হোম » সাহিত্য » “ছেতেম বেপারী” (ষষ্ট পর্ব)

“ছেতেম বেপারী” (ষষ্ট পর্ব)

শেখ হান্নান: নৈমুদ্দিন গোলেনুরকে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল স্ত্রী কৈতরী। গ্রামের মেয়ে ভাইয়ের সামনে কীকরে নিজের বিয়ের বর পছন্দ কথা বলবে? আজব্দি অজপাড়া গায়ের কোনো মেয়ে তার বিবাহের কথা, বর পছন্দের কথা মুখফুটে বলতে পারেনি, তাই গোলেনুর বলবে কোন সাহসে? স্বামী সোহাগী গোলেনুর ভাইয়ে আদরের একমাত্র বোন! হোচট খেয়ে দূর্ভাগ‍্যবশত জীবনের শুরুতে বিধবার পোষাক পড়েছে সে। সে স্বামী হারা বৈধব‍্য জীবনের সমাপ্তি না টানলে ভাইয়ের সংসারে কতদিন বোঝা হয়ে থাকবে আদরের গোলেনুর?

ছেতেম বেপারী তাকে পছন্দ করেছে এটা গোলে বুঝতে পেরেছে। যেদিন থেকে ছেতেমের সাথে বিবাহের কথা হচ্ছে সেইদিন থেকে প্রয়াত স্বামীকে বেশি বেশি মনে পড়ছে। আজো বিছানায় শুয়ে তার প্রাণপ্রিয় প্রয়াত স্বামী মোজদারের কত মধুর স্মৃতি হ্নদয়ের গহীনে, চোখের পাতায় ভেসে উঠলো। মনে পড়লো শ্বশুর শ্বাশুড়ীর স্নেহ ভালোবাসা, মায়া মমতার কথা। শ্বশুর শ্বাশুড়ীর অমন হ্নদয়কাড়া ব‍্যবহার জনম জনম মনে গেঁথে থাকবে যে কোনো নারীর। আর দেবর দেলবার!এমন সুন্দর মনের দেবর কয়জন ভাবির কপালে জোটে? শ্বাশুড়ী প্রায়ই বলতো-
-আমার গোলে মা। শোনো স্বামীর দেখা
শোনাই বৌয়ের আসল কাজ। আমরা
তো মইরা যামু। এ সংসার দিয়া সবাইরে
জড়াইয়া ধইরা রাইখতে হইবো। তুমি
আমার কলিজার টুকরা। তোমার
শ্বশুরেরও তুমি আল্লাদি বউ মা।
আমাগারে দেইখতে হইবো না।
আমার সাত রাজার ধন দেলোবাররে
তোমার হাতে তুইলা দিছি।

আমার শ্বাশুড়ীও তোমার শ্বশুররে আমার হাতে
তুইলা দিয়া এই রকম কথা কইছিলো। গোলেনুরের স্মৃতির সাগরে সুখের উর্মমালা একের পর এক আছরে পড়ছিল আর দুচোখ বেয়ে নিরবে অশ্রু নদী বয়ে যাচ্ছিলো বিছানায়। রাত যত গভীর হচ্ছিলো, গোলেনুরের নিদ্রাহারা চোখ, মন, হ্নদয় আরো বেশি বেদনাকাতর হচ্ছিলো। গোলেনুর শুয়ে মনে পড়ে গেলো-একদিন শ্বাশুড়ী ঘরে একা ডেকে নিয়ে গোলের কপালে একটা চুম্বন দিয়ে বলেছিল-
-অনেক শ্বাশুড়ী আছে বৌকে ছেলের
কাছে ঘেঁষতে দেয়না। এইডা ঠিক না।

স্বামীকে যত বেশি ভালোবাসবা তত
বেশি লাভ তোমার। আমার শ্বশুড়ী
আমারে শিখাইছে। সুযোগ পাইলেই
স্বামীর কপালে লুকাইয়া মুম্বন কইরবা।
এতে ভালোবাসা গভীর হয়, মহব্বত
বেশি হইবো। তোমার শ্বশুর আমারে,
আমি ও তোমার শ্বশুরে মহব্বত করি।
অনেকে লজ্জার কথা মনে করে।
অনেকে শরম কৈরা স্বামী স্ত্রী এমন
করেনা। এমনটা যারা করেনা সেই
সংসারে ঝগড়া ফ‍্যাসাদ লাইগাই
থাকে। স্বামী স্ত্রী মহব্বত ভালোবাসাই
সুখ শান্তির আসল কথা। গোলেনুর শ্বাশুড়ীর ওই কথা মনে করে তার পরিশ্রান্ত হ্নদয় বুকচিরে, হুহু করে কেদে উঠলো মন। হায় মায়ের মতো শ্বাশুড়ী! আহা আমার বাপের মতো শ্বশুর! শুধুমাত্র একজন মানুষ, একমাত্র আমার জানের জান, প্রাণপ্রিয় স্বামীর অবর্তমানে সকল সম্পর্ক নিঃশেষ হয়ে গেলো।

