হোম » শিরোনাম » জুড়ান করাতি (দ্বিতীয় পর্ব ) 

জুড়ান করাতি (দ্বিতীয় পর্ব ) 

শেখ হান্নান: জুড়ান হাঁটতে হাঁটতে লক্ষ‍্য করলো এই কালীগঞ্জ গ্রামে এখন কোনো ছোনর ঘর নেই। প্রতিটি বাড়ি আধাপাকা ঘর, কোনো বাড়ি ইটের দালান আবার কোনো বাড়ি মেঝেপাকা টিনের ঘরদোর। কী পরিবর্তন! স্ত্রী পিড়পিড়িকে একটি স্থান দেখিয়ে বললো-
এইযে এইখানে ওই সময় আমার তক্তা বানানোর চাং বাঁন্দিছিলাম।

হাত ইশারায়, হাত নেড়ে জুড়ান স্ত্রীকে বুঝালো কীভাবে সে করাত ঠেলতো, তার দুই সহকর্মী নিচ থেকে কীভাবে করাত টেনতো। মনে পড়লো পাশের বাড়ির চৈতা খাঁর দুই মেয়ে বুলবুলি আর টুলটুলি কথা। প্রতিদিন করাতের কাঠেরগুড়া নিতে আসতো দুইবোন। জুড়ান কখনো আড়চোখে কখনো সরাসরি বুলবুলি টুলটুলির সাথে ঠাট্টা মশকরা করতো। কখনো রাগত বলতো-
-এই কেউ গাছের গুড়া নিবানা।

 

গুড়া নিলে বাইন্দা রাখুম। চৈতাখাঁ রস্তম গোটকার মাধ‍্যমে বুলবুলির সাথে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো। কিন্তু জুড়ানের পছন্দ হতো ছোটবোন টুলটুলিকে। রস্তম গোটকার প্রস্তাবটা জুড়ান করাতি হ‍্যাঁ না কোনো উত্তর নাদিয়ে নিরব থাকতো।

