হোম » শিরোনাম » রুচিহীন সিস্টেমের বিরুদ্ধে মশাল হাতে লড়াই করতে হবে

রুচিহীন সিস্টেমের বিরুদ্ধে মশাল হাতে লড়াই করতে হবে

‘আমরা একটা রুচির দুর্ভিক্ষের মধ্যে পড়ে গেছি। সেখান থেকে হিরো আলমের মতো একটা লোকের উত্থান হয়েছে। যে উত্থান কুরুচি, কুশিক্ষা ও অপসংস্কৃতির উত্থান। এই উত্থান কীভাবে রোধ করা যাবে, এটা যেমন রাজনৈতিক সমস্যা, তেমনি আমাদের সাংস্কৃতিক সমস্যাও।’ সম্প্রতি এই কথাগুলো দেশের খ্যাতিমান নাট্যকার ও অভিনেতা মামুনুর রশীদ বলায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা- সমালোচনার ঝড় বইছে।

মামুনুর রশীদ স্বনামধন্য নাট্যব্যক্তিত্ব। তাঁর কথাগুলো নিঃসন্দেহে যৌক্তিক। মামুনুর রশীদের বক্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা- সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। কিন্তু সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে মামুনুর রশীদদের মতো একজন বিজ্ঞ মানুষ এতো দিন কোথায় ছিলেন? প্রায় তিন দশক যাবত্ ধীরে ধীরে অবনতির চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেছে এদেশের সংস্কৃতি। এ-তো একদিনে ঘটেনি। আমি হিরো আলমের পক্ষের বা বিপক্ষের লোক নই। আমি মামুনুর রশীদের একজন ভক্ত। একসময় মামুনুর রশীদের রাজনৈতিক আদর্শ এবং নাটকে, বিপ্লবের সংকল্পে মুগ্ধ ছিলাম। এখন তাঁর পড়ন্ত বয়স। যা দেয়ার দিয়ে ফেলেছেন বলা যায়।

হিরো আলমের কথায় ফিরি। ‘রুচির দুর্ভিক্ষে’ হিরো আলমের উত্থান হয়েছে- নাট্যজন মামুনুর রশীদের এমন বক্তব্যের পাল্টা জবাব দিয়েছেন আলোচিত- সমালোচিত ইউটিউবার হিরো আলম। ফেইসবুক লাইভে এসে তিনি মামুনুর রশীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘যেহেতু আমার কারণে দেশের মানুষের রুচি নষ্ট হচ্ছে, আপনি ইচ্ছা করলে আমাকে তৈরি করতে পারতেন। তাহলে মানুষের রুচি নষ্ট হতো না। বাংলাদেশে ১৮ কোটি মানুষ, শুধু হিরো আলমের কারণে যদি সবার রুচি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে হিরো আলমকে আপনারা মেরে ফেলে দেন।’

সমালোচনাকারীদের নিজেদের রুচি পাল্টানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি সুন্দরবন নাটক দেখার পর থেকে মামুনুর রশীদ স্যারকে শ্রদ্ধা করি। তাঁর মতো এতো বড় একজন অভিনেতা আমাকে নিয়ে কথা বলেছেন এটা আমার জন্য সৌভাগ্য। সে নেগেটিভ বলুক আর পজিটিভ বলুক। আমি তাকে সাধুবাদ জানাই যে আপনার মতো লোক আমাকে চেনে। আমি তো মনে করেছিলাম আপনারা এতো বড় অভিনেতা আমাকে চেনেন না।’

হিরো আলম কথা শিখে গেছেন। আমার কাছে এখন তাকে আমার অপ্রতিরোধ্য মনে হয়। এই মনে হওয়াটাও এখন অপরাধতুল্য। আমি হিরো আলমকে নিয়ে লিখছি, তাই অনেকের গাত্রদাহের কারণ হতে পারি। আমি মনে করি
সামাজিক সমস্যাই তাকে বিখ্যাত করে তুলেছে। চ্যানেলে চ্যানেলে তাকে নিয়ে আলাপ- আলোচনা, অনুষ্ঠান কি রুচির পরিচয় বহন করে?