গোলেনুরের অন্তর পুড়ে ছাই হলে কার কী? কী কারণে, কোন পাপে, কেনো সুখের ঘর আগুনে পুড়ে স্বামী হারা হলো গোলেনুর ? আবারও বিয়ে! বিধাতা অলক্ষ‍্যে জীবন যন্ত্রণার আবার কোন বিষ ফাঁদ ফেলে রেখেছে কে জানে?গোলেনুর চোখ মুছলেও হ্নদয়ের মধ‍্যে বৈধব‍্যের দগদগে ঘাঁ, তার দহনে পুড়ে যাচ্ছিল অশান্ত দেহমন। নিজের জীবনকে প্রেমহীন, অর্থহীন, বাহল‍্য আবর্জনার মতো মনে হলো তার । হায় স্বামী! স্বামী নামের মহান মানুষ! মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসবার পূর্বেই তুমি হারিয়ে গেলে গোলেনুরের কাছ থেকে! এটা কি গোলের দূর্ভাগ‍্য, অভিসম্পাত? নাকি অজানা পাপের প্রায়শ্চিত্ত? চোখে ঘুমের ভার হলেও মনের মধ‍্যে যে অস্বস্তির দহন, শান্তির বিছানাকে গোলেনুরের অশান্তির স্থান, অস্বস্তির শয়ন মনে হলো।

প্রভাতী গানের পাখি, নীশিকাতর দোয়েল জোড়া কলকাকলিতে পৃথিবী ঘেরা আঁধার ভেদকরে জেগে উঠলো সহসা। জানান দিলো প্রভাত সমাসন্ন, দিবা আগত।

রাতে গোলেনুরের সন্মতি জানার পর নৈমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভোর বেলায় ছেতেমের বাড়ি গিয়ে বিবাহের দিন তারিখ ঠিক করবে। ছেতেমের দ্বিতীয় বিয়ে গোলেরও দ্বিতীয় বিয়ে। তাই ঢাকঢোল না পিটিয়ে চুপচাপ বিয়েটা পড়িয়ে দেবে। ব‍্যাস। ছেতেমের বাড়ি রওনা দিবে এমন সময় উঠানের মধ‍্যে দাঁড়িয়ে ছেতেমকে ডাকলো-
-মিয়া ভাই। ঘরের মধ‍্য থেকে নৈমুদ্দিন উত্তর দিলো-
-ছেতেম! আমি তো রওনা দিছি তোমার
কাছে। যাইক তুমি আইছো ভালোই
হইছে।
-না চলেন। আমি মনে কৈরলাম,
আপনে ম‍্যোলা ঝামেলায় থাকেন।
তাই আমিই চৈলা আছি।
-ঠিক আছে, আইসা ভুল করো নাই।
ভালোই হৈলো। নও ঘরে বৈসা কতা
কই।
ছেতেম এই বাড়িতে ধান কিনতে এসেছে বেশ কয়েকবার। আদর ভক্তি তেমন পায় নাই। কিন্তু আজকে ছেতেমের আগমনকে সন্মান দিয়ে, নৈমুদ্দিন আত্মীয়তার সম্পর্কে বিবেচনা করে কৈতরীকে দ্রুত নাস্তার ফরমায়েশ দিলো। নতুন ভাবি জামাতার কাছে গোলেনুরকে কাছে যেতে নাদিয়ে জামাতার সকালের জামাই ভোজ সম্পন্ন করলো। ছেতেমের গোলেনুরকে এক পলক দেখার ইচ্ছে করলেও আজ কেনো যেন কৈতরী ভাবির নিষ্ঠুর আচরণ সব ইচ্ছে মাটিতে মিশে গেলো তার। বিয়ের সামান্য যোগারযন্ত্রের সুযোগ রেখে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আগামী পরশু শুক্রবার বিয়ের দিনধার্য‍্য করে ছেতেম চলে গেলো। চলে আসার সময় ছেতেম ডানে বামে পেছনে গোলেনুরকে একঝলক দেখবার জন‍্য তাকালো। কিন্তু গোলেনুরের দেখা পেলোনা। এক নজর গোলেকে দেখার আফসোস মনে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো ছেতেম বেপারী ।

শেখ হান্নান
নাট‍্যকার লেখক
আজিমপুর, লালবাগ,
ঢাকা-১২০৫.
রবিবার ১৭ অক্টোবর,
২০২১খ্রিঃ।

error: Content is protected !!