হোম » শিরোনাম » “ছেতেম বেপারী” (চতুর্থ পর্ব)

“ছেতেম বেপারী” (চতুর্থ পর্ব)

শেখ হান্নান: আজ হাটবার। চাতাল মহাজন হায়দার ভূইয়া। এক সপ্তাহের ধান কেনার হিসাব নিকাশ করে বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো ছেতেমের। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো এতিম মেয়েটার কথা। মনে পরে গেলো গোলেনুরের কথা। মানুষে নানা কথা বললেও গোলেনুরকে তার খুব পছন্দ। হাজারো ভাবনা মাথায় নিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই ছেতেমের মা কান্না জড়িত গলায় বললো-
-“বাবারে আমি আর পারিনা! তোমার
মেয়া সব সময় কয় মার কাছে যামু।
আবার কয় বাবার কাছে যামু। আমি
তো কুলাইয়া উঠতে পারিনা। মাইয়াডা
কাইন্দা কাইন্দা না খায়া ঘুমাইয়া
গেছে । আমার জ্বালা। আমার মরণ
হইলে ভালো অইতো”! মায়ের এমন কষ্টের কথায় ছেতেম মনের মধ‍্যে খুব জোরে ধাক্কা খেলো। ঘরে গিয়ে দেখলো বুকে বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মেয়েটা। বড় মায়া হলো মেয়েটার প্রতি। এই ঘরের একচ্ছত্র রানী ছিলো তার প্রথম স্ত্রী, প্রথম স্ত্রীর ভালোবাসা। স্ত্রীর কথা মনে হতেই ছেতেমের দুচোখ জলেভরে গেলো। জলভরা চোখ থেমে গেলো মৃত স্ত্রীর শূণ‍্য বালিশটির উপর। হ্নদয়ে, বুকের মধ‍্যে যেখানে স্ত্রীর জন‍্য নিখাদ ভালোবাসা রয়েছে, তা ঢুকরে কেঁদে উঠলো ছেতেমের বুক জুড়ে, হ্নদয় জুড়ে।
ছেতেম কম শিক্ষিত হলেও সে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে, স্ত্রী বিয়োগের শূণ‍্যতা তার জন‍্য শুধু একজন নারী নয়, সে একজন অসাধারণ সহকর্মী, সহযোদ্ধা, সর্বক্ষণিক একনিষ্ঠ বিশ্বস্থ‍ বন্ধুকে হারিয়েছে। ঘর সংসার, মা মেয়ের কথা বিবেচনায় নিয়ে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, লোকে যে যাই বলুক, সে গোলেনুরকেই বিয়ে করবে। কারণ তার স্বভাব, চাল চলন খুবই ভালো। তাই মনে মনে ভেবে রেখেছে যে, আগামীকাল সকালে কয়েকটি বিষয়ে গোলেনুরকে জিজ্ঞাসা করতে চায় ছেতেম।
বাইরে শরতের মেঘমুক্ত আকাশে খ খ জোসনার মিষ্টি কিরণ মানুষকে আবেগ আপ্লুত করলেও চিন্তাক্লিষ্ট ছেতেম। স্ত্রীর শূণ্যতার হাহাকার নিয়ে কয়েক ফোঁটি অশ্রু মরুসম বালিশটিতে গড়িয়ে পরলো। বাড়ির পাশে জঙ্গলে অনাহারী শৃগালগুলো হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া ডেকে চলেছে। রাতের জোনাকিরা ঝোপঝাড়ে জ্বলছে নিভছে। নিশাচর পাখি ডানা প্রসারিত উড়ে বেড়াচ্ছে রাতের স্নিগ্ধতাকে আস্বাদন করে। রাতের সৌন্দর্য শোভা অস্বস্থিকর দুঃস্বপ্নের মতো ছেতেমের তন্দ্রা ছুটে গেলো। সীমাহীন অসহায়ত্ত্ব নিয়ে বালিশ ছেড়ে বিছানার উপর আদরের ঘুমন্ত মেয়েটির গায়ে হাত রেখে উঠে বসলো। এতো রাতে নমাজ আলির বাড়িতে, তার বৌ ধানসিদ্ধ করছে আর দুজনের ঘর সংসারের কথা শুনে ছেতেম আবার বালিশে মাথাচেপে চুপকরে শুয়ে রইলো।
রাতে যা চিন্তা করেছে, সেই মোতাবেক ছেতেম গোলেনুরদের বাড়িতে সকাল সকাল উপস্থিত হয়ে কৈতরী ভাবির কাছে গোলেনুরের সাথে কথা বলার অনুমোতি নিলো। প্রথমেই জানতে চাইলো-
-“গোলেনুর, তোমারে আমার পছন্দ
হয়েছে। আমি জানতে চাই তুমি
এখনো তোমার আগের স্বামীরে মনে
