হোম » প্রধান সংবাদ » কারখানা খোলার আগে শ্রমিকদের কথা কেউ কি ভেবেছিল?

কারখানা খোলার আগে শ্রমিকদের কথা কেউ কি ভেবেছিল?

সৈয়দ আশেক মোঃ জেবাল: করোনার ঝুঁকি মাথায় নিয়েই অপ্রত্যাশিতভাবে ১লা আগস্ট ২০২১ হতে শিল্প-কারখানা খোলা হচ্ছে। অথচ দিনদুয়েক আগে পর্যন্ত সরকারের কয়েকজন মন্ত্রীই বলে আসছিলেন যে আগষ্টের ৫ তারিখ পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সরকারের দৃঢ় সংকল্প রয়েছে। এখানে দুটি বিষয় খুবই অবাক লাগার মতো- প্রথমত পুরো বিষয়টাতেই সরকারের একধরনের আত্মসমর্পণ বা অসহায়ত্বের ব্যাপারটি খুব প্রকটভাবে ফুটে উঠেছে এবং দ্বিতীয়ত এই পুরো বিষয়ের ব্যবস্থাপনার (মূলত শ্রমিকদের যাতায়াত-স্বাস্থ্য নিরাপত্তার) অংশটুকু অস্পষ্ট রয়ে গেলো। অথচ সরকার চাইলেই প্রজ্ঞাপনের কিছু উপধারায় কিছু বিষয় যুক্ত করে এই বিষয়গুলোকে আরো পরিষ্কার করতে পারত মালিক ও শ্রমিক উভয়ের কাছে।

ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, নরসিংদীর মত জনবহুল জেলাগুলোতে অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানা অবস্থিত। এসব জনবহুল এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ তথা যারা করোনার অতি ঝুঁকির অন্তর্ভুক্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব মানুষও বাস করেন। বর্তমান করোনা মহামারি সময়ে শুধু শ্রমিক আর মালিকের কথা ভাবলেই হবে না। এসব জনবহুল এলাকাগুলোর শ্রমিকেরা যখন কারখানায় আসা-যাওয়া চলাচল করবেন তখন এমনিতেই করোনার বিধি-নিষেধের উপকারিতা থেকে এই অঞ্চলের মানুষ বঞ্চিত হবেন। আবার, বারবার বিধি-নিষেধ আরোপের কারণে অন্যান্য পেশাজীবী, শ্রমজীবী বা ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন। মনে রাখা দরকার, অপরিকল্পিত ও হুটহাট সিদ্ধান্ত মানুষ সহজভাবে নিতে পারে না, এভাবে সাধারণ মানুষ বিরক্ত হয় এবং এর ফলে সরকারের জনপ্রিয়তাও হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকে।

৪০-৪৫ লক্ষ শ্রমিক অধ্যুষিত (সূত্র: ইত্তেফাক ডিসেম্বর ১৫, ২০২০) গার্মেন্টস শিল্প যা কিনা দেশের প্রধান রপ্তানিমুখী শিল্প তার ব্যবস্থাপনা আরও শ্রমিকবান্ধব ও জনবান্ধব হতে পারত- এটাই প্রত্যাশিত ছিল। শ্রমিকদের ঈদের ছুটি দেওয়ার সময় অর্থাৎ ঈদের আগে তারা জানত যে ৫ তারিখ পর্যন্ত কঠোর বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন হবে এবং এ সময়ে সকল প্রকার শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকবে। অর্থনৈতিক জীর্নতার দরুন যেহেতু এই শহরগুলোতে শ্রমিকেরা শুধু কাজের তাগিদেই আসেন এবং অধিকাংশই তাদের পরিবারে গ্রামে রেখে আসেন সেহেতু এ ধরনের একটা ছুটিতে তারা তাদের প্রিয়জনদের কাছে যাবেন এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু স্বল্প সময়ের নোটিশে যখন কারখানা খোলার ঘোষণা আসে তখন এটা কি কেউ ভেবেছেন যে পরিবহণ বন্ধ থাকায় এইসব খেটে খাওয়া নিম্নে আয়ের শ্রমিকেরা কিভাবে তাদের গ্রাম থেকে এসে কর্মস্থলে যোগ দেবেন? কিভাবে কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করবেন? যদিও বিজিএমইএ ঘোষণা দিয়েছে যে কাজে ৫ আগস্টের মধ্যে ঢাকার বাইরের শ্রমিকদের কাজ যোগদান করা বাধ্যতামূলক নয় কিন্তু খোদ শ্রমিকরাই চাকুরিচ্যুতির ভয়ে কারখানা মালিকদের কথায় ভরসা রাখতে সাহস পায় না। করোনা সংকোটের কারণে গত কয়েকমাস যাবত শ্রম আদালত বন্ধ বা কার্যক্রম সীমিত রয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে কোনো কারখানার ব্যবস্থাপনা বা অতিউৎসাহী কোনো কর্তা ব্যক্তি যদি কোনো শ্রমিককে ছাঁটাই বা চাকুরিচ্যুত করে তাহলে শ্রমিক সংক্ষুব্ধ হলে সেই সমস্যাটি কিভাবে সমাধান করা হবে তার কোনও স্পষ্ট বার্তা কারোর কাছেই নেই। কারখানা খোলার হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত অনেকগুলো প্রশ্নের উদ্রেক করেছে যার জবাব মনে হয় কারো কাছেই নেই।

