারাক্কার কারণে গঙ্গাতে পলি জমছে, নদী ভাঙ্গছে ও জনপদ প্লাবিত হচ্ছে। তিনি আরও বলেন-ফারাক্কা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বড় নদীর উপড় জল নিয়ে খেলতে নেই, তাতে বরং উপকারের চেয়ে ক্ষতির পাল্লাই ভারি। ‘‘ফারাক্কা বাঁধ মরণ ফাদ, ফারাক্কা বাঁধ মানুষের অভিশাপ’’- এই স্লোগান এখন বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ ভেঙ্গে ফেলাটা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।

-মোঃ মনিরুল ইসলাম-

Loading

error: Content is protected !!