কর কিনা? কিম্বা ভালোবাস কিনা? ছেতেমের এমন প্রশ্নে গোলেনুর হতভম্ব হতচকিত। তবে হতভম্ব হতচকিত যাই হোক সে ধীরস্থির, শান্তভাবে উত্তর দিলো-
-“আমার কথায় রাগ নিয়েন না।
আমার মৃত স্বামীর সাথে মাত্র দুইমাস
সংসার করছি। এই দুই মাসে তার
কাছ থেইকা যে ভালোবাসা, যে
সন্মান, আদর সোহাগ আমি পাইছি,
পৃথিবীর আর কোনো মানুষ আমারে
দিতে পারবো কিনা জানিনা। তার
উজাড় করা ভালোবাসা, কেমন
কইরা আমি ভুলবো”? গোলেনুরের এমন বুদ্ধিদীপ্ত উত্তরে ছেতেম মনের মধ‍্যে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলো। অস্বস্থি আর বিষাদে গোলেনুরের দিকে তাকাতে পারছিলো না। মৃত স্বামীকে নিয়ে ওই রকম চিন্তা করা পাপ! প্রশ্নের উত্তর এমন হবে জানলে ছেতেম প্রশ্নই করতো না। গোলেনুরও ছেতেমকে পছন্দ করে। সে বুঝেছে ধানের টাকা বেশি দেয়া, আর ধানের ওজনের কেনো গড়মিল হয়েছিলো তার ? কারণ ছেতেমও পছন্দ করে গোলেনুরকে। গোলেনুর মিষ্টি হাসি দিয়ে বিনয় করে, ছেতেমের কাছে জানতে চাইলো-
-“আমি বুঝতে পারছি আপনি আমার
উত্তরে খুশি হইতে পারেন নাই।
আপনার কঠিন প্রশ্নের উত্তর আমার
আমার জানা নাই। আপনি তো
আমার আগের মৃত স্বামী নিয়া প্রশ্ন
কইরছেন। এখন বলেন আপনে কি
আপনার আগের স্ত্রীর অমলিন
ভালোবাসার স্মৃতির কথা ভুলতে
পারবেন? মনে রাখা অথবা ভুলতে
নাপারা আপনার দোষ বা পাপ না”। মনের মধ‍্যে কষ্ট পাচ্ছিলো গোলেনুর। ছলছল চোখে ছেতেমের দিকে তাকাতে পারছিলো না। কিন্তু ছেতেমের প্রশ্নের উত্তর সঠিক ভাবে নাদিলে কষ্ট এবং দুঃখের জ্বালা তাকে বেশি পিড়িত করবে। আঁচল দিয়ে মুখটি মুছে গোলেনুর বলতে লাগলো-
-“আমি জানি তার স্মৃতি ভোলা সম্ভব
না। মানুষ স্মৃতি ভুলতে পারে না।
আপনিও পারবে না, আমিও পারবো
না। মানুষের দেহের চেয়ে মনডা
বেশি অসহায়। তাই মানুষ ওই রকম
চিন্তা করে। আপনি যদি আমাকে
সন্মান করেন, ভালোবাসেন এবং
আমি যদি আপনাকে সন্মান করি,
শ্রদ্ধা করি, হ্নদয় মন অন্তর দিয়ে
ভালোবাসি, তাইলে সম্ভব পূর্বের
স্মৃতি ভুলে শুধু ভালোবাসা
ভালোবাসায় জীবন কাটাতে”। ছেতেম মেয়ে মানুষকে দুর্বল আর বোকা ভাবতো। কিন্তু গোলেনুরকে প্রশ্ন করায় যে উত্তর আর ধারণা পেলো তা শিক্ষণীয়। আজীবন মনে থাকবে নারীর কাছ থেকে দাঁত ভাঙ্গা উত্তর পাবার কথা। এদিকে কৈতরী দুজনের মিষ্টি কথার কিছু শুনলো, কিছু কথা শুনলো না। ভাবিজামাতার কথা মনে করে, তার প্রতি সন্মান স্বরুপ একটি পিরিচে দুটো রসগোল্লা আর গুটি খোরমা খেজুর দিয়ে আপ‍্যায়ন করলো। আপ‍্যায়ন শেষে কৈতরী ভাবিকে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘরের বাইরে চলে এলো । বললো-
-“কৈতরী ভাবি মিষ্টিতো মিষ্টই। আর
খোরমা খেজুর বেশি কইরা কিনা
আইনেন। মজাইতো লাইগলো”।
ছেতেম চলে আসার সময় পেছনে তাকিয়ে দেখলো গোলেনুর বারেন্দার খুটিধরে দাঁড়িয়ে মিটি মিটি হাসছে। তার পটলচেরা চোখদুটো প্রিয় মানুষটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। ছেতেমের প্রস্থান করার শারীরিক ভঙ্গিতে তাকে পুলকিত, হাস‍্যোজ্জ্বল, উৎফুল্ল মনে হলো।
—শেখ হান্নান
নাট‍্যকার লেখক
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১খ্রিঃ
আজিমপুর, ঢাকা-১২০৫।

error: Content is protected !!