হোম » প্রধান সংবাদ » গৃহবন্দির রোজনামচা, ”গুগল মামা ইন্টারনেট দাও”

গৃহবন্দির রোজনামচা, ”গুগল মামা ইন্টারনেট দাও”

জাহাঙ্গীর আলম: করোনার ‘সাজা’ আমার গৃহবন্দিত্বের সোয়া তিন মাস পার হলো আজ মঙ্গলবার ৩০ জুন কুড়ি কুড়ি। বন্দিত্ব কি জিনিষ তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি এই করোনা মহামারীর ‘বদৌলতে’। জীবন সায়াহ্নে এমন একটি অস্বাভাবিক গৃহবন্দিত্বের মুখোমুখি হতে হবে তা কষ্মিণকালেও কল্পনা করিনি। তবে অতীতে যে বা যারা গৃহবন্দি জীবনের স্বাদ পেয়েছেন, বিশেষ করে যারা শীর্ষ রাজনীতিবিদ শুধু তারাই জানেন গৃহবন্দিত্বের স্বাদ বা কষ্ট কতো নির্মম, কতো ভয়ংকর। দন্ডিত কারাবন্দি যারা তাদের কষ্টের কথা না হয় বাদই দিলাম। কারণ তারা অপরাধের জন্য শাস্তি হিসেবে কষ্ট ভোগ করছেন। এ প্রসঙ্গে আমার মনে পড়ছে ওয়ান ইলেভেনের সময়কার বিভিষীকাময় দিনগুলোর কথা, যখন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দূহিতা শেখ হাসিনা এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। ওই কষ্টের দিনগুলোর কথা কি এই দুই শীর্ষ রাজনীতিবিদ কখনো ভুলতে পারবেন? তবে সেই বন্দিত্ব এবং আজকের করোনা বন্দিত্বকে এক মানদন্ডে বিচার করা যাবে না। কারণ বৈশ্বিক করোনা মহামারির এই সময়ে গৃহবন্দিত্ব সার্বিকভাবে মঙ্গলজনক এ কথা অনস্বীকার্য । এক কথায় বলা যায, করোনা আমাদের এই বন্দিত্বকে এক ভিন্ন মাত্রায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

সাধারণ ছুটির দিনগুলো

আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ থেকে প্রথম মেয়াদের সাধারণ ছুটি কার্যকর হওয়ার কয়েকদিন আগেই আমার ডাক্তার মেয়ে এবং ছোট মেয়ের পীড়াপীড়িতে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে শুরু করি । সাধারণ ছুটি ঘোষণার ২/৩ দিন আগে থেকেই বাড্ডার ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারে বিকল্পধারার দলীয় অফিসটি লকডাউন করা হয়। এর আগে মোল্লা টাওয়ারের অফিসটিতে আমি ছাড়াও আমাদের দপ্তর সম্পাদক ওয়াসিমুল ইসলাম এবং অফিস সহকারি মো. ইব্রাহিম নিয়মিত ছিলাম। অনিয়মিতভাবে আসতেন এমপি জনাব মাহী বি. চৌধুরীর এপিএস আসাদুজ্জামান বাচ্চু ও শহীদুল্লাহ কামাল ঝিলু, (যিনি ঝিলু চেয়ারম্যান নামে সমধিক পরিচিত।), আর দুই/এক দিন পর পর আসতো যুবধারার সাংগঠনিক সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম শিহাব এবং শ্রমজীবীধারার সহ সভাপতি ওমর ফারুক আর সোহেল নামে একটা ছেলে।

বিকল্পধারার প্রধান সাবেক রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক এ.কিউ.এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, মহাসচিব মেজর (অব.) আব্দুল মান্নান এমপি, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সংসদ সদস্য জনাব মাহী বি চৌধুরী আসতেন কালেভদ্রে। অবশ্য বড় কোনো দলীয় কর্মসূচি থাকলে শীর্ষ নেতৃত্বসহ দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের পদভারে মুখরিত থাকতো এই দলীয় কার্যালয়। তিনমাসের বেশি সময় এটি লকডাউনে ।
বন্দি জীবনে টবে করলা চাষ।

