হোম » শিক্ষা » সুশিক্ষা গ্রহণ করে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে আদর্শ মানুষ হতে পারে

সুশিক্ষা গ্রহণ করে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে আদর্শ মানুষ হতে পারে

মোহাম্মদ হানিফ (গোলজার হানিফ)  নোয়াখালী প্রতিনিধি : নিরক্ষরতা সমাজের শত্রু, দেশের শত্রু, জাতির শত্রু, জগতের শত্রু, সর্বাপেক্ষা আল্লাহর শত্রু। দেশমাতৃকার উন্নতির জন্য তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন দেশের জনসাধারণকে শিক্ষিত করে তোলা।
 মানুষ সবচেয়ে বেশি গালি দেয় অশিক্ষিত মানুষদের অথচ দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ কাজগুলো করে এই শিক্ষিতরাই।
আমরা বলি, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে মানুষরত্ন লুকিয়ে আছে। তাকে বের করে আনতে হয়, উপযুক্ত পরিবেশ ও শিক্ষা দিয়ে লালন করতে হয়, কাজে লাগাতে হয়। তারপর একটা মানুষ ‘মানুষ’ হয়। তাতে তার নিজের, সমাজের, দেশ ও দশের কল্যাণ হয়। উপযুক্ত সুশিক্ষার মাধ্যমেই কেবল মানুষকে প্রকৃত মানুষ, সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী এবং জনসম্পদে পরিণত করা যায়,
 সঠিক পথে চালানো যায়।টিয়া পাখির মতো মুখস্ত করে বড় বড় সার্টিফিকেট অর্জন করে বড় বড় চাকরি পাওয়াকে শিক্ষা বলে না, শিক্ষা হচ্ছে সেটা যা একজন মানুষের ভিতরের কুশিক্ষাকে দূর করে সমাজের পরিবর্তনে এগিয়ে আসার উৎসাহ যোগায়।যেই শিক্ষা গ্রহন করে যেই শিক্ষার গুণে গুনান্নিত হয়ে ছেলে মেয়ে সাজে, মেয়ে ছেলে সাজতে পছন্দ করে, ঐ শিক্ষাকে জ্ঞানীরা শিক্ষা না জাতীর জন্য বিষ বলে গন্য করেছেন।
জীবনে সফল হতে হলে অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়, অনেক বাধা অতিক্রম করতে হয়। নিজের যোগ্যতা না থাকলে কেউ এতসব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে পারে না। আর এই যোগ্যতা অর্জিত হয় শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে। এছাড়া মানুষের ভুল-ত্রুটি সংশোধনের পথ দেখায় শিক্ষা।শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক মানবিক অধিকার।
খাদ্য ও বস্ত্রের পর পরই এর অবস্থান। একটি শিশুর প্রথম শিক্ষার হাতে খড়ি, প্রথম পাঠশালা হলো পরিবার। যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক ও পারিবারিক শিক্ষাই একজন শিশুকে উন্নত চরিত্র, আদর্শবান নাগরিক ও ভাল মানুষ হিসাবে গড়ে তুলার প্রধান উপকরন হিসাবে বিবেচিত। পরিবারের সদস্যদের মানষিকতা তথা তাদের যথাযথ আচরণ ও ভূমিকাই একটি শিশুকে একজন ভাল মানুষ ও শিক্ষিত হিসাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করে বা গড়ে তুলতে পারে।
যে শিশু যতটা ভাল-সুন্দর পারিবারিক ও সমাজিক পরিবেশে এবং আচরণে তার শৈশবকাল অতিক্রম করবে সে ততটা ভাল ও সৎ মানুষ এবং উন্নত মানষিকতার হবে।একজন সন্তান কেমন হবে, কী করবে, কীভাবে চলবে, তার চিন্তাধারা কেমন হবে, জীবনকে সে কীভাবে দেখবে, কীভাবে যাপন করবে তার বীজ বপন হয় অতি শৈশবেই, বাবা মায়ের হাত দিয়ে।
 জীবন যাপন একটা পদ্ধতি যেটা শিশু পরিবার থেকে দেখে শেখে, স্কুল-কলেজ বা বড় বড় লেকচার শুনে নয়।একজন মানুষের চিন্তা, কর্ম, আচরণ একদিনে তৈরি হয়না। পরিবারের সদস্যদের আচরনের গভীর ছাপ সন্তানের আচরনের মাঝে থাকেই । তবে যে শিক্ষা আত্মবিশ্বাসকে বাড়াতে পারে না সে শিক্ষা প্রকৃত শিক্ষা নয়।
কারণ শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের সামর্থ্য ও যোগ্যতাকে বাড়ানো।জীবনকে সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনা করতে চাইলে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে আত্মশক্তি অর্থাৎ নিজের যোগ্যতা বা সামর্থ্য বৃদ্ধি করে শুধু নিজের জন্য নয় সমাজের জন্যও অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
যে শিক্ষা মানুষকে অন্যের পাশে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে না, যে শিক্ষা মানুষকে ভীরুতা জয় করতে শেখায় না,
