হোম » শিরোনাম » “ছেতেম বেপারী” (তৃতীয় পর্ব)

“ছেতেম বেপারী” (তৃতীয় পর্ব)

শেখ হান্নান: গোলেনুরের বয়স, বুদ্ধিজ্ঞান, তার বাহ‍্যিক সৌন্দর্য আপাতত পছন্দ হয়েছে ছেতেমের। ছেতেম মুগ্ধ হয়ছে তার রুপেও। তাই সিদ্ধান্তে মনোস্থির যে, নৈমুদ্দিন সত‍্যই যদি তার বোনকে বিবাহ দেয়, তবে অমত নেই ছেতেমের। গ্রামের এপাড়ায় ওপাড়ায় ছেতেম বেপারীর সাথে গোলেনুরের বিবাহ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। ইতোমধ‍্যে গোলেনুর অপয়া, অলক্ষণে, পাপীনারী এমন সত‍্যমিথ‍্যার রটনা গ্রামের বাতাসকে শুধু ভারী নয় বিষাক্ত করে তুলেছে।

গোলেনুরের সাথে ছেতেমের সম্পর্কের কথায় অনেকে আনন্দিত হলেও ফটিক বেপারী গোলেনুর সম্পর্কে যে কথা শুনিয়েছে তাতে অনেকটা বিমূর্ষ, চিন্তিত ছেতেম। অবিরাম বর্ষণে দুতিন দিনেই বন‍্যার পানিতে কৃষকের কচি রোপাধান খেত ডুবতে বসেছে। তিনদিন হলো ধান কেনাবিক্রি বন্ধ। খালের পাড়ে বড় আমগাছটির নিচে বসে নিজের সংসার, নৈমুদ্দিন গোলেনুরের কাছ থেকে ধান কেনা ভুলের চার হাজার টাকা ফেরত পাওয়া এবং গোলেনুরের সাথে বিবাহের কথা একান্ত নিরালায় বসে ভাবছে।

ভাবছে ব‍্যক্তিগত জীবনের পাওয়া নাপাওয়া, স্ত্রীকে হারিয়ে কষ্ট, মেয়েটিকে কীভাবে মানুষ করবে এবং চিন্তাভাবনার সিংহ ভাগই ছিল গোলেনুর সম্পর্কে ফটিক বেপারীর কলিজা ফুটোকরা হিংসাত্মক অতিকথন। বিষাত্বক মন্তব্য। বিমূর্ষ ভাবনার মধ‍্যে আমগাছটার নিচে, ঘাটে নৌকা ভিড়ালো ফটিক বেপারী। নৌকায় এক পা আরেক পা মাটিতে রাখতেই ছেতেমকে বললো-
-তোমারে যেকথা কইছি ওই কথার বাইরে
যাইওনা। বিয়া কইরতে চাও একখান
না, প্রয়োজনে দশখান করামু। পুরুষ
মানূষের বিয়ার বিষয়ে কোনো চিন্তা
নাই।
-না তুমি যে কথা কইছো তোমার কথার
সাথে আমি একমত না।
-একমত হইবা কেমনে? যার স্বামী বাজ
পইরা মরে সেই নারীতো পাপী,
কুলক্ষণা অলক্ষী অপয়া। তা না হইলে
বাজ পইড়া স্বামী মরে? একজনেরে
খায়া আইছে তোমারেও খাইবো। আগে
বাজ পইড়া স্বামী মইরচে চড়ে, বিয়া
করো এবার তোমার মাথায় ঠাটা
পইড়বো ঘরে! ছেতেম ফটিক বেপারীর এমন অনধিকার চর্চায় ক্ষুব্ধ। অত‍্যন্ত কড়াভাবে উত্তরে বললো-
-তুমি বেপারী আমিও বেপারী। আমার
ব‍্যক্তিগত পারিবারিক বিষয়ে নাক
গলাইতে আইসোনা। ছেতেমের উত্তর এবং উত্তরদেবার ঢং দেখে ফটিক বেপারী অনেকটা কিংকর্ত‍ব‍্যবিমূর হয়ে বললো-
-তোমারে ভালো উপদেশ দিলাম আর
তুমি কও নাক গলাই!
-আমারে তুমি কেমন কইরা কও
গোলেনুর পাপী অলক্ষী? পাপ করলে
আর অলক্ষী হইলেতো গোলেনুরের
মরার কথা আছিলো! সে তো মরে
নাই। আমি মসজিদের ইমাম সাহেবরে
জিজ্ঞাসা করছি। তিনি কইছেন-
অকস্মাৎ অপমৃত‍্যু, আগুনে, পানিতে,
মহামারীতে মৃত‍‍্যু, শহীদের মর্যাদাকেই
বোঝায়। তুমি কও ঠাটা! ছেতেম এতো জানে, এতোজ্ঞাণী কথাদ্বারা ফটিক যেন বেপারীর দুইগালে জুতো পেটা করলো। ছেতেমের কথার ঝাঁজে ফটিকের চেহারাটা ঠাটাপড়া ছাই বর্ণের হয়ে গেলো। মনে হলো তার মাথায় মেঘমুক্ত আকাশ থেকে এইমাত্র নিঃশব্দ বাজ পতিত হয়েছে। কথার ঝাঁজ সহ‍্য করতে নাপেরে ফটিক বেপারী নির্বাক হয়ে, নৌকায় উঠে সোজা খাল বরাবর চলে গেলো।