আমার বন্দি জীবনের মেয়াদ হাসতে খেলতে বেড়েই চলছে। কতক্ষণই বা কথা বলা যায়, আর কতক্ষণই ফেসবুকে বিচরণ করা যায় ? অখন্ড অবসর কি করি, কি করি ভাবতে ভাবতে একসময় সিদ্ধান্ত নিলাম ছাদে সবজি চাষ করবো। এর আগে আমার ছোট মেয়ে ছাদে অল্প কিছু সবজি গাছ লাগিয়েছিল। এরমধ্যে একটি চাল কুমড়া এবং কিছু পুদিনা পাতার গাছ ছিল। রোজার সময় আমি প্রায়ই ইফতারির আগে ঘন্টাখানেক ছাদে গিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াতাম। দেখতাম, মেয়ের লাগানো গাছগুলোর তেমন যত্নআত্তি নেই। কারণ লকডাউন বা সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকে আমার ছোট মেয়েটি ঘর সংসারের তাবৎ কাজ একাই করছে। করোনার কারণে খন্ডকালীন গৃহকর্মী বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন সব কাজ নিজেদেরই করতে হয়।

আমি ছাদের টবে লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যায় মনোনিবেশ করলাম। হঠাৎ করে এই কাজে আমার আগ্রহ দেখে ছোট মেয়ে এবং আমার স্ত্রী একটু আশ্চর্যই হয়েছিল। পেশাগত কারণে বাসায় আসতে রাত হতো আমার। তাই গাছপালা লাগানোর সময় বা সুযোগ কোনোটাই আমার ছিল না। যাইহোক বন্দিকালীন সময়ে আমার মেয়ে আমাকে সবজি চাষে নিরুৎসাহী করেনি।

এরমধ্যে আমি ইউটিউবে বর্ষাকালীন সবজি চাষ এবং সবজির পরিত্যাক্ত অংশ দিয়ে তরল কম্পোষ্ট সার তৈরির পদ্ধতি নিয়ে ভিডিও দেখতে শুরু করি। টবে করলা চাষের উপর একটি ভিডিও দেখে করলা চাষের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে। মেয়ে আমাকে করলা বিচির যোগান দেয়। সেই থেকে শুরু। আমি করলার চারা তৈরি করে রোপণ করলাম টবে। এখন ওগুলো বেশ বড় হয়েছে । অবশ্য করলা ধরেনি এখনো ।
গুগল মামা ইন্টারনেট দাও।

গৃহবন্দিত্বের এই দুর্দিনে আমার একটি পরমপ্রাপ্তি আছে। এই সময় আমি আমার তিন বছরের নাতনি আরিয়া মনিকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। ও আমাকে ওর খেলার সাথী করে নিয়েছে। খেলনা চুলোয় হাড়ি-পাতিলে নানা পদ রান্না করে আরিয়া আমাকে খাওয়ায়। আমিও মিছিমিছি খাই, আর ওর রান্নার প্রশংসা করি। প্রশংসা শুনে খুব খুশি হয় আরিয়া মনি। আরিয়া ইউ টিউবে কিডস ভিডিও দেখার ওস্তাদ। সুযোগ পেলেই আমার অথবা ওর নানীর মোবাইল নিয়ে বাচ্চাদের ভিডিও দেখতে শুরু করে। মোবাইলে ভিডিও দেখা ওর মা-বাবাসহ আমরা কেউই পছন্দ করি না এবং এটা যেন আসক্তিতে পরিণত না হয় সে জন্য মাঝে মাঝে ওয়াইফাই রাউটার অফ করে দেওয়া হয়। ও বুঝতে পারে না, তখন বলে “ইন্টারনেট নাই, ‘গুগল মামা’কে ফোন দাও।” অফ লাইনে ‘সে হ্যালো গুগলে’ কথা বলতে শুরু করে ‘গুগল মামা ইন্টারনেট দাও’ । মোবাইল ডাটা অফ থাকলে ছাতা মাথায় একটা কার্টুনের ছবি আসে, আর ওটা টাচ করলেই কার্টুনটি উপরে উঠতে থাকে একসময় কিছু পাখি উড়তে শুরু করে। পাখির সঙ্গে কার্টুনটির সংঘর্ষ হতেই ওটি নিচে পড়ে বড়ো হয়ে যায়। এভাবেই আরিয়া মনিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে শান্ত করতে হয়।

