আমার বাবা খুব কষ্ট কইরা লেখাপড়া করছিলো। লেখাপড়া কইরা আস্তে আস্তে বড় পদে দাড়াতাছিলো। আমার বাবা নিরুপায় তাকে ম্যাজিস্ট্রেট কিসের জন্য যে গাড়ী চাপা দিয়া মারলো। আমি আমার বাবা হত্যার বিচার চাই। আমার বাবা খুব কষ্ট করছে। তার ইচ্ছা ছিলো খুব বড় লোক হবো। মানুষকে কম্পিউটার শিখাইয়া টাকা পয়সা রোজগার কইরা ঘর বাড়ি করবার চাইছিলো। কয়দিন আগে পাক্কা ঘরের কাজ শুরু করবো কইরা ১ হাজার ইটও কিনছিলো। আর আমার পোলার স্বপ্ন ম্যাজিস্ট্রেট রাজপথে মিশায় দিছে। যারা আমার পোলারে মারছে, আমি তাদের বিচার ও শাস্তি চাই।
শেরপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সংঘাতে নিহত মাহবুব আলমের মা মাহফুজা খানম কান্নাজড়িত কণ্ঠে খবর সংযোগের কাছে এসব কথা বলেন।
৪ আগস্ট বিকেলে শেরপুর শহরের কলেজমোড় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিল চলাকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্রুতগতির গাড়ির চাপায় মাহবুব আলম নিহত হয়। আর এতে মোট ৫ জন নিহতের কথা শোনা যায়।
অন্য নিহতরা হলেন, ঝিনাইগাতী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের শারদুল আশিস সৌরভ, শ্রীবরদী উপজেলার রূপারপাড়া গ্রামের সবুজ হাসান। ওই দিন গাড়ি চাপা ও গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনসহ পাঁচজনের খবর পাওয়া গেলেও আর দুইজনের নাম পরিচয় এখনো পাওয়া যায় নি। নিহতরা সবাই শিক্ষার্থী ছিলেন।
মাহবুবের বাবা মিরাজ আলী ১৭ বছর ধরে মানসিক ভারসাম্যহীন। তার মা ও বড় বোন মাহবুবকে গার্মেন্টসে কাজ করে পড়াশোনা করিয়েছেন। তাদের ৮ শতক জমির বসতভিটা ছাড়া কোনো জমিজমাও নেই। তাই মাহবুবকে নিয়ে পরিবারের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু আন্দোলনে শেষ হয়ে গেছে সব স্বপ্ন।
নিহত মাহবুব আলমের পরিবার জানায়, শেরপুর সদর উপজেলার পাকুিরয়া ইউনিয়নের চৈতনখিলা বটতলা গ্রামের দরিদ্র মিরাজ আলীর দুই ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে মাহবুব আলম (২০) ছিলেন চতুর্থ। মাহবুবের বড় দুই বোন মিলিনা ও সেলিনার বিয়ে হয়েছে। বড় ভাই মাজহারুল ইসলাম শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে হিসাব বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছেন। আর ছোট বোন মারিয়া চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। তিনি শেরপুর সরকারি কলেজের ব্যবস্থাপনা বিষয়ের স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই মাহবুবের তথ্যপ্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ছিলো। উচ্চমাধ্যমিকে পড়ালেখা করার সময় আইটি ল্যাব এডুকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠানের শুরু করেন তিনি।
সরেজমিনে নিহত মাহবুবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মাহবুবের বাড়িতে এখনও চলছে শোকের মাতম। ছেলে ও ভাই হারানোর শোক এখনও শইতে পারছে না। ফ্রেমে বাধানো ছবি দেখে মা মাহফুজা কাঁদছিলো। বাতিজার স্মৃতি মনে করে অঝোরে কাদছিলো তার বয়স্ক জেঠা। অর্থাভাবে কাঁচা ভিটির ওপর নির্মিত মাহবুবদের টিনের বসত ও রান্নাঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে আছে। নতুন একটি ঘর তৈরি করার জন্য মাহবুব কয়েক দিন আগে হাজারখানেক ইট কিনেছিলেন। সেগুলোও বাড়ির ভেতরে জড়ো করে রাখা আছে।