আজ বৃষ্টি হয়নি। ভাদ্রমাসের পড়ন্ত বিকেল। প্রচন্ড গরম পড়েছে। বিদ‍্যুৎ নেই। তালপাখা হাতে ঘরের সিঁড়িতে বসে বাতাস নিচ্ছে গোলেনুর। বৈকালিক স্নিগ্ধতায় গাছেপাতায় সূর্যকিরণের যে ঐজ্জ্বলো তা যেন গোলেনুরের রুপে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। ঘরের ডোয়া সংলগ্ন সন্ধ্যা মালতির সবুজ পাতার মধ‍্যে গাঢ় লাল বা মেজেন্ডা রঙের ফুলগুলো পাঁপড়ী প্রসারিত কর ফুটতে শুরু করেছে। তার মিষ্টি সুবাস হালকা হালকা ভেসে আসছে বোঝা যায়। কিন্তু গোলেনুর কী ভাবছে বলা মুসকিল।

এমন সময় খাদেমের বউ খলখলি এসে সিঁড়ির নিচে ধাপে বসে বলতে লাগলো-ক‍্যারে গোলে ছেতেম বেপারীর সাথে
নাকি সমন্ধ ঠিক হইছে। গোলেনুর বসে যাই ভাবুক না কেনো, হঠাৎ এই চোকলখোর এরুপ জিজ্ঞাসায়, তার সব ভাবনা তালগোল পাকিয়ে গেলো। সে ভালো ভাবে জানে এই খলখলির স্বভাব কী। অনিচ্ছা সত্বেও উত্তর দিলো-
-এগুলি ভাইভাবি জানে।
-আমি এই কথা শুইনা চিলের মতো
উইড়া আইলাম যে, তোমাক সাবধান
কইরা দেই।
-আমার ভাই সাবধানই আছে।
-তাই থাইকলে হয়। ওই ছেতেম এমন
কিপটার কিপটা যে, খরচ না করার
জন‍্য আগের বউডা মাইরাই গেলো।
আবার শুইনলাম বউয়ের নাকি
বাতাইসা অসুক করুনা ফরুনা
হইছিলো। বাবারে বাবা! কী অশুভ
বংশ নিপাত করা কথা। ওই সংসারে
গেলি অমঙ্গল ছাড়া মঙ্গল হইবো না।
করুনা হইলো ছুঁচি রোগ! তার উপর
আবার আরেকটি ঢ‍্যাং ঢ‍্যাংগা ঢ‍্যাং
মেয়া আছে। অশান্তি। অশান্তিতে
ভরা। বুইচ-চাও। আমার আবার
বউমরা জামাই পছন্দ হয় না। গোলেনুর অগ্নিঝরা চোখে খলখলির তামাটে চামড়ার চেহারা, রুক্ষ চোখের কদর্য চাহনি, পুরুষ মানুষের মতো হালকা অস্পষ্ট গোঁফের নিচে গাছপানের তিক্ত রসে, বেঢপাকৃতির ঠোঁটের ফাঁকে পাটকেল রঙ্গের দাঁত, কন্ঠচেড়া তেঁতো কথাগুলো বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে শুনছিলো। ছেতেমের সাথে যেহেতু সম্পর্কের প্রস্তাব আছে এবং আজরাতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের কথা হবে, তাই খলখলির বক্তব্যে, গোলেনুর মন্তব্য প্রদানে নিজেকে নিবৃত্ত রাখাকে যথার্থ মনে করলো।

———–শেখ হান্নান
নাট‍্যকার লেখক
৫ সেপ্টেম্বর, রবিবার, ২০২১খ্রিঃ
আজিমপুর, ঢাকা-১২০৫.

error: Content is protected !!