হিরো আলমের বড় খুঁটি আমজনতা। এককেন্দ্রিক সমাজে যখন আলাপ- আন্দোলন বাদ-প্রতিবাদ সব কিছু একপেশে পানসে, তখন মানুষ এমন কারো পেছনে লাইন লাগাবে এটাই স্বাভাবিক। সে লাইন এখন দীর্ঘ। এমন কি মামুনুর রশীদও দাঁড়িয়ে গেলেন সেই লাইনে। তা নাহলে হিরো আলম কেনো মানদণ্ড বলে বিবেচ্য হবেন? পচন হিরো আলমে নয়, পচন ধরেছে সমাজে। আমরা ফেইসবুক ও সামাজিক মিডিয়ায় যা দেখছি তাতে এটা স্পষ্ট এখন মানুষ হিরো আলমকে যতটা চিনে বা জানে, মামুনুর রশীদকে ততোটা চিনেনা, জানেনা।

সমাজ ও সংস্কৃতির শুদ্ধতা নষ্ট হতে না দিয়ে একটা সুস্থ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া চালু রাখা দরকার। তখন হিরো আলম থাকবেন তাঁর নিজস্ব জায়গায়, আর মূলধারা চলবে আপন গতিতে। মূলধারা আজ পদ-পদক অর্থ-বিত্ত আর প্রতিষ্ঠার কাছে ধরাশায়ী। ক্ষমতার কাছে নতজানু। সে কারণেই মামুনুর রশীদের মতো ব্যক্তি বনাম হিরো আলম বিতর্ক হতে পারে।

আসলে রুচির দুর্ভিক্ষ হঠাৎ করে আসমান থেকে পড়েনি। যখন থেকে মানুষের মূল্যবোধের অবক্ষয় শুরু হয়েছে, তখন থেকেই রুচির পতন শুরু হয়েছে। আর অরুচির উত্থান শুরু হয়েছে। এদেশের নাটক, সিনেমায় প্রায় তিন দশক আগে থেকেই রুচির পতন শুরু হয়েছে। হিরো আলমের জন্মের আগেই রুচির দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। তাই বলে হিরো আলমকে দায়মুক্তি দিচ্ছিনা। রুচিহীনতার কথা যদি আমাদের বলতেই হয়, তাহলে রুচিহীন সবার বিরুদ্ধে বলতে হবে, রুচিহীন সিস্টেমের বিরুদ্ধে বলতে হবে।

একসময় শহর-নগর, বন্দর, আর গ্রাম- গঞ্জে যাত্রা-পালা, কবিগান, বাউলগান, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি হতো, মহল্লায়- মহল্লায় রবীন্দ্র, নজরুল, জসিমউদদীন, সুকান্তের জন্মদিন পালন হতো, নাচ-গান আবৃত্তি আর নাটকের অনুষ্ঠান হতো। মানুষ দলবেঁধে সেসব অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো। আজকাল এসব হারিয়ে যাচ্ছে, এই নিয়ে কোনো কথা নেই। সবকিছুকে বিদায় করে, পাইছে এক হিরো আলমকে। সবার সব রাগ হিরো আলমের উপর ঝাড়ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, অরুচি উৎপাদক হিরো আলম রুচিবানদের চেয়ে অধিক জনপ্রিয়। এর দায়ভার অবশ্যই রুচিবানদের নিতে হবে।

আসলে রুচি আর অরুচি চিরকালই পাশাপাশি সহাবস্থান করে। সভ্য সমাজে অরুচির ভূমিকা নিতান্তই গৌণ বা নগন্য। কোনও একসময় রুচিকে ছাপিয়ে অরুচি যখন সর্বত্র বিরাজ করে তখনই কিছু লোক নড়ে-চড়ে বসে। অরুচি তখনই সর্বত্র বিরাজ করে, যখন তাকে সর্বত্র বিরাজ করতে দেওয়া হয়। রুচির দুর্ভিক্ষ শুধু অন্তরে নয়, বাহিরেও। রুচির পোশাককেও গ্রাস করে নিয়েছে অরুচি। মুখ বুজে থাকা, ভীরুতা, নীরবতা, উদাসিনতাই রুচিকে অরুচির ভাগাড়ে নিক্ষেপ করে। তাই রুচিবানদের বলছি, এক হিরো আলমের পিছনে না পড়ে, রুচিহীন সিস্টেমের বিরুদ্ধে মশাল হাতে লড়াই করতে হবে। তাহলেই রুচিশীল নাটক, সিনেমা তৈরি হবে।

লেখক: সাংবাদিক শাহজাহান সিরাজ সবুজ।

error: Content is protected !!