আমার এই ক্ষুদে বন্ধুটি টিভিতে মাঝে মাঝে আমাকে বাচ্চাদের “মোটুপাতলু” সিরিয়ালটি দেখতেও বাধ্য করে। ও খুব উপভোগ করে, আর আমি বিরক্তির শেষপ্রান্তে পৌঁছেও খানিকটা অভিনয় করে হাসি বা বাহাবা দেই “মোটু আর পাতলুকে।” ও সোৎসাহে বলে ওঠে, পাতলুর ডায়লগ “ আইডিয়া।”
বাকপটু আমার এই বন্ধুকে আমি মাঝে মাঝে রসিকতা করে বলি, আমাকে তোমার দাদু বাড়ি নিয়ে যাবে? ও উত্তর দেয়, “এখন তো লকডাউন। লকডাউন খুললে তোমাকে নিয়ে যাবো।” করোনাভাইরাস শব্দটিও মাঝে মাঝে বলে ফেলে অবলীলায়।

টিয়া পাখি সমাচার


আমার মেঝো মেয়ে তার বনশ্রীর বাসায় ২টি টিয়া পাখি পুষতো। লকডাউনের বেশ আগেই ও পাখি দুটো আমাদের কল্যাণপুরের বাসায় দিয়ে যায়। সাধারণ ছুটির প্রথম দিকে ১ টি টিয়া অসুস্থ হয়ে মারা গেলে দ্বিতীযটি প্রকৃতিতে অবমুক্ত করে দেয় আমার ছোট মেয়ে। জানি না মুক্ত হয়ে পাখিটি কোথায় আছে ? তবে আমার প্রিয় বন্ধু আরিাযা মনি মাঝে মাঝে বলে, “মিঠু মরে গেছে।” পাখি দুটোর নাম মিঠু পিঠু আমিই দিয়েছিলাম। ওদের জন্য বাজার থেকে কেনা অনেক খাবার (ধান এবং সূর্যমুখি ফুলের বিচি ) এখন চড়ুই পাখির আহার যোগাচ্ছে। আমি প্রতিদিন সকালে ওই খাবারের কিছুটা ব্যালকনিতে রেখে দেই, বিকালে দেখি সব সাবার । মানে চড়ুই পাখি সব খেয়ে ফেলেছে।

প্রতিদিন ওরা আসে এই খাবারের লোভে ।

ম্যসেঞ্জার, হোয়াটঅ্যাপস ইমোতে যোগাযোগ
যাই হোক গৃহবন্দিত্বের এই সোয়া তিন মাস ভালোমন্দ মিলিয়েই কেটে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বি. চৌধুরী স্যার বাংলাদেশ প্রতিদিনে লেখার জন্য ডিকটেশন দেন হোয়াটসঅ্যাপে। ওদিকে আবার লেখার জন্য বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিবেদক ছোট ভাই মাহমুদ আজহারের তাগিদ তো আছেই। মাঝে মাঝে দলীয় নেতা অথবা অন্য দলের বা কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যাক্তি বিশেষ করোনায় মারা গেলে শোকবাণী আর বড়ো কোনো ঘটনা ঘটলে স্যারের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিতে হয় সংবাদ মাধ্যমে।