যে শিক্ষা জীবনে ও মরণে আলো দিতে পারে না, যে শিক্ষা মানুষকে মূল্যবোধ বিসর্জন দিয়ে স্বার্থপরতায় অন্ধ করে তোলে, যে শিক্ষা মানুষকে উগ্র ইন্দ্রিয় সুখের জন্য হত্যার কারণ তৈরি করে, যে শিক্ষা সতীর্থকে নির্মমভাবে খুন করতে উদ্বুদ্ধ করে, যে শিক্ষা ভালোবাসার কবর রচনা করে ঘৃণাকে উসকে দিয়ে হিংসা ও হানাহানির প্রসার ঘটায়, যে শিক্ষা ঐক্যের পরিবর্তে শুধু বিভেদই বাড়ায়, আজ সর্বত্র সেই শিক্ষারই প্রচার ও প্রসার। এ হচ্ছে বস্তুবাদী শিক্ষার দৃষ্টান্ত।
মানুষের ভেতরে একটি ঘুমন্ত শক্তি আছে। যখন মানুষ শিক্ষায় সুশিক্ষিত হয়ে পূর্ণতা লাভ করে থাকে তখন শিক্ষার সঠিক অনুশীলনেরতে আস্তে তার ঘুমন্ত শক্তি জাগরিত হতে থাকে। এ শক্তি পরিশেষে তার প্রকৃত সত্তাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে তখনই সুশিক্ষা গ্রহণ করে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে আদর্শ মানুষ হতে পারে।
মানুষের জীবনকে একটি দোতলা ঘরের মতো । ‘জীব-সত্তা সেই ঘরের নিচের তলা, আর মানব-সত্তা বা মনুষ্যত্ব উপরের তলা। জীবসত্তা ঘর থেকে মানব সত্তায় উঠবার মই হচ্ছে- শিক্ষা। শিক্ষাই আমাদের মানব সত্তার ঘরে নিয়ে যেতে পারে।’ -‘জীব-সত্তার ঘরটি এমন বিশৃঙ্খল হয়ে আছে, হতভাগ্য মানুষকে সব সময়েই সে সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হয়।’
কিন্তু আজকের মানুষরা এই জীবসত্তার কথা একদম ভুলে গিয়ে কামনা-বাসনা ইত্যাদির কারণে সব সময়ই পরস্পরের সঙ্গে হিংসা-বিদ্বেষে লিপ্ত হয়ে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়ে যায়। আজকের সমাজের দিকে তাকালেই দেখা যায়- মানুষ দিন দিন সে তার মনুষ্যত্বকে হারিয়ে বিবেকশূন্য হয়ে পড়ছে। এর কারণ কী? কারণ আর কিছুই নয় সুশিক্ষা ।
সুশিক্ষার পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ ব্যতীত শিক্ষার এই অমোঘ শক্তি অর্জন করা কখনো সম্ভব নয়। সুশিক্ষাই মানুষের একমাত্র অমূল্য সম্পদ। শিক্ষার এই দিব্য ক্ষমতা অর্জন করে মনুষ্যত্বকে অর্জন করতে পারলেই মানুষ আদর্শ মানুষরূপে গড়ে উঠতে পারবে। সুশিক্ষা ব্যতীত কখনো সকল পাশবিকতাকে পরাভূত করা সম্ভব নয়।
মানুষের অন্তরে মূল্যবোধ ও মনুষ্যত্বের জাগরণ না হলে সকল শিক্ষা-দীক্ষাই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুশিক্ষা যেমন মানুষকে মহৎ করে তোলে তেমনি কুশিক্ষা মানুষকে অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিয়ে যায়। সমাজের দিকে তাকালে দেখা যায় সুশিক্ষা যেন মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করতে পারছে না। তাই শিক্ষার অমোঘ শক্তি যেন আজকের মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে পারছে না। এর কারণ কী? কারণ আর কিছুই নয়- আজকাল মানুষ সুশিক্ষার ধার ধারে না।
এ পৃথিবীতে দু’রকম বাতাস বয়ে চলে। একটি হলো সু-বাতাস অপরটি হলো কু-বাতাস। যারা কু-বাতাসে বড় হয় তারাই মনুষ্যত্বেকে হারিয়ে সমাজে নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়। তাদের মধ্যে কখনো বিবেক জাগ্রত হয় না। এই বিকেকই হলো মনুষ্যত্ব। তাদের বিবেক থাকে না বলেই তাদের হৃদয়ে মনুষ্যত্বের জাগরণ হয় না।
 মনুষ্যত্বের শিক্ষাই মানুষকে টেনে নিয়ে আত্মিক ক্রমবিকাশে সহায়তা করে। মনুষ্যত্বের কারণেই মানুষ সুসভ্য হয়ে আদর্শ মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এই সুসভ্য কথাটা আজকের মানুষের যেন চিন্তার মধ্যেই নেই। তার একমাত্র কারণ তার মধ্যে সুশিক্ষার বাতাস বয় না। যেখানে সুশিক্ষা বাতাস নেই সেখানে অন্যসকল শিক্ষা সব সময়ই ব্যর্থ হয়ে যায়। সুশিক্ষাই মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা দেয়। কেননা চিকিৎসার দ্বারা যেমন মানুষের শরীর রোগমুক্ত হয় সেইরূপ সুশিক্ষা দ্বারা মানুষের বুদ্ধির বিকাশ হয় অর্থাৎ- মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়।
সুশিক্ষা মানুষের মনের একটি চোখ। সেই চোখ দিয়ে মানুষ ভালো-মন্দ দেখতে পারে এবং বুঝতে পারে। কোনটা করা উচিত কোনটা করা উচিত নয়। কোনটা নিজের ও সমাজের জন্য মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে আর কোনটা করলে নিজের ও সমাজের অমঙ্গল হবে।
শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। আত্মশক্তি অর্থাৎ মানুষের নিজের যোগ্যতা ও সামর্থ্যকে বাড়ানোই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য। আত্মশক্তি মানুষের মাঝে সুপ্ত অবস্থায় থাকে বলে অনেক ক্ষেত্রেই মানুষ নিজের শক্তিকে বুঝতে পারে না। শিক্ষা সেই সুপ্ত শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে সাহায্য করে। জগতে নিজের অবস্থানকে মজবুত করে ধরে রাখতে শিক্ষার প্রয়োজন।
শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য মানুষকে বিনয়ী করা। ভালো মানুষে পরিণত করা। কিন্তু বেশির ভাগ উচ্চ শিক্ষিত মানুষদের মাঝেই অহংবোধ চোখে পড়ে। এর কারণ কী? তবে কি শিক্ষা তার মূল উদ্দেশ্য পূরণে ব্যর্থ?
সকল সৃষ্টির মধ্যে বিশেষভাবে মানুষকেই আল্লাহ তাআলা জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা দান করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ যেমন তার পার্থিব জীবনের প্রয়োজন পূরণের উত্তম পন্থা আবিষ্কার করতে পারে তেমনি আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টি এবং আখিরাতের সফলতা-ব্যর্থতার জ্ঞানও ধারণ করতে পারে। ন্যায়-অন্যায়বোধ এবং আসমানী জ্ঞানের উপযুক্ততার কারণেই মানুষের জন্য এসেছে হালাল-হারামের বিধান। মানুষ ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর এই যোগ্যতা নেই।
মানব জীবনে এবং ইসলামে শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।মানব জাতির জন্য হেরা পর্বতের গুহায় নবী করিম (সঃ) এর উপর সর্বপ্রথম আল্লাহর পক্ষ থেকে যে ওহী নাযিল হয় বা আল কোরআনের শুরুটাই হয়েছে পড়ার উপদেশ দিয়ে । এ প্রসংগে আল কোরআনে বলা হয়েছে,”পড়ো! তোমার সৃষ্টিকর্তা প্রভুর নামে। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পড়ো! আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু, যিনি কলমের সাহায্যে শিক্ষা দিয়েছেন। আর শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না”
মানুষের দুনিয়ার প্রয়োজন পূরণের উপযোগী জ্ঞান ও বিদ্যা হচ্ছে জাগতিক শিক্ষা। যেমন বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত ইত্যাদি। এই শিক্ষার মূল সূত্র মানুষের অর্জিত অভিজ্ঞতা।
পক্ষান্তরে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির জ্ঞান হচ্ছে দ্বীনী শিক্ষা। এই শিক্ষার মূল সূত্র ওহী বা আল্লাহর কালাম।
আল্লাহ তাআলা দুনিয়াকে বানিয়েছেন মানুষের প্রয়োজনে এবং তার উপকারের জন্য। এখানে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের বিভিন্ন জিনিষের প্রয়োজন রয়েছে। এই প্রয়োজনগুলো পূরণের জন্য এবং তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করার জন্য মানুষকে দান করা হয়েছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও জ্ঞান-বুদ্ধি। এগুলোকে কাজে লাগানোর জন্য ইসলাম পূর্ণমাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছে।আর এই জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই।একটি শিশু তথা মানুষের জন্মের সাথে সাথেই তার জ্ঞান অর্জনের প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং তা অব্যাহত থাকে তার মরণ সময় পর্যন্ত ।আর এই জন্যই বলা হয়েছে, ” দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অন্বেষণ কর”।
মোটকথা, দ্বীনি শিক্ষার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি রয়েছে জাগতিক শিক্ষার গুরুত্ব। পার্থিব প্রয়োজন পূরণ ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা ও ভারসাম্য ঠিক রাখার জন্য জাগতিক শিক্ষা অতীব জরুরি। উপরন্তু বহু দ্বীনি কাজের জন্যও জাগতিক শিক্ষার প্রয়োজন পড়ে। পক্ষান্তরে জীবনের সব কাজ ইসলামের বিধান মোতাবেক করার জন্য দ্বীনি শিক্ষার বিকল্প নেই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সমাজ যতই উন্নতি লাভ করুক, ইমান ও আল্লাহভীতি না থাকলে নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।আর তাই শিক্ষার গুরুত্ব মানব জীবনে অপরিসীম।

Loading

error: Content is protected !!