মা মাহফুজা খাতুন বলেন, আমার পরিবারের জন্য আমার বাবা আশা করছিলো মেলা কিছু করবে। আমার বাবা আমাকে কোন কষ্ট করতে দিতো না। বাবা বলতো মা তুমি আমাকে বড় করতে অনেক কষ্ট করছো। আমি এখন বড় হইছি তোমার কোন কষ্ট নাই। আমি সব কষ্ট পুরণ করবো। বলছিলো এখন তুমি অনেক সুখি হবা। কিন্তু সুখি তো হইতে পারলাম না। সব কেড়ে নিলো ম্যাজিস্ট্রেটের গাড়ী। আমার পোলার ওপর দিয়া গাড়ী তুলে দিয়া মাইরা ফেললো। বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ করতো আমার ছেলে। বড় ভাইকে বলতো প্রকল্প নিয়া কাজ করে অনেক বড় হমু। মাহবুব মানুষকে কম্পিউটারের বিভিন্ন বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে যে টাকা আয় করত, তা নিজের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ চলতো।
মাহবুরের জেঠা মমতাজ উদ্দিন সরকার বলেন, মাহবুরের ইচ্ছা ছিলো ইট দিয়া দুইটা রুম করবো। তার জন্য ইটও কিনছিলো। আর ওর ছোট বোন আছে একটা ওরে বিয়া দিবো। তারপর ওর বড় ভাইডারে বিয়া করাবো। এইডা আমার সাথে কইছে। তাও পাইলো না। আমরা মাহবুব হত্যার বিচার চাই।
মাহবুবের বড় বোন মিলিনা খাতুন বলেন, আমি বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করে কাজ করে তাদের খরচ চালিয়েছি। আমার ভাই কেবল রোজগার করে আমাদের দেখা শুরু করছিলো। কিন্তু তাও পারলো না। সেই তো বাড়িতে একমাত্র রোজগার করা ব্যাক্তি ছিলো। আমাদের পরিবার কেমনে চলবে।
তার মামাতো বোন লোপা হামিদ বলেন, আমরা চাই মাহবুব তো চলেই গেলো। তার পরিবারটা দেখার মত সেই ছিলো। এখন তার বড় ভাই আছে কলেজে পড়াশোনা করে তাকে যদি সরকারিভাবে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় তাহলে তাদের পরিবারটা চলতে পারবে।
স্থানীয় লোপা হামিদ বলেন, মাহবুবের পরিবার যেন চলতে পারে সেজন্য আমরা তার বড় ভাইয়ের চাকরির জন্য একটা ব্যবস্থা চাই। আর মাহবুবের হত্যার বিচার চাই। মাহবুব মেধাবী ছাত্র ছিলো। তার লেখাপড়ার সাফল্যের অনেক পুরুষ্কার আছে। সে কলেজ মোড়ে একটা আইটি সেন্টারও খুলেছিলো।
সদর উপজেলার পাকুরিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ছোটবেলা থেকেই মাহবুব কঠিন সংগ্রাম করে বড় হচ্ছিলেন। পড়ালেখার পাশাপাশি ছাত্র পড়িয়ে ও আইটি ল্যাবে কাজ করে সংসারের খরচ জোগাতেন। তাঁর অকালমৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে।
জেলা প্রশাসক আব্দুল্লাহ আল খায়রুম এ বিষয়ে বলেন, এটা তদন্ত না করে তো কিছু বলা যাচ্ছে না।যখন পুরো বিষয়টা তদন্ত হবে তারপর নিশ্চিত হওয়া যাবে। যারা মারা গেছে তাদের জন্য যদি কোন ব্যবস্থা করা যায় সেই বিষয়টা আমরা তাদের পাশে তো থাকবো।
-মোঃ শরিফ উদ্দিন-
আরও পড়ুন
হাতীবান্ধা এস এস একাডেমির জার্সি উন্মোচন ও চাইনিজ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা অনুষ্ঠিত
আলফাডাঙ্গায় শিক্ষকের বিরুদ্ধে একাধিক ছাত্রীকে কুপ্রস্তাব দেয়ার অভিযোগ
ঠাকুরগাঁও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান ১০ হাজার টাকা জরিমানা