আমি বন্দিত্বের এই সময়ে বি. চৌধুরী স্যার ছাড়াও দলের মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নান এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব শমসের মবিন চৌধুরী বীরবিক্রম, জনাব গোলাম সারোয়ার মিলন, জনাব মজহারুল হক শাহ চৌধুরী, জনাব আব্দুর রউফ মান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ ইউসুফ এবং আমার বন্ধু অধ্যাপক ডা. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব মাহবুব আলী, সহ-সভাপতি মিসেস মাহমুদা চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক ব্যারিস্টার ওমর ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব জনাব এনায়েত কবীর, দপ্তর সম্পাদক জনাব ওয়াসিমুল ইসলাম, সহ-সভাপতি জনাব বি.এম নিজাম উদ্দিন, শ্রমজীবীধারার সভাপতি আইনুল হক, বি. চৌধুরী স্যারের বড় মেয়ে ব্যারিস্টার মুনা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছি, কুশল বিনিময় করেছি মেসেঞ্জারে, হোয়াটসঅ্যাপে।

কথা হয়েছে ই-আর মিডিয়ার জেনারেল ম্যানেজার মসিউর রহমান, বি চৌধুরী স্যারের এপিএস শাহ আলম, ই-আর মিডিয়ার পোলেন, সাফওয়ান, লাবিব, বাচ্চু, শিহাব, বিজন, সোহাগ, সাত্তার, মোজাম্মেল, ট্রপিক্যাল মোল্লা টাওয়ারের অন্যতম কর্ণধার জনাব আবদুল মোতালিব মোল্লা এবং আমার ছেলেবেলার বন্ধু ডা. কামরুল হাসান লালী, আরেক বন্ধু আলী হোসেন এবং ময়মনসিংহে বসবাসরত অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা আমার প্রিয় বন্ধু চপলকান্তি রায়, ময়মনসিংহের সিনিয়র সাংবাদিক আবুল হাসিম এবং প্রিয় ভাবশিষ্য বিশিষ্ট কবি ও সাংবাদিক গাউসুর রহমানের সঙ্গে।

এছাড়া মাঝে মাঝে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয়, দেশের বাইরে থাকা আমার বন্ধুবর বিকল্পধারা যুক্তরাজ্য শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ অহিদ উদ্দিন, বিকল্পধারার আরেক নেতা যুক্তরাজ্য প্রবাসী বন্ধুবর মিছবাহ জামাল, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বিকল্পধারার প্রবাসী বিষয়ক সম্পাদক বন্ধুবর মুনিরুল ইসলাম এবং আমাদের মামাখ্যাত কমিশনার আবদুস সাত্তারের সঙ্গে। আর ইদানিং ইমোতে বেশি কথা হয় টরেন্টো প্রবাসী আমার স্কুল জীবনের প্রিয় শিক্ষক জামান স্যারের সঙ্গে। এ ছাড়া ফেসবুকের বন্ধুসহ অনেক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ তো আছেই।

বস্তুত:পক্ষে করোনাভাইরাস আমাদের স্বাভাবিক জীবনকে কেড়ে নিয়েছে। ছন্দপতন ঘটিয়েছে আমাদের ছকে বাধা জীবনের। ব্যাক্তি ও রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অর্থনীতিবিদদের ভাষায়. একটি সুদূরপ্রসারী সংকট ডেকে এনেছে করোনা। “দিন আনে দিন খায়” এমন লোকজন ছাড়াও ক্ষুদ্র বা মাঝারি ব্যবসায়ী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি অংশ অর্থনৈতিক সংকটের যাতাকলে পৃষ্ঠ হচ্ছে অবিরাম। করোনার থাবা এখন বিধ্বংসী। দিন দিন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। সুতরাং জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। অতএব, সাধু সাবধান।

 

error: Content is protected !!