গার্মেন্টস শিল্প অবশ্যই আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি শিল্প। কিন্তু আমরা কেন যেন এই শিল্পটিকে কেবল রপ্তানির মানদÐ দিয়েই মাপার চেষ্টা করি যে কত বিলিয়ন ডলার আমাদের রপ্তানি হলো, কত লক্ষ কার্যাদেশ আমরা পেলাম। কিন্তু এই বাইরেও বিশাল শ্রমিক সংখ্যা, তাদের পরিবার, তাদের সাংস্কৃতিক আবহকে কেন যেন আমরা বার বার হিসেবের বাইরে রেখেই সকল হিসেব করে ফেলি। এটা অনস্বীকার্য যে, গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশের কারণে সমাজে নারীর অবস্থা যেমন উন্নতি হয়েছি তেমনি সামাজিকভাবে বিকাশ হয়েছে গ্রামীণ অর্থনীতি যা জাতীয় অর্থনীতিতে বিশাল ভ‚মিকা রাখছে। কিন্তু বারে বারে শ্রমিকেরা আমাদের হিসেবের বাইরেই থেকে যান কোন্ কারণে? এই দেশের পোশাকশিল্পের উন্নতির পেছনে যতটা না সবুজ কারখানা/গ্রীন ফ্যাক্টরি বা ভাল ম্যানেজম্যান্ট-এর অবদান রয়েছে তার সমান বা বেশি অবদান রয়েছে অল্প বেতন পাওয়া এই শ্রমিকদের যারা মেশিনের মতো সকাল-সন্ধ্যা নিরলস শ্রম দিয়ে যেতে পারেন।

বন্দরে কন্টেইনার জট বা অর্ডারের ডেডলাইন-এর কথা চিন্তা করে হয়তো আমাদের এই সিদ্ধান্তে আসতেই হতো কিন্তুসংশ্লিষ্ট পক্ষ বা কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা হয়তো আরেকটু ভাল ব্যবস্থাপনা আশা করতেই পারতাম। করোনার মত অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়-ক্ষতি আমরা শূন্য করতে পারব না কিন্তু আমরা চাইলেই এর ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনতে পারতাম বা নিয়ন্ত্রণে আনা যেত যা অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো করেছে এবং করে যাচ্ছে, এমনকি পাশের দেশ ভারতেও করোনা পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে এনেছে, কিন্তু আমরা যেন পণ করেছি শুধু দেখেই যাব কিন্তু কিছুই শিখব না। এক্ষেত্রে বারবার আমাদের কিছু অব্যবস্থাপনা আমাদের সকল অর্জনে পানি ঢেলে দিচ্ছে। যার কারণে গত প্রায় ৩০ দিন ধরে বিধিনিষেধ থাকার পরেও করোনার আক্রান্তের হার এখনো আমরা ৩০% (সূত্র: প্রথম আলো, জুলাই ৩০, ২০২১) এর কমে নিয়ে আসতে সক্ষম হইনি। এক্ষেত্রে সরকার ভিন্নভাবে কারখানা খোলার বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। প্রথমত, সরকার যদি প্রথম থেকেই এই কারখানা খোলার বিষয়ে স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারতো তাহলে হয়তো শ্রমিকরাও আরো একটু হিসেবি হতে পারতেন তাদের গ্রামে বা পরিবারের কাছে যাওয়ার ক্ষেত্রে। দ্বিতীয়ত, কারখানা খোলার ঘোষণা আসার পর যদি বিজিএমইএ এবং সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় যদি শ্রমিকদের পরিবহণের বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখা হত, যেমন- শ্রমিকদের আসা-যাওয়ার জন্য পরিবহণ বিশেষ করে ট্রেন, লঞ্চ এবং বাস সার্ভিসের ব্যবস্থা করা যেখানে শ্রমিকেরা তাদের ফ্যাক্টরি আইডি কার্ড বা অন্য যেকোনো ডকুমেন্ট ব্যবহার করে টিকেট ক্রয় করতে পারতেন। তৃতীয়ত, এত বিপুলসংখ্যক শ্রমিক যখন বিভিন্ন স্থান হতে আসবেন সেক্ষেত্রে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি জাতীয়ভাবে বেড়ে যাবার শঙ্কা কিন্তু থেকেই যায়। সেক্ষেত্রে শহরের ঢোকার মুখে, বাস-লঞ্চ-ট্রেন স্টেশনগুলোতে তাদের স্যানিটাইজ করার ব্যবস্থা রাখা এবং শ্রমিকদের আইসোলেশনে থাকার ব্যবস্থা করা উচিৎ।