এই গ্রামের ছাত্রলীগের নেতা গিয়াস উদ্দিন জুড়ানের ভক্তছিলো। কারণ জুড়ান দোতারা বাজিয়ে প্রতিরাতে এই ফুলজোর নদীর পারে বসে, নয়তো কোনো কাচারী ঘরে গানের জলসা করতো। তার দরাজ কন্ঠে গাইতো শরিয়তী মারফতি দেহতত্বের নানা গান। সুললিত কন্ঠ আর দোতারার মধুর ঝঙ্কারে মাতিয়ে রাখতো কালীগঞ্জের মানুষকে। তার এই ভাবনার মধ‍্যে পেছন থেকে কে যেনো জিজ্ঞেস করলো-
-কী খুঁইজতাছেন। কথা শুনে জুড়ান ঘুরেই দেখলো একজন লম্বা মানুষ। মাথায় টুপি। মুখে দাঁড়ি! পরনে লুঙ্গি। খালি গায়ে এগিয়ে এলো।
-আপনেক চেনা চেনা ঠেইকতাছে।
-আমি শেখ মুজিবের ভোটের সময় এই
গ্রামে করাতির কাজ করছি। জুড়ান,
আমি জুড়ান করাতি! কিছুক্ষণ একে অপরে নিরীক্ষণের পর লোকটি জড়িয়ে ধরে বললো-
-চিনছি! আমি চিনছি! তুমি জুড়ান
বয়াতি জুড়ান করাতি। আমি চিনছি
তোমাক! আমি গিয়াস। তোমার সাথে
গান করছি, গান শুনছি। তোমার
কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাইছি।
মনে আছে তোমার? সেই গিয়াস। ক‍েনো মনে থাকবে না! সে সময় সে ছাত্রছিলো। দিনে যেমন তেমন রাতে দোতারার টুংটাং। কে আটকায় তারে। আর গিয়াস হইয়া যাইতো বন্ধু। বন্ধু গিয়াস। দোস্তো গিয়াস।
-হ‍্যাঁ মনে আছে সব মনে আছে। মানুষের দৃষ্টি হারালে সব অদৃশ্য হয়ে যায়। কিন্তু মন এবং মনের দৃষ্টি চিরজাগ্রত থাকে। মধুর স্মৃতি চিরদিন মানুষকে কাঁদায়। দুজনের আলিঙ্গন দেখে পিড়পিড়িও হতচকিত। জুড়ান চোখ মুছে গিয়াসকে বললো-
-আমার ইস্ত্রী। গিয়াস তাকে সালাম দিয়ে বললো-
-হায়রে জূড়ান ভাই। কতকথা মনে
হইতেছে। যেদিন এই কালীগঞ্জ গ্রামে
পাকিস্তানি মিলিটারী আইসলো,
সেইদিন সব কিছু লন্ডভন্ড হইয়া
গেলো। ওর পুরা গ্রামডা শুধু আমার
পরিচয় জাইনা, আগুন দিয়া
পোড়াইয়া দিলো। তোমার মনে পড়ে,
পাখির ল‍্যাহান গুলী কইরা, চোখের
সামনে গ্রামের অর্ধেক মানুষ, মাইরা
ফালাইলো। জানডা হাতে নিয়া বেবাক
মানুষ, বাড়িঘর সয়সম্পত্তি গরুছাগল
থুইয়া পালাইয়া গেলাম। থাইক সেই
দুঃখের কথা। তা তোমার গ‍্যাদাগেদি
কয়জন? সেদিনের কথা টলটলা মনে আছে জুড়ানের। সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করায় সে এবং তার স্ত্রী দুজনে বিব্রত। তারাতো নিঃসন্তান! জুড়ান প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললো-
-ভাইরে বয়স হইছে। কহন মইরা যাই
কওয়াতো যায়না। করাতির জীবনের
এই গ্রামডা একবার দেইখতে মনডা
উতালা হইলো। তাই ছুইটা আইলাম।
তাছাড়া তুমি তো জানো কফিল
আকন্দ আমার ধর্মবাপ। তার কাচারি
ঘরে দুইডা বছর থাকছি। ভাইগ‍্যে আর
দেখা হয় কীনা, তাই চৈলা আইলাম।
কিন্তু কফিল বাবার বাড়ি কোনডা
ঠাওর কৈরবার পাইর তাছিনা। গিয়াস বুঝতে পেরে উত্তর দিলো-
-তাকে তো রাজাকাররা মাইরা
ফালাইছে। তুমি জানোনা?
-জানমু কেমনে?
-ঠিকই কৈছো। তার দুই ছাওয়াল
মহিবুল আর মমিনুল তারা আমেরিকা
থাকে। নদীতে বাড়ি ভাইঙ্গা গেলো
চরপাড়াকালীগঞ্জে গিয়া বাড়ি কৈরছে।
দুই ভাই মাসখানেক হইলো বাড়িত
আইসছে।
-কখন মরি কওয়াতো যায় না তাই
ছুইটা আইলাম। তোমার সাথে দেখা
হওয়ায় মমিনুলগারে খবর পায়া ভালো
হইলো। আচ্ছা এই বাড়িডা কার?
-হায়রে আল্লাহ এইডা তোমার চৈতাখাঁর
বাড়ি! চৈতাখাঁর নাম বলার সাথে সাথে জুড়ান করাতির মনে হলো বুলবুলির সাথে তার বিয়ের কথা। জুড়ানের স্ত্রী সঙ্গে থাকায় অসুবিধা হবে বিবেচনায় কথা থেমে গেলো গিয়াস। চৈতাখাঁ! নাম শুনে জুড়ানে বুকের মধ‍্যে ধক করে উঠলো। কথা না বাড়িয়ে নলখাগড়াচ্ছাদিত বাড়ির দিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো উনিশ কুড়ি বছরের এক যুবক সামনে এগিয়ে আসছে। গিয়াস যুবককে দেখামাত্রই বললো-
-ওইতো চৈতাখাঁর নাতি বুলবুলির
ছাওয়াল। জুড়ানের স্ত্রী তার যৌবন কালে বুলবুলির সাথে বিবাহের কথা জানলে কষ্ট পাবে, ঘটে যাওয়া অনভিপ্রেত ঘটনা না জানুক, মনে প্রাণে তা আড়াল রাখার চেষ্টা করছে সে। গিয়াসও বিষয়টি পরিস্কার বুঝতে পেরেছে। তিনকাল গেছে এককাল আছে। এই বুড়ো বয়সে তার স্ত্রী বিষয়টি জানলে ভীষণভাবে আহত হবে। কিন্তু যুবক সন্নিকটে আসা মাত্রই গিয়াস অবচেতনে বলে ফেললো- –?
।।চলবে।।
শেখ হান্নান
নাট‍্যকার ও লেখক
আজিমপুর, লালবাগ, ঢাকা-১২০৫
১৮ ডিসেম্বর, শনিবার, ২০২১।

error: Content is protected !!