হোম » সাহিত্য » “জুড়ান করাতি” (ছোট গল্প)

“জুড়ান করাতি” (ছোট গল্প)

শেখ হান্নানঃ মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কথা। মনের মধ‍্যে নানাকথা আর কী মনে করে জুড়ানের মাথায় চক্কর দিলো। চোখে আন্ধার আন্ধার ঝাপসায় দুনিয়াটি ঘুরতে ছিলো। সাথে সাথে কালিগঞ্জ ঘাটের পারে সবুজ দূর্বাদলের উপর বসে পড়লো। সাথে তার স্ত্রী পিড়পিড়ি জিজ্ঞেস করলো-
-খারাপ ঠেইকতাছে?
-না।
-তাইলে অস্থির হইচেন ক‍্যান!
-এমনি এমনি। তুমি চিন্তা কৈরোনা। নদীর
ঘাটে ঠান্ডা বাতাস গায়ে নাইকতাছে।
পাশে ডাইনে বৈসো।
-বেশি খারাপ নাইগলে কন।
-না এল্ল‍্যা জিরালে ঠিক ওয়া যামু। চল্লিশ
বছর পর আইছি। অনেক স্মৃতির কথা
মনে পড়ে। তাই ওই রহম ঠ‍্যাহে।
পিড়পিড়ি গায়ের জামা খুলে দিলো। ফুল- জোড় নদীর শীতল পানি যতটুকু দুইহাতের তালুতে আনা যায়, এনে স্বামীর মুখে ছিটিয়ে দিলো। আঁচল দিয়ে স্বামীর মুখে ছিটানো পানির ফোঁটাগুলো মুছেদিলে জুড়ানের আরাম বোধ হলো।

দৃষ্টিমেলে ভাবলো, আহা রে! কালিগঞ্জের ফুলজোড় নদী! ষাট সত্তুর দশকের সেই পালতোলা বড় বড় নৌকা এখন নেই, নেই নৌকার গুনটানা মানুষ। আহা এই নদী! আর সেই নদী কী ছিলো?এখন শীর্ণ খালের মতো। অথচ সেই সময়ের বর্ষায় নদীর ভয়ংকর রুপ এখনো জুড়ানের দুচোখে জেগে আছে। কালিগঞ্জের কাছে নদী তর্জনগর্জন বড়ই ভয়ংকর ছিলো। রাক্ষুসে ফুলজোড় মুখের সামনে যা পেতো- বাড়িঘর ফসলি জমি, জানমাল, যা পেতো তাই গোগ্রাসে ঘিলে ফেলতো। স্রোতের তোড়ে কেউ নদীতে গোসল করার সাহস করতো না। এমন ভাবনার মধ‍্যে জুড়ানের চোখের সামনে দিয়ে ভটভট শব্দকরে কয়েকটি ছোট ইঞ্জিন চালিত ডিঙ্গি নৌকা দ্রুত চলে গেলো বন‍্যাকান্দির দিকে, কোনটা আবার রামকান্দিপুরমুখে। দক্ষিণ দিকে তাকাতেই দেখতে পেল সেই ঘাটিনা রেলের ব্রিজ। নদীর কুলকুল ধ্বনি ব্রিজের উপর দিয়ে ট্রেন চলার ঝমাঝম রেলসঙ্গীত কোনো দিন কোনো মানুষের ভুলবার নয়।

রেলব্রিজটিকে দূর থেকে পূর্বের মতোই মনে হলো জুড়ানের। যেমনটি আগে দেখেছে, আজো সেইরুপ আছে। এমন সময় ব্রিজের উপর দিয়ে ঝকঝক ঝকঝকা ঝক আওয়াজ করে দৃষ্টিনন্দন পদ্মা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ঝকঝক ঝকঝক ঝক শব্দে সাঁইসাঁই করে সলপ স্টেশানুভি- মুখে চলে যাওয়া দেখে জুড়ান অতিত ভাবনায় হারিয়ে গেল। এ এক অসাধারণ দারুন অনুভূতি। মনে পড়েগেলো প্রথম যখন গাছ কাটা করাতি হিসেবে এই গ্রামে এসেছিলো সেই দিনের কথা। স্ত্রীকে বললো-
-শরীরের মধ‍্যে খারাপ ঠেইকছে ক‍্যা
জানো?
-আপনে নাকলি আমি তা জানমু কী
কৈরা?
-কৈতাছি সেই কতা। নও নদীর পারের
উপরে বৈসা কই। পিড়পিড়ির হাত ধরে নদীর উচ্চপারের কিনারে লোকজন বসার তক্তাপাতা আছে সেখানে বসলো। বসেই স্ত্রীকে বললো-
-যে জন‍্য তোমাক নিয়া বেড়াইতে আছি
তোমাক আগে গ্রামডা ঘুইরা দেখাই।
-বেড়াইতে নিয়া আইছো তোমার ধর্ম-
বাপের বাড়ি দেখাইবা বৈলা। এহুন
সারা গ্রাম ঘুইরা দেখাইবা। যাগোর
সাথে দেখা কৈরতে আছি আগে সেই
হানে নও।