এক্ষেত্রে আইসোলেশনের স্থান সংকুলান একটি বড় চ্যালেঞ্জ কিন্তু আমরা শ্রমিকদের বাসস্থানকেই আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে ব্যবহার করতে পারতাম; প্রয়োজনে আমাদের বন্ধ থাকা স্কুল কলেজগুলোতেও আমরা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। চতুর্থত, বিজিএমইএ শ্রমিকদের কাজে যোগদানের বিষয়ে সুস্পষ্ট একটি প্রেস রিলিজ দিতে পারত বা পারে যেখানে শ্রমিকদের কাজে যোগদান এবং কারখানায় আসা-যাওয়ার বিষয়টি সকল পক্ষের নিকটেই সুস্পষ্ট থাকবে। সেই সাথে কারখানাগুলোকে শ্রমিক পরিবহণে নিজস্ব ব্যবস্থা গ্রহণে উদ্যোগী হওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। এর ফলে কারখানার কর্মপরিবেশ যেমন ভাল থাকবে এবং সকল পক্ষই তাদের অবস্থান বা কর্তব্যের বিষয়টি সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল থাকবেন। পঞ্চমত, এই বিধিনিষেধে কাজে যোগদানের বিষয়ের সাথে শ্রমিকের মজুরির বিষয়টিও এখন অস্পষ্ট যা পরবর্তীতে শ্রমিক অসন্তোষের কারণ হতে পারে। ষষ্ঠত, পুরো বিষয়টিতে মালিক, শ্রমিক এবং সরকার পক্ষ বসে একটি দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং পরিকল্পনাটি প্রকাশ করতে হবে যে কিভাবে আমরা এই মহামারি হতে এই সেক্টরকে নিরাপদ রাখতে পারি। সর্বোপরি, দেশের প্রধান এই উৎপাদক শ্রেণী শ্রমিক ভাই-বোনদেরকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।

যত দুর্যোগই আসুক- সমতা, ন্যায়বিচার, অন্যকে যথাযথ সম্মান প্রদর্শণ এসব মূলনীতি ও সংস্কৃতি থেকে আমরা যেন আর দূরে সরে না যাই। একটি দুর্যোগের কারণে এই দেশ, এই জাতি তথা পুরো বিশ্ব এখন ভীষণভাবে দিশেহারা। এই দুর্যোগকালে আমাদের একতা দরকার, আমাদের ঐক্য দরকার যা নিশ্চিত হতে পারে পুরো বিষয়টির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে এবং পরিষ্কারভাবে সকলকিছু তুলে ধরার মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে ৫০ লক্ষ শ্রমিককে যদি আমরা এই দুর্যোগ হতে নিরাপদ না রাখতে পারি তবে আমরা কেউই নিরাপদ নই এবং থাকব না; একতাই শক্তি এবং এই একতার শক্তিতেই আমরা অতীতে বিভিন্ন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি।

সৈয়দ আশেক মোঃ জেবাল:
নৃ-বিজ্ঞানী এবং শ্রমিক অধিকার বিষয়ক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত

error: Content is protected !!