জুড়ান স্ত্রীর বিরক্তি বোঝা সত্বেও ছোট্ট গ্রামের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত হাঁটলো। এদিক ওদিক মনোযোগ সহকারে দেখছে সে। তার মনে হলো হায়! হায়! সে সময় কত গাছ কেটে নিজ হাতে করাত চালিয়ে মানুষের তক্তা তৈরি করার পরও আরো কত বড়বড় গাছ ছিলো! আজ আর সেরকম একটা গাছও নেই। হালোটের ডানে অনেক বড় তেঁতুল গাছ, গাবগাছ, আমজাম কত গাছ ছিলো, আড়াজঙ্গল গাছ গাছালিতে ভরা ছিলো গ্রাম। কোথায় গেলো সেই সব?

জুড়ান তাত্বিক দার্শনিকের মতো তার এক সময়ের প্রিয় এই গ্রামের পরিবেশ প্রকৃতি গভীর ভাবে লক্ষ‍্য করছে। দেখছে, গ্রামের কোনো বাড়িতে এখন আর লাঙ্গল জোয়াল চগো মই, ইটামুগুর নেই, আছে কলের লাঙ্গল, স‍্যালো মেশিন। গরুমহিষের গাড়ি নেই, আছে ভ‍্যান ভটভটি নছিমন। হালোটগুলো হয়েছে পাকা রাস্তা। প্রত‍্যেক বাড়িতে ফ্রিজ টেলিভিশন ঝলমলে বাতির মেলা। রাস্তার বামে ধান ভাঙ্গানো, তেল আটা ভাঙ্গানো কল। ঢেঁকিতে ধান ভাঙ্গানো ঢেঁকির শব্দ, এ গ্রাম থেকে বিলীন হয়ে গেছে চিরতরে।

জুড়ানের মনে প্রশ্নজাগলো এগুলো হারিয়ে গেলো কেনো? মুদির দোকান পেরিয়ে আরো সামনে এগুতেই চোখে পড়লো অসংখ্য কাঠের গুড়ি। মস্তবড় বড় গাছের গুড়ি সারি সারি পরে রয়েছে। বিরাট “স” মিল। এই স মিলই তার করাতের কাজ কেড়ে নিয়েছে। তার আশা আকাংখার মুখে ছাই ঢেলে দিয়েছে। জুড়ানকে নিঃস্ব করে দিয়েছে এই স মিল। স মিল দেখলে জুড়ানের হিংসার আগুন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে তার অন্তরে। মন পুড়ে কয়লা হয়ে যায় নিমেষে। দুঃখ অভিমানে নিজেকে বড় দূর্ভাগা মনে করে।

স্ত্রীর হাত ধরে ধীয়ান করে দেখছে, স মিলের শ্রমিকগণ বিশাল বিশাল গাছ মুহূর্তের মধ‍্যে মানুষের চাহিদা মাফিক তক্তা তৈরি করে দিচ্ছে। দেখে জুড়ানের চক্ষু বেদনায় অশ্রু ভারাক্রান্ত হয়। কষ্ট বুকের মধ‍্যে মোচড় দিয়ে জুড়ানকে বড়ই অসহায় করে তোলে। এতো পরিবর্তন হয়েছে গ্রামের? এতো উন্নতি হয়েছে দেশের? সে সময় যৌবন ছিলো। গায়ে অসুরের মতো শক্তি ছিলো। লোহার কলাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলতো জুড়ান। কিন্তু গতর খাটিয়ে করাত চালিয়ে গাছচিড়ে তক্তা বানানো কত কষ্টের ছিলো তা ভাষায় ব‍্যক্ত করা যাবেনা।

জুড়ানের গ্রামের বাড়ি খৈলসাকুড়া খোকসা বাড়ি থেকে ভোর বেলা রওনা দিলে কালিগঞ্জ আসতে আছরের ওয়াক্ত হয়ে যেতো। আসতে গোটা তিনেক খেয়া পার হতে অনেক সময় লাগতো। আর আজ! খেয়া নেই। হেঁটে আসতে হয় না। এতো দুরের পথ। গাড়িতে সেই পথ আসতে জুড়ানের সময় লেগেছে দেড়ঘন্টা। ভাবা যায় উন্নতির কথা।
=চলবে=
শেখ হান্নান
নাট‍্যকার লেখক
২৪ নভেম্বর, বুধবার,
২০২১খ্রিঃ
আজিমপুর, লালবাগ,
ঢাকা -১২০৫।

error: